আবু সাইদ বিশ্বাস: সুন্দরবন অঞ্চল থেকে ফিরে: জলবায়ু পরিবর্তনে সমুদ্রের পানিতে মাত্রারিক্তভাবে লবনাক্ততার পরিমান বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে সমুদ্রের তলদেশের উচ্চতা বৃদ্ধ পাওয়ায় গত দেড় দশকে সুন্দরবনের বিভিন্ন জায়গায় ইতোমধ্যে ১/২ ফুট পানি বৃদ্ধ পেয়েছে। হুমকির মুখে পড়েছে জীব বৈচিত্র। সমুদ্র পৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সাগর বক্ষে জেগে উঠা নয়নাভিরাম তালপর্টি ইতোমধ্যে সাগর বক্ষে তলিয়ে গেছে। তাছাড়া গহীন সুন্দরবনে পশ্চিম বন বিভাগের মান্দারবাড়ীয়া কিছু অংশ পানিতে তলিয়ে গেছে। সুন্দরবনের ভেতরে ছোট ছোট নদী খালগুলোতে পলি জমে ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি প্রবাহ কমে গেছে। জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেয়ে নতুন নতুন এলাকা পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে বিচিত্র প্রাণী জগতের বিচরণ ক্ষেত্র। এখুনি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে বাংলাদেশ ও ভারতের পক্ষে সুন্দরবন রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাবে।
সুন্দরবন হলো বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রশস্থ বনভূমি যা বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলির অন্যতম। গঙ্গা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীত্রয়ের অববাহিকার বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত এই অপরূপ বনভূমি বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দুই জেলা উত্তর চব্বিশ পরগনা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জুড়ে বিস্মৃতি। সমদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অথন্ড বনভূমি।
ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তনে পৃথবীর বৃহত্তম এ ম্যানগ্রোভ বনের উদ্ভিদ মারা যাচ্ছে। জাতিসংঘের উন্নয়ন পরীক্ষার এক রিপোট সূত্রে জানা যায়, সংশিষ্ট বিষয়ে দ্রত পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে ১০ বছরের মধ্যে সমগ্র বনাঞ্চলের ১৫ শতাংশ তলিয়ে যাবে। ক্রমশ সংকীর্ন হচ্ছে দেশের মোট আয়তনের ৪.২ শতাংশ বনাঞ্চল। ফলে অবস্থার উন্নতি না হলে আগামী ২১০০ সালের মধ্যে সমগ্র সুন্দরবন অঞ্চলের শত ভাগ তলিয়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কা বিশেষ্ণদের। সূত্রমতে সমুদ্র্র পৃষ্টের উচ্চতা ১০ সে. মি বৃদ্ধি পেলে সুন্দরবনে ১৫ শতাংশ, ২৫ সে.মি. বৃদ্ধি পেলে ৪০ শতাংশ, ৪৫ সে.মি. বৃদ্ধি পেলে ৭৫ শতাংশ এবং ৬০ সে.মি. বৃদ্ধি পেলে সমগ্র সুন্দরবন পানিতে ডুবে যাবে।
পোল্যান্ডের কাটোভিসায় অনুষ্ঠিত গত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে এক রিপোর্টে দেখা যায় যে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা প্রাক শিল্পায়ন যুগের তুলনায় ১.৫ ডিগ্রী বাড়লেই সুন্দরবনের মত উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলি সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধির কারণে ভয়ঙ্কর বন্যার প্রকোপে পড়বে। যদি গড় তাপমাত্রা দুই ডিগ্রী বৃদ্ধি পায় সেক্ষেত্রে ভারত ও বাংলাদেশ জুড়ে থাকা বিস্তৃত সুন্দরবনের ওপর নিভর্রশীল বাস্তুতন্ত্রের উপর নির্ভরশীল এক কোটি ত্রিশ লক্ষ মানুষ বাস্তুহারা হবে।
লন্ডন স্থিত বাংলাদেশের জলবায়ু বিশেষজ্ঞ সালিমুল হক যিনি একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে যুক্ত। তিনি জানান, বাংলাদেশ এবং ভারতীয় সুন্দরবন জলবায়ু পরিবর্তনের তাৎক্ষনিক এবং দীর্ঘমেয়াদী ; দু ধরনের বিপদেই পড়তে পারে। সমুদ্রের তল বৃদ্ধ ও ফলত জলের চক্র পরিবর্তন এবং উপকূলবর্তী ভাঙ্গন ভয়ঙ্কর চেহারা নিতে পারে, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদী বিপন্নতা গভীর চিন্তার কারণ হতে চলেছে।
বাংলাদেশ সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিবেশ দফতরের তৈরি ‘জলবায়ু অ্যাকশন প্ল্যান’ এ ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদের কথা বলা হয়েছে । ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনডিপি) এর মহম্মদ শামসুদ্দিন এবং অন্যান্য দের তৈরি একটি গবেষণাপত্রে ক্লাইমেট চেঞ্জ ইমপ্যাক্টস অন সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেম সার্ভিস এন্ড ডিপেনডেন্ট লাইভলিহুডস ইন বাংলাদেশ দেখানো হয়েছে যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ২০০১ সালের তুলনায় ২১০০ সালে বাংলাদেশ সুন্দরবনে সমুদ্র পৃষ্ঠর উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করা হচ্ছে ও তার ফলে সুন্দরী এবং গেওয়ার মত সুন্দরবনের মূল বাদাবন প্রজাতিগুলি উল্লেখযোগ্যভাবে কমতে পারে। গবেষনাপত্রে দেখা গেছে যে এর ফলে মাছ চাষ, পর্যটন, জীববৈচিত্র্যর মতো বাস্ততন্ত্র নির্ভর বিষয়গুলি প্রভাবিত হতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, ১৯২৭ সালে বন আইনে বনজ সম্পদ আহরনের দিক নির্দেশনা থাকলে ও অন্যন্য জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাব সম্পর্কে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। ১৯৫৫ সালে নতুন নীতি মালা ঘোষিত হয়ে পরবর্তীতে ১৯৬২ সালে পুনরায় সংশোধিত হয়। কিন্তু এ দুটি নীতিমালায় বনজ সম্পদ রক্ষ্যায় স্পষ্টভাবে কিছুই বলা হয়নি। সর্বশেষ ১৯৭৯ সালে বননীতি মালা ও ছিল অস্পষ্ট। পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন সময়ে বন আইনে নীতিমালা সংশোধিত হলেও তা বনজ সম্পদ রক্ষ্যা, আহরণ ও জলবায়ু পরিবর্তনে বিরুপ প্রভাবে ধারনা ও ছিল অপযাপ্ত।
নিউইয়ক টাইমসের প্রতিবেদনে জানা যায়, প্রতিনিয়ত পোড়ানো হচ্ছে জীবাশ্ন জ্বালানী। বৃদ্ধি পাচ্ছে মাত্রারিক্ত কার্বন। বৃদ্ধি পাচ্ছে তাপমাত্রা বৈশ্বিক উঞ্চতা। মানব সৃষ্টি এসব কর্মকান্ডে দিন দিন ফুসে উঠছে সমুদ্র। আঘাত হানছে সামদ্রিক ঝড়, পরিবর্তন হচ্ছে জলবায়ু। এ জলবায়ু পরিবর্তনে চরম ঝুঁকির মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। আবহাওয়া বিজ্ঞানী ড. আতিক রহমান জানান, সমুদ্র পৃষ্টের উচ্চতা বাড়ার কারনে ২০৫০ সাল নাগাত বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ১৭ শতাংশ জমি তলিয়ে যাবে। বাস্তহারা হবে ১ কোটি ৮০ হাজার মানুষ।
এদিকে প্রতিবছর সুন্দরবনের দুবলার চরে নভেম্বর মাস ব্যাপি চলে একটি আয়োজন। বাংলাদেশসহ দেশবিদেশ থেকে অনেক পর্যাটক সেই উৎসবে অংশ নেয়। সেই উৎসবে দেশি-বিদেশি পূণ্যার্থী ও পর্যটকদের আড়ালে সুন্দরবনে ঢুকে পড়ে হরিণ শিকারি চক্র। প্রতি বছর এ সময়ে শতশত হরিণ শিকার করা হয়। সুন্দরবন বনবিভাগের দাবী তাদের নজরদারি বাড়ানোর কারণে সুন্দরবনে হরিণের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে করোনা কালিন সময়ে সুন্দরবনে পর্যটক প্রবেশে নিষেজ্ঞা থাকায় হরিণে বিচারণ বেড়েছে।
এদিকে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে গত ২০ বছরে নানা কারণে ৩৮ বাঘের মৃত্যু হয়েছে। বন বিভাগের সদস্যরা মাত্র সাড়ে ৫ মাসের ব্যবধানে দুটি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মৃতদহে উদ্ধার করেছে। বন বিভাগের তথ্য মতে, ২০০১ থেকে ২০২০ সালের ১০ জুলাই পর্যন্ত সুন্দরবন পূর্ব বিভাগে ২২টি এবং পশ্চিম বিভাগে ১৬টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। ২০১৮ সালের সর্বশেষ জরিপ অনুসারে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা ১১৪টি। তবে ২০২০ সালে এসে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা কমেছে না বেড়েছে সে সম্পর্কে জানাতে পারেনি বন বিভাগ। এর আগে গত বছরের ১৪ মে বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার গবেষকদের এক সমীক্ষায় সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছিল, সমুদ্রের স্তর এবং জলবায়ু পরিবর্তন ক্রমাগত বৃদ্ধি ফলে বিশেষত বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার আগামী ৫০ বছরের মধ্যে হারিয়ে যেতে পারে। একই অবস্থা অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রে।
সংশ্লিষ্টদের মতে সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী, বনজ ও জলজ সম্পদ রক্ষার সক্ষমতা নেই বন বিভাগের। জনবল, জলযান আর অস্ত্র সংকটের কারণে বনের বিশাল এলাকা পাহারা দিতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় বন বিভাগকে। বনে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে তাদের নির্ভর করতে হয় কোস্টগার্ড, র্যাব ও পুলিশের ওপর। সুন্দরবন রক্ষায় দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের দাবী জানানো হয়েছে।