॥ ফেরদৌস আহমদ ভূইয়া ॥
ভারতে মুসলমানরা সংখ্যালঘু হলেও সংখ্যায় অনেক বেশি। ভারতে বর্তমানে মুসলমানের সংখ্যা প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। অবশ্য সরকারিভাবে বলা হচ্ছে, তা শতকরা ১৫ ভাগ মাত্র। ১৯৪৭ সালে ভারতে মুসলমানের সংখ্যা ছিল এক-চতুর্থাংশ অর্থাৎ শতকরা ২৫ ভাগ। ১৯৪১ সালের এক আদমশুমারিতে ভারতে মুসলমানের সংখ্যা ছিল ৯ কোটি ৪৫ লাখ। আর তখন পুরো ভারতে জনসংখ্যা ছিল ৩৬ কোটি। ভারতে এখনো কোনো কোনো রাজ্যে মুসলমানের সংখ্যা ৪০ শতাংশ আর কাশ্মীরে মুসলমানের সংখ্যা প্রায় ৮০ শতাংশ। ১৯৪৮ সালে কাশ্মীরে মুসলমানের সংখ্যা ছিল প্রায় ২৪ লাখ, হিন্দু মাত্র ৭ লাখ আর শিখ ও বৌদ্ধ ছিল মাত্র কয়েক হাজার। কাশ্মীর ছাড়াও ভারতের আরো পাঁচ রাজ্যÑ আসাম, পশ্চিম বঙ্গ, বিহার, উত্তর প্রদেশ ও কেরালায় মুসলমান জনসংখ্যা প্রায় ২০ থেকে ৪০ শতাংশ। ভারতে মুসলমানের সংখ্যা ও সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে একটি ব্যাপক উপস্থিতি হলেও রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরিতে অনেক পিছিয়ে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কবলে পড়ে মুসলমানরা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছে। তাই ভারতের মুসলিম ও মুসলিম রাজনীতিকরা বিকল্প ভাবছেন ও বিকল্প পথে হাঁটা শুরু করেছেন এবং এতে করে বিকল্প রাজনীতির বিকাশ ঘটছে।
ভারতের আইনসভার নিম্নকক্ষ লোকসভার আসন সংখ্যা হচ্ছে ৫৪৫। একসময় এ লোকসভার ১০ শতাংশ এমপি ছিল মুসলমান, যা বর্তমানে ৪ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। ১৯৮০-র দশকেও ভারতীয় লোকসভায় ৪৯ এমপি ছিল মুসলিম। তারপর থেকেই ভারতের লোকসভায় মুসলিম এমপির সংখ্যা কমতে থাকে।
ভারতের স্বাধীনতার পর থেকেই মুসলিমরা তাদের নিজস্ব অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে ধর্মনিরপেক্ষ ও আঞ্চলিক দলগুলোকে ভোট দিয়ে আসছিল। বিগত ৭০ বছর ধরে মুসলিমরা শুধু ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোকেই ভোট দিয়েই আসছে, কিন্তু তাদের উন্নয়নে এ দলগুলো পাশে দাঁড়ায়নি। ভারতের হায়দরাবাদের মাওলানা আজাদ ন্যাশনাল উর্দু ইউনিভার্সিটির পলিটিক্যাল সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আফরোজ আলম তুরস্কের সংবাদমাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ড’র সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ভারতের মুসলিমরা নির্বাচনে ভোটদানের ব্যাপারে কংগ্রেসের মতো ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর কাছে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হতে হতে এখন হতাশ হয়ে পড়েছে। তাই তারা এখন মুসলিম দলগুলোকে ভোট দিতে শুরু করেছে, যদিও তা হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের জন্য সহায়ক হচ্ছে।
যার কারণে দেখা যাচ্ছে, ২০১৪ সালের বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে মুসলিম নেতৃত্বাধীন দলগুলোর উত্থান হচ্ছে এবং তারা কিছু কিছু আসন পাচ্ছে। যেমন হায়দরাবাদভিত্তিক রাজনৈতিক দল অল ইন্ডিয়া মজলিসে ইত্তেহাদুল মুসলেমিন (এআইএমআইএম) মিম, আসামের মাওলানা বদরুদ্দিন আজমলের অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (এআইইউডিএফ), কেরালায় ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন অব মুসলিম লীগ (আইইউএমএল), জাতীয় পর্যায়ে দিল্লিভিত্তিক রাজনৈতিক দল হচ্ছে ওয়েলফেয়ার পার্টি অব ইন্ডিয়া। বিগত নির্বাচনে এ দলটি লোকসভা নির্বাচনে এমপি পদে বেশকটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে এবং পশ্চিমবঙ্গেও যুব ধর্মীয় নেতা আব্বাস সিদ্দিকীর নেতৃত্বে মিম-র রাজনৈতিক উত্থান হচ্ছে।
