মজুরি বৈষম্যের শিকার সাতক্ষীরাসহ উপকূলের লাখ লাখ নারী কৃষি শ্রমিক:১০ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি নারী উন্নয়ন নীতিমালা

আবু সাইদ বিশ্বাস: ক্রাইমবাতা রিপোট: সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় জেলা সমূহে কৃষিতে নারীদের সম্পৃক্ততা বাড়ছে। কৃজের পাশাপাশি পশুপালন, বনায়ন, মৎস্য, ক্ষুদ্র ও বৃহৎশিল্পের সঙ্গেও জড়িত তারা। চলতি মৌসুমে আমন ধান ক্ষেত থেকে কেটে ঘরে তুলতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেশি দৃশ্যমান হচ্ছে। পুরুষের তুলনায় নারী শ্রমিকের মজুরি কম হওয়ায় দিন দিন উপকুলীয় জেলাগুলোতে কৃষিতে পুরুষের চেয়ে নারী শ্রমিকের চাহিদা বাড়ছে। ফসলের বপন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে ফসল উত্তোলন, বীজ সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ এমন কি বিপণন পর্যন্ত বেশিরভাগ কাজ উপকূলীয় অঞ্চলের নারীরা এককভাবেই করে আসছে। নারীদের অভিযোগ পুরুষের সমান কাজ করলেও তারা মজুরি বৈষ্যম্যের শিকার। তারা পুরুষের তুলনায় অর্ধেক মজুরি পান। যদিও সাতক্ষীরা জেলাতে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেশি। বর্তমানে দেশে নারী শ্রমশক্তির মধ্যে ৬৮ শতাংশই কৃষির সাথে জড়িত। ফসল উৎপাদনের ২১টি ধাপের ১৭টিতেই নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ রয়েছে। উপকূল জনপদেও এসব নারী-অবহেলা, বৈষম্য আর নির্যাতনের শিকার ভাগ্য বিড়ম্বিত এক জীবন। যে জীবনে সংকট নিত্যদিনের, নেই সমাধান। দুর্যোগ-দুর্বিপাকে স্বামীর অনুপস্থিতিতে সংসারের বোঝা চাপে নারীর ওপর। পুরুষবিহীন সংসারে নারী হয়ে ওঠেন পরিবারের প্রধান। অথচ কোথাও নেই এতটুকু স্বীকৃতি।

চলতি বছরে বিবিএসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে মোট কর্মোপযোগী মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ৯১ লাখ। এর মধ্যে কর্মে নিয়োজিত ছয় কোটি আট লাখ মানুষ। এদের মধ্যে কৃৃষিক্ষেত্রে আছেন দুই কোটি ৪৭ লাখ, শিল্পে এক কোটি ২৪ লাখ এবং সেবা খাতে দুই কোটি ৩৭ লাখ মানুষ। শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে নারী শ্রমশক্তির মধ্যে ৬৮ শতাংশই কৃষি, বনায়ন ও মৎস্য খাতের সঙ্গে জড়িত।

২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশে কৃষি, বন ও মৎস্য, পশুপালন, হাঁস-মুরগি পালন, মাছ চাষ, কৃষিকাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৩৭ লাখ, বর্তমানে তা প্রায় ৮০ লাখ হয়েছে। যদিও এসব নারী শ্রমিকের ৭২ শতাংশই অবৈতনিক পারিবারিক নারী শ্রমিক। বর্তমানে পেশা বদলের কারণে কৃষি, বন ও মৎস্য খাতে পুরুষ শ্রমিকের অংশগ্রহণ কমেছে ১০ দশমিক চার শতাংশ। কৃষি ও এর উপখাতের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে নারী। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পরিসংখ্যানে নারীর এ উপস্থিতির কোনো হিসাবে স্বীকৃতি নেই। এমনকি কৃৃষিকাজে জড়িত এ বিপুলসংখ্যক নারী শ্রমিকের তেমন কোনো মূল্যায়নও করা হয়না।

তাদের অভিযোগ কৃষি উপকরণ, সার, বীজ, কৃষক কার্ড ও ঋণের বেশিরভাগ সুবিধা পুরুষ কৃষক পান । কোনো কোনো ক্ষেত্রে নামমাত্র মজুরি দেওয়া হয়। ভূমির মালিকানা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষের হাতে। বাজার নিয়ন্ত্রণ কমিটিতেও কোনো নারী সদস্য নেই।

আইন প্রণয়ন এবং তা সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমেই কেবল টেকসই কৃষি ব্যবস্থার পাশাপাশি কৃষক ও কৃষি শ্রমিক উভয়ের স্বার্থরক্ষা জরুরি। কৃষিনির্ভও অর্থনীতির দেশে কৃষিকে যেমন উপেক্ষা করা যায় না, তেমনি এ খাতে নারীর অবদানকেও অস্বীকার করার উপায় নেই। কৃষি খাতে নিয়োজিত নারী শ্রমিকের স্বীকৃতি ও ন্যায্য মজুরি প্রদান নিশ্চিত করতে পারলে দেশের কৃষি উৎপাদন কাজে নারীরা উৎসাহ পাবে। এর ফলে কৃষি খাতের উৎপাদন বাড়বে, জিডিপিতে কৃষির অবদানও বাড়বে।

