উপকূলীয় জেলা সমূহে কৃষিতে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব: সাতক্ষীরাতে ২৬ ভাগ জমিতে কোন ফসল হচ্ছে না: ৬৭ হাজার পরিবার ভুমিহীন; বেকারত্ব রাড়ছে: কৃষিকে শক্তিশালী করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের দাবী
আবু সাইদ বিশ্বাস:সাতক্ষীরা: উপকূলীয় জেলা সমূহে কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মারাতœক আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে সাতক্ষীরা জেলায় এর প্রভাবে এক লক্ষ ৫৩ হাজার ১১০ হেক্টর জমি লবনাক্তায় রূপ নিয়েছে। আর ৪৬ হাজার ২৬ হেক্টর জমিতে কোন ফসলই হচ্ছে না। এছাড়া স্থায়ী পতিত জমি রয়েছে ৪৫ হাজার ১১০ হেক্টর। ফলে জেলার প্রায় ২৬ ভাগ ভুমিতে কৃষি কাজ করা যাচ্ছে না। দিনের পর দিন কৃষি জমি হ্রাসের ফলে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু সাতক্ষীরা জেলাতে ৬৭ হাজার ২৩০টি পরিবার ভুমিহীন হয়েছে। এছাড়া প্রান্তিক চাষি পরিবারের সংখ্যা এক লক্ষ ৩১ হাজার ৩৭টি পরিবার। জেলা কৃষি বিভাগ সূত্র এমন তথ্য জানায়। একই অবস্থা উপকূলীয় জেলা সমূহে।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি বিভাগ ও মৎস্য সম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, জেলাতে মোট বূমির পরিমাণ ৩৮১৭.৩০ বর্গ কিলোমিটার। হেক্টরে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৯ লক্ষ ৪২ হাজার ৮৭৩। এর মধ্যে জেলা কৃষি বিভাগের হিসাব মতে চলতি বছরে জেলাতে ৪৬ হাজার ২৬ হেক্টর জমি অনাবাদি রয়েছে। আর স্থায়ী পতিত জমি রয়েছে ৪৫ হাজার ১১০ হেক্টর। সাময়িক পতিত জমি আছে, ৯১৬ হেক্টর,জলাশয় রয়েছে ৬২,৪৯৪ হেক্টর,আবাস ভুমি ও অবকাঠামো ও স্থাপনা রয়েছে ১,৪১,৪২২ হেক্টর। সবমিলে জেলাতে ১ লক্ষ ৭৭ হাজার ৮১৪ হেক্টর আবাদি জমি রয়েছে।
অন্যদিকে জেলা মৎস্য বিভাগের হিসাব মতে চলতি বছরে জেলাতে লবানক্ত জমির পরিমান দাড়িয়েছে এক লক্ষ ৫৩ হাজার ১১০ হেক্টর। ফলে জেলাতে মোট ভূমির ২৫ দশমিক ৯০ ভাগ জমিতে কৃষি কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না।
এছাড়া সম্প্রতি তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে দুর্যোগের কবলে পড়েছে উপকূলীয় জেলা সমূহ। ফলে জ্ঞান ও মালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এর কারণে প্রতি বছর নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। আর সম্প্রতি সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় জেলা সমূহের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘুর্ণিঝড় আম্পানে কৃষিতে ক্ষতি হয়েছে হাজারো কোটি টাকা।
জলবায়ু সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়,গত শতাব্দীতে পৃথিবীতে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে ২৩%, নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে ১৯% এবং মিথেনের পরিমাণ বেড়েছে ১০০% । এই পরিবর্তনে জনসংখ্যার যে অংশটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন, তারা হচ্ছে দরিদ্র জনগোষ্ঠী। জেলা কৃষি বিভাগ সূত্র মতে শুধু সাতক্ষীরা জেলাতে ৬৭ হাজার ২৩০টি ভুমিহীন পরিবার রয়েছে। এছাড়া প্রান্তীক চাষী রয়েছে এক লক্ষ ৩১ হাজার ৩৭টি পরিবার।
সূত্র মতে বাংলাদেশের গড় বার্ষিক তাপমাত্রা গত ১৪ বছরে (১৯৮৫-১৯৯৮) মে মাসে ১ সে. এবং নভেম্বর মাসে ০.৫ সে. বৃদ্ধি পেয়েছে।গ্রীষ্মকালে সমুদ্রের লোনাপানি দেশের অভ্যন্তওে উপকূলীয় জেলা সমূহের প্রায় ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত নদীতে প্রবেশ করেছে।
বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্ট পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ২১০০ সন নাগাদ সাগর পৃষ্টের উচ্চতা ১ মি. উঁচু হতে পারে, যার ফলে বাংলাদেশের মোট আয়তনের ১৮.৩ অংশ নিমজ্জিত হতে পারে। ২০০৭ সনের ১৫ নভেম্বর প্রলয়ঙ্করী সাইক্লোন সিডর আক্রমণ করার মাত্র দুই বছরের মধ্যে শক্তিশালী সাইক্লোন নার্গিস ও আইলা এবং ২০১৩ সনে মে মাসে মহাসেন ও ২০২০ সালে ২০ পস ঘুণিঝড় আম্পাপনা আঘাত কৃষিকে বিপর্যস্ত করে তোলে।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়ছে এবং ২০৩০ সনে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১০-১৫ শতাংশ এবং ২০৭৫ সনে প্রায় ২৭ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিগত ২৫ বছরের আবহাওয়ার উপাত্ত থেকে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের গড় উষ্ণতা তেমন বাড়েনি। তবে আশঙ্কা করা হয় যে, ২০৩০ সন নাগাদ গড় তাপমাত্রা ১.০ ডিগ্রি, ২০৫০ সনে ১.৪ ডিগ্রি এবং ২১০০ সনে ২.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে। সাম্প্রতিককালে তাপমাত্রা না বাড়লেও উষ্ণ ও শৈত্যপ্রবাহের মাত্রা বেড়েছে। বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে শীতকালের ব্যাপ্তি ও শীতের তীব্রতা দুইই কমে আসছে।
লোনা পানির অনুপ্রবেশ উপকূলীয় জেলা সমূহের জন্য মারাতœক । ১৯৭৩ সনে ১৫ লাখ হেক্টর জমি মৃদ্যু লবণাক্ততায় আক্রান্ত হয়, যা ১৯৯৭ সনে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ লাখ হেক্টেরে। বর্তমানে এর পরিমাণ প্রায় ৩৫ লাখ হেক্টর।
২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনের তথ্য অনুসারে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে যা কৃষিজ উৎপাদনে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি অধিদপ্তরে পরিচালক কৃষিবিদ বাদল চন্দ্র বিশ্বাস জানান, কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মারাতœক ফেলেছে। লবানক্তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর পরও সরকার জলবায়ু মোকাবেলায় কৃষিতে বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়ে যাচ্ছে চাষীদের। অনাবাদি জমি চাষে আওয়তায় আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মেকাবেলায় সরকার দু’টি তহবিল গঠন করেছে। একটি হলো বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট (বিসিসিটি) এবং অন্যটি বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলিয়ান্স ফান্ড (বিসিসিআরএফ)। এই ফান্ডের পরিমাণ আরো বৃদ্ধি করে সবুজ জলবায়ুর উন্নয়ন ঘটিয়ে ভবিষ্যৎ কৃষিকে আরো শক্তিশাক্তী করতে
প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের দাবী জানিয়েছ সংশ্লিষ্টরা।