তাই সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ভারতের রাজনীতিতে মুসলিম ভোটাররা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে এবং কেন্দ্র থেকে শুরু করে রাজ্যগুলোয় ক্ষমতার জন্য ফ্যাক্টর হয়ে উঠছে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, কেরালা, বিহার উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন রাজ্যে জাতীয় ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো মুসলিম ভোটারদের গুরুত্বসহকারে কাছে টানছে। অবশ্য এসব দলগুলো ক্ষমতার স্বার্থে মুসলিমদের ভোট পাবার চেষ্টা করছে, কিন্তু চাকরি, ব্যবসা, বাণিজ্যিক সুবিধা প্রদানের বেলায় তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না।
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় ৪০ শতাংশ। এ রাজ্যে মুসলমানদের ভোট অনেক আসনে ফ্যাক্টরও বটে। ন্যাশনাল পার্লামেন্ট তথা লোকসভাসহ অনেক বিধানসভা আসনে মুসলমানরা কংগ্রেস বা তৃণমূলের প্রার্থী হয়ে বিজয়ীও হয়েছে। এমনকি বামফ্রন্টের টিকিটেও মুসলিম অনেক প্রার্থী বিধান সভার আসনে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছেন। একসময় বামফ্রন্ট মুসলমানদের বিভিন্ন টোপ দিয়ে তাদের ভোটে প্রায় তিন দশক পশ্চিমবঙ্গ শাসন করেছে। উল্লেখ্য, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট ১৯৭৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় ছিল। বামফ্রন্ট মুসলমানদের ভোটে ক্ষমতায় গেছে ঠিকই, কিন্তু মুসলমানদের উন্নয়নে কিছুই করেনি। কিন্তু তিন দশকের বেশি পশ্চিমবঙ্গ শাসনকারী বামফ্রন্টের আমলে মুসলমানরা চাকরি-বাকরিতে সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে পড়েছে। এভাবে একসময় কংগ্রেসকে ভোট দিয়ে পরবর্তীতে বামফ্রন্টের প্রতারণার শিকার হয়ে মুসলমানরা ক্রমশ পিছিয়ে পড়েছে। ২০১৬ সালের এক সরকারি প্রতিবেদনে জানা গেছে যে, পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের হার মাত্র ৫ দশমিক ৭ ভাগ। অবশ্য তৃণমূলের আমলে এটা এক শতাংশ বেড়েছে বলে জানা গেছে। তৃণমূলের আমলে বিধানসভা তথা রাজ্য আইনসভায় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব বেড়েছে। ২০০৬ সালে বামফ্রন্টের আমলে বিধানসভায় মুসলিম এমএলএ ছিল ৪৬ জন, ২০১৬ সালে হয়েছে ৫৯ জন মুসলিম এমএলএ। পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার আসন হচ্ছে ২৯৪টি। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার অধিকাংশ আসনেই মুসলিমরা হচ্ছে ব্যালেন্স ভোট, তারা যেদিকে ভোট দেয়, সেদিকেই বিজয় নিশ্চিত হয়।
তৃণমূলের জন্য উভয় সংকট
এমনি একটি পরিস্থিতিতে ২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন সামনে রেখে ভারতের হায়দরাবাদভিত্তিক রাজনৈতিক দল অল ইন্ডিয়া মজলিসে ইত্তেহাদুল মুসলেমিন (এআইএমআইএম) মিম-র অংশগ্রহণ নিয়ে একটি রাজনৈতিক মেরুকরণ হতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন।
হায়দরাবাদের লোকসভা আসনের এমপি আসাদউদ্দিন ওয়াইসির নেতৃত্বাধীন মিম ইতোমধ্যে অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত বিহার রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মতো অংশগ্রহণ করে পাঁচটি আসনে জয়লাভ করেছে। মিম ২০১৫ সালে বিহারের বিধানসভায় অংশগ্রহণ করলেও কোনো আসনে জয়ী হতে পারেনি। ২০১৫ সালে মিম ৫টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও এবার ৭৫ আসনে করেছে। বিহারের ৫ আসনে জয়ী হওয়ার পর মিম পার্শ্ববর্তী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।