১৯৯৫ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে নারী উন্নয়নের সামগ্রিক রূপরেখা হিসেবে বেইজিং ঘোষণা ও প্ল্যাটফর্ম ফর অ্যাকশন গৃহীত হয়। এর মূল লক্ষ্যÑঅর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে পূর্ণ এবং সমঅংশীদারিত্বের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত জীবনের নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণের পথে বাধাগুলো দূর করা। এরই আলোকে ২০১১ সালে বাংলাদেশে নারী উন্নয়ন নীতি প্রণীত হয়।

নীতিমালায় ২৩ দশমিক ১০ জাতীয় উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে কৃষি ও গার্হস্থ্য শ্রমসহ সব নারী শ্রমের সঠিক প্রতিফলন মূল্যায়ন নিশ্চিত করা, ৩১ দশমিক এক জাতীয় অর্থনীতিতে নারী কৃষি শ্রমিকের শ্রমের স্বীকৃতি প্রদান করা, ৩১ দশমিক তিন কৃষিতে নারী শ্রমিকের মজুরি বৈষম্য দূরীকরণ এবং সমকাজে সমমজুরি নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা। নারী উন্নয়ন নীতি মালার ১০ বছর অতিবাহিত হলেও তার যথাযথ সুফল পায়নি নারীরা।

বাংলাদেশ সংবিধানে ২৮নং অনুচ্ছেদে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব নাগরিকের সমান অধিকারের নিশ্চয়তার কথা বলা হয়েছে। কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণের ফলে একদিকে যেমন দেশের খাদ্য নিরাপত্তা বাড়ছে, অন্যদিকে মাথাপিছু আয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

কৃষি বিশেজ্ঞরা বলেন, কৃষি খাতকে গতিশীল করতে হলে গ্রামিণ কৃষানিদের প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ বাড়াতে হবে হবে, যাতে তারা সহজেই কৃষিসংক্রান্ত তথ্য মোবাইলের মাধ্যমে পেতে পারেন। প্রণোদনা হিসেবে কৃষক কার্ডের মাধ্যমে সরকারের সহায়তা নিয়ে তা সঠিক বাস্তবায়ন করতে পারলেই নারীরা কৃৃষিতে নতুন বিপ্লব ঘটাতে পারবেন। নারী কৃষকের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা সময়ের দাবী।

অন্য দিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত বাংলাদেশ শ্রমশক্তি বিষয়ক এক জরিপ বলছে, কৃষি অর্থনীতিতে গ্রামীণ নারীর অবদান ৬৪.৪ শতাংশ এবং পুরুষের অবদান ৫২.৮ শতাংশ। বিবিএসের অপর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক দশকের ব্যবধানে দেশের কৃৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে ১০২ শতাংশ । ২০০০ সালে দেশের কৃৃষিতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৩৮ লাখ। ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ৫ লাখে। প্রতিবেদন বলছে, ১০ বছরের মধ্যে প্রায় ৭০ লাখ নারী কৃষিতে যুক্ত হয়েছেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর মতে ২০১১ সালের জরিপে সাতক্ষীরা জেলা মোট জনসংখ্যা ছিল ১৯ লক্ষ ৮৫ হাজার ৯৫৯ জন। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ১০ লক্ষ ৩ হাজার ১৮২ জন এবং পুরুষের সংখ্যা ৯ লক্ষ ৮২ হাজার ৭৭৭ জন। সাতক্ষীরা জেলা পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে বর্তমানে জেলাতে পুরুষ ও মহিলার সংখ্যা ২৩ লাখের বেশি। জেলায় প্রায় ৪ লক্ষ নারী বছরের বিভিন্ন সময়ে শ্রম বিক্রি করে থাকেন।

নারীদের পণ্য বিক্রির জন্য আলাদা বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা, বিভিন্ন বৈষম্য দূর করা, নারীবান্ধব পরিবেশ এবং তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারে বিক্রির জন্য পৃথক জায়গা প্রদান করা কৃষিতে জড়িত নারীদের দীর্ঘদিনের দাবি।

নারী কৃষকের অধিকার সুরক্ষায় কৃষি অধিকার কর্মীরা বলেন, কৃষিতে কর্মরত নারীদের কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে, ভূমিতে নারী কৃষকের মালিকানা নিশ্চিত করতে হবে, সরকারি নীতিমালায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি, বর্গা চাষি, নারী কৃষকের সংজ্ঞা থাকতে হবে এবং বাজার ব্যবস্থায় নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে। নারীদের অবদানকে অর্থনৈতিক মানদন্ডে ফেলে জাতীয় আয়ে তাদের অবদান তুলে ধরতে হবে। কৃষি শ্রম আইন ও একটি কৃষি কমিশন প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের প্রতি তারা দাবি জানান।

শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান বলেন, কৃষির উন্নয়ন ও কৃষি অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে নারী কুষি শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রাধিকার দিয়েছে সরকার। বাংলাদেশ পূর্ণাঙ্গ মধ্যম আয়ের দেশের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। নারীদের অধীকার রক্ষায় বর্তমান সরকার কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। নারীদের প্রতি বৈষম্য কমাতে যা যা করণীয় সরকার তাই করবে।

 

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।