চট্টগ্রামে নগরীর টেরিবাজারে স্বর্ণের কারিগর মাধব দেবনাথ হত্যার রহস্য উদঘাটন হয়েছে। তার মামাত ভাই পিন্টু দেবনাথের স্ত্রী বিথী দেবনাথ একাই মাধবকে খুন করেছেন বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। দিয়েছেন পরকীয়ার করুণ বর্ণনা। এই হত্যাকাণ্ড না ঘটালে তাকে আত্মহত্যা করতে হতো বলেও জানিয়েছেন বিথী। টানা দু‘দিন জিজ্ঞাসাবাদের পর প্রেমিক মাধবকে একাই খুন করেছেন বলে পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি দেন বিথী।
গতকাল সোমবার (০৭ ডিসেম্বর) এমন তথ্য জানান কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন। ওসি বলেন, বিথীর মতো নার্ভ শক্ত নারী পেশাগত জীবনে খুব কমই দেখেছি। জিজ্ঞাসাবাদের শুরু থেকে তিনি বলে আসছেন, এই খুনের সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ৪ ডিসেম্বর রাতে মাধবের লাশ উদ্ধারের পর বিথী দেবনাথ ও তার স্বামী পিন্টু দেবনাথসহ পিন্টুর দুই ভাই, মা-বাবাসহ ৬ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে আসা হয়। এরপর ডিসি, এডিসি ও এসিসহ আমরা জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করি। শেষ পর্যন্ত রবিবার রাতে বিথী স্বীকার করে সে-ই অপরাধী। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি শেষে আদালত তাকে কারাগারে পাঠিয়েছেন।
বিথী স্বীকারোক্তিতে বলেন, অন্যের ঘরণী হয়েও পরকীয়ার সর্বনাশা ফাঁদে পা দিয়েছেন তিনি। করেছেন শারীরিক সম্পর্ক। যার কিছু ভিডিও স্বামী ও ননদের হাতে পাঠায় মাধব। এতে প্রথমে আত্মহত্যার কথা চিন্তা করেন বিথী। পরে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেন, যে তাকে ফাঁদে ফেলেছে তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিলেই কেবল এ যন্ত্রণার অবসান হবে।
বিথী বলেন, ২ ডিসেম্বর রাত পৌঁনে ১০টার দিকে বিদ্যুৎ চলে গেলে আমার দেবর, শ্বশুর ও শাশুড়িসহ সবাই বাসার বাইরে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর দেখি, মাধব আমার রুমে। তাকে জিজ্ঞেস করলে বলে দরজা খোলা ছিল। অন্যদের বের হতে দেখে সে বাসায় ঢোকে। তখন আমার হাত-পা কাঁপছিল। মাধবকে জিজ্ঞাসা করি- কেন এসেছো এবং কিভাবে আমার স্বামীর নিকট ভিডিওটা (বিথীর খোলামেলা ভিডিও) পাঠিয়েছো। সে জানায়, ফেক আইডি খুলে ওই ভিডিও আমার হাজবেন্ডকে দেয়। মাধব ওই সময় বলে, ও যেভাবে চায় সেভাবে আমাকে দিতে হবে। ওর কথা না শুনলে সব ভিডিও আমার ভাই, কাকা আত্মীয়-স্বজনকে দিয়ে আমাকে চরিত্রহীনা বানাবে। আমার হাজবেন্ড হাজারী গলিতে কোনোদিনও মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সে ব্যবস্থা করবে।
তখন আমার মাথায় আসে, এখান থেকে বের হলে সে যে কাউকে ভিডিওগুলো দেখাতে পারে। তাই তাকে মেরে ফেলার মনস্থির করি। কৌশল হিসেবে শারীরিক সম্পর্ক করার প্রস্তাব দিই, বলি তুমি যেভাবে চাইবে সেভাবে হবে। তবে আজকে আমার মনে যেভাবে চায় সেভাবে তোমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করবো। এতে রাজি হয় সে। এরপর তাকে ফ্লোরে শোয়াই। তখন বলি, শারীরিক সম্পর্ক করার সময় তুমি উত্তেজিত হয়ে আওয়াজ করলে তা রুমের বাইরে যাবে। তখন বিপদে পড়ে যাব। এরপর তার মুখ বেঁধে ফেলি। কথা বলতে বলতে এবং আদর করতে করতে কামিজের এক টুকরা কাপড় দিয়ে পা ও হাত বেঁধে ফেলি। এরপর ওর রানের ওপরে বসে গলায় গামছা দিয়ে গলা চেপে ধরি। নাক মুখ থেকে ফেনা বের হলে গলা ছেড়ে দেই। পরে পুরো শরীর খাটের নিচে ঢুকিয়ে দেই।
বিথী বলেন, ২০১৮ সালে ১ মার্চ আমার বিয়ে হয়। বিয়ের ১০ দিন পর চট্টগ্রামে আসি। লালদীঘিরপাড় জামাল কমপ্লেক্সের ওপরে চার তলায় আমরা ভাড়া ছিলাম। মাধব আমার স্বামীর পিসতুতো (ফুফাত) ভাই। সে আমাদের বাসায় সাড়ে ৩ হাজার টাকার বিনিময়ে দু‘বেলা ভাত খেতো। মাঝে কয়েকদিন অসুস্থ ছিল। তার সেবা যত্নের কাজে শ্বাশুড়ির সঙ্গে আমি সহযোগিতা করতাম। সুস্থ হওয়ার পর মাধবের সঙ্গে আমার ফোনে কথা হতো. চ্যাটিং হতো। এভাবে তার সঙ্গে আমার পরকীয়া প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং বিভিন্ন তারিখ ও সময়ে আমার বাসায় মাধবের সঙ্গে আমার শারীরিক সম্পর্ক হয়।
লকডাউন শুরু হলে মার্চের ২৭ কিংবা ২৮ তারিখ মাধব দেশের বাড়ি চলে যায়। তখন আমার স্বামীর মোবাইলে ইমোতে ভিডিও কলে কথা বলতো মাধব। একপর্যায়ে সে আবদার করলে খোলা অবস্থায় আমার বুকের ভিডিও তার ইমোতে পাঠাই। পরে আমার স্বামীর মোবাইল থেকে তা ডিলিট করে দিই। লকডাউনের ৩ মাস মাধব বাড়িতে ছিল। নতুন বাসায় ওঠার এক থেকে দেড় মাস পর মাধব চট্টগ্রাম আসে। পূর্বের মতো দুই বেলা খাওয়ার খরচ দিয়ে বাসায় খাবার খেতো।
এর মধ্যে মাধব থেকে পিন্টু ১০ হাজার টাকা ধার নেয়। ধারের টাকা নিয়ে মামাতো ও পিসতুতো ভাইয়ের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। মাধবকে ওই টাকা পরিশোধ করেন পিন্টু এবং বাসায় যেতে নিষেধ করেন। স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় আমি মাধবকে এড়িয়ে চলতাম। এর মধ্যে আগস্টে বাবার বাড়ি বেড়াতে যাই আমি। তাই বাপের বাড়ি থাকা অবস্থায় বিভিন্নভাবে কথা বলার চেষ্টা করলেও সফল হয়নি মাধব। এর মধ্যে একদিন মাধব খবর পাঠায়, তার কাছে দু’জনের এমন কিছু গোপন কথা ও দৃশ্য ধারণ করা আছে, যা ছড়িয়ে দেবেন।
তাকে তখন কাকুতি মিনতি করে বলি চট্টগ্রামে এসে সামনা-সামনি কথা বলবো। কিন্তু চট্টগ্রামে ফিরে এলেও বিভিন্ন কারণে মাধবের সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। এতে ক্ষিপ্ত হয় মাধব। পরে মাধব আমার ননদকে জানিয়ে দেয় তার কাছে থাকা দু’জনের ভিডিওর কথা। নভেম্বর মাসে কালিপূজার দু’দিন আগে একটা ফেইক আইডি থেকে স্বামী পিন্টুর কাছে ভিডিও পাঠায় মাধব। শুরু হয় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অশান্তি। এ সময় আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু তাতে তো বদনাম ঘুচবে না, তাই তাকে সরিয়ে দেই।
উল্লেখ্য, খুনের শিকার মাধব দেবনাথ, খুনি বিথী দেবনাথ, তার স্বামী পিন্টু দেবনাথ কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর এলাকার বাসিন্দা। এ ঘটনায় মাধব দেবনাথের পরিবার কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা করেছেন।