উল্লেখ্য, অল ইন্ডিয়া মজলিসে ইত্তেহাদুল মুসলেমিন (এআইএমআইএম) সংক্ষেপে মিম মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে ভারতের রাজনীতিতে একটি অবস্থান তৈরি করেছে। ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীন রাজ্য হায়দরাবাদে ১৯২৭ সালে মিমের প্রতিষ্ঠা। কাসেম রিজভী নামে একজন আইনজীবী ১৯৪৪ সালে মিমের দায়িত্ব গ্রহণ করে হায়দরাবাদকে ভারতে অন্তর্ভুক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাই ভারত সরকার তাকে গ্রেফতার করে। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যান। তারপর দলটির দায়িত্ব নেন আবদুল ওয়াইসি। তার নাতি ব্যারিস্টার আসাদউদ্দিন ওয়াইসি এখন দলটির অবিসংবাদিত নেতা।
১৯৪৭ সালের পর বিগত ৭০ বছর ধরেই পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের ভোটেই কংগ্রেস, বামফ্রন্ট ও হাল আমলে তৃণমূল ক্ষমতাসীন হয়েছে। মুসলমানরা কংগ্রেস ও বামফ্রন্টকে ভোট দিলে আখেরে মুসলমানরা যেই তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই পড়ে আছে। তৃণমূল কংগ্রেস আমলে যে মুসলমানদের খুব বেশি উন্নয়ন হয়েছে, তেমন বলা যাবে না। তাই আগামী বছরের বিধানসভা নির্বাচনে যদি মিম পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তাহলে মুসলিম ভোট ওয়াইসির দলে কিছুটা হলেও যাবে। তাই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পশ্চিমবঙ্গে মিমের আগমন ও বিধান সভা নির্বাচনে প্রার্থী দিলে মুসলিম ভোট ভাগ হয়ে যেতে পারে। আর মুসলিম ভোট ভাগ হয়ে গেলে তৃণমূলের জন্য একটি হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। বিহারে মিম পাঁচ আসনে জয়ী হলেও মুসলিম ভোটের কারণে অনেক আসনে বিজেপি জোট জয়ী হয়েছে আর বিজেপিবিরোধী জোট হেরেছে। তাই বিহারে বিজেপির বিজয়ে মিমের ৭৫ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকেই অনেকেই দায়ী করেছেন। অবশ্য আসাদউদ্দিন ওয়াইসি এ অভিযোগের জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের আগে তার দল বিজেপিবিরোধী জোটে যোগ দেয়ার অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু বিহারের বিজেপিবিরোধী আঞ্চলিক দলগুলো মিমকে কোনো পাত্তা দেয়নি। তাই বিহারে মিম এককভাবে নির্বাচন করেছে।
অবশ্য পশ্চিমবঙ্গে মিম কারো সাথে জোট করবে কিনা, তার কোনো ইঙ্গিত এখনো পাওয়া যায়নি। কিন্তু তৃণমূলের পক্ষে মিমের সাথে কোনো ধরনের জোট বা অ্যালায়েন্স করা সম্ভব নয়। কারণ আসাদউদ্দিন ওয়াইসির দল মিম সারা ভারতবর্ষে একটি ব্র্যান্ডে পরিচিত হয়ে উঠেছে যে, মিম ইসলাম ও মুসলমানদের পক্ষের দল। তাই তৃণমূল যদি মিমের সাথে আনুষ্ঠানিক জোট করতে যায়, তাহলে মমতার পক্ষে যে হিন্দু ভোট আছে তাতে ভাটা পড়বে বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। তাই পশ্চিমবঙ্গে মিমের আগমন মমতা ব্যানার্জির তৃণমূলের জন্য উভয় সংকট হয়ে পড়বে।
মিমের প্রধান ওয়াইসি বলেছেন, আমাদের দল বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর প্রদেশে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও আসাম ও কেরালায় করবে না। কারণ আসামে মাওলানা বদরুদ্দিন আজমলের দল এআইইউডিএফ এবং কেরালায় মুসলিম লীগ মুসলমানদের স্বার্থে কাজ করছে। উল্লেখ্য, এআইইউডিএফ আসামে লোকসভার প্রতিটি নির্বাচনেই এক-দুইটি আসনে বিজয়ী হয় এবং কেরালায় মুসলিম লীগ বরাবরই লোকসভায় দুটি আসনে বিজয়ী হয়ে আসছে।
Check Also
ঘোনা ইউনিয়নে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কর্মী সম্মেলন
আবুল হোসেন সদর প্রতিনিধি : ঘোনা ইউনিয়নে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ …