মৎস্য চাষে সাতক্ষীরায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন:জেলার চাহিদা মিটিয়ে ৮১ হাজার মেট্রিক টন মাছ রপ্তানি

আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা : চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি থাকায় সাতক্ষীরা মৎস্য সম্পদ বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। দিনের পর দিন জেলায় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখান কার প্রধান পেশা কৃষির পরই মাছের অবস্থান। প্রায় ১০ লক্ষ নারী ও পুরুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে মাছ চাষের উপর নিরর্ভরশীল। চাষীরা বলছে মৎষ্য উৎপাদনে সাতক্ষীরায় যেন নীরব বিপ্লব চলছে। জেলার জনগোষ্ঠীর চাহিদা মিটিয়ে চলতি বছর অতিরিক্ত ৮১ হাজার মেট্রিক টন মাছ দেশের অন্যান্য জেলাসহ বিদেশেও রপ্তানি করা হয়েছে। মৎস্য ক্ষেত্রে বিনিয়োগের ফলে জেলাতে একদিকে যেমন নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি সমৃদ্ধি হয়েছে জেলার অর্থনীতি। সব মৎস্য চাষিদের প্রশিক্ষণের আওয়তায় অনতে পারলে জেলায় মৎস্য উৎপান বৃদ্ধি পাবে কয়েকগুণ বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

বর্তমানে মৎস্য খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের প্রায় ১১ শতাংশ মানুষ জড়িত থাকলেও সাতক্ষীরা জেলাতে মৎস্য খাতে প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ জড়িত দাবী সংশ্লিষ্টদের। মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, বিশ্বজুড়ে মানুষের মাছ খাওয়া বেড়েছে ১২২ শতাংশ। বিশ্বের সাতটি দেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের অর্ধেকের বেশি আসে মাছ থেকে। বাংলাদেশ প্রাণিজ আমিষের ৫৮ শতাংশ আসে মাছ থেকে। ২০১০ সালের সর্বশেষ খানা জরিপে উঠে এসেছে- বছরে বাংলাদেশে একেকজন মানুষ প্রায় ১২ কেজি মাছ খায়। এখন সেটা ৩০ কেজিতে পৌঁছেছে। দেশের জিডিপিতে কৃষির অবদান ১৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ যার এক-চতুর্থাংশ অবদান এককভাবে মৎস্য খাতের। আবার সার্বিক কৃষি খাতের গড় প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৯২ শতাংশ হলেও মৎস্য খাতে প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে ৬ শতাংশের উপরে রয়েছে।

বিশ্বে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধিতে ২০১৯ সালে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। গত বছর রেকর্ড পরিমাণ মাছ উৎপাদন হয়েছে দেশে। স্বাদুপানির মাছ উৎপাদনে তৃতীয় স্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার ২০২০’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য ওঠে এসেছে। যার অপার সম্ভাবনাময় সাতক্ষীরার মৎম্য খাত ও সমুদ্রম্পদ।

সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অফিস সূত্র জানায়,২০১৮-১৯ অর্থবছরে জেলায় এক লাখ ২৬ হাজার ৭৫৫ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়। যেখানে জেলায় মাছের চাহিদা রয়েছে ৪৫ হাজার ৫৪৮ মেট্রিক টন। অর্থাৎ উদ্বৃত্ত ৮১ হাজার ২০৭ মেট্রিক টনের মধ্যে একাংশ বিদেশে রপ্তানি এবং অবশিষ্ট মাছ দেশের অন্যান্য এলাকায় সরবরাহ করা হয়।

সূত্র জানায় বর্তমানে জেলাতে ৫০ হাজার ১৮টি পুকুরে কার্পজাতীয় মাছের চাষ হচ্ছে। এছাড়া জেলায় ১ লক্ষ ৫৩ হাজার ১১০ হেক্টও লবনাক্ত জমিতে চিংড়ি চাষ হচ্ছে। জেলাতে মৎস্য হ্যাচারি রয়েছে ২৫টি,মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা রয়েছে ৪টি,মৎস্য আড়ৎ রয়েছে ৩২টি। এছাড়া ২৮৫টি মৎস্য ডিপো, ৪৪টি বরফকল, ১৫টি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র এবং ৫৮টি পাইকারী মৎস্য বিপণন কেন্দ্রের মাধ্যমে সারা বছর মাছ বাজারজাত করা হয়।

জেলা মৎস্য বিভাগের বিভিন্ন তথ্য উপাত্তে দেখা যায়, সাতক্ষীরার চিংড়ি বিদেশে রপ্তানির বাজার দখল করেছে। এখানে উৎপাদিত হচ্ছে সব ধরনের সুস্বাদু সাদা মাছ। চিংড়ির পাশাপাশি কৈ, মাগুর, শিং, শোল, পাঙ্গাস, মনোসেক্স তেলাপিয়া,কার্পজাতীয় মাছ ছাড়াও জেলাব্যাপী কাঁকড়া ও কুচিয়ার চাষ ছড়িয়ে পড়েছে। জেলার ৫৫ হাজার ১২২টি বাগদা চিংড়ি ঘের ও ১১ হাজার ৬৩৮ টি গলদা চিংড়ি ঘেরের এক চতুর্থাংশে আধা নিবিড় ও নিবিড় চিংড়ি চাষ করা গেলে জেলার চিংড়ি উৎপাদন ৮ থেকে ১০ গুণ বেড়ে যাবে বলে জানানো হয়। বেসরকারি হিসাবে বাগদা ও গলদা চিংড়ি ঘেরের সংখ্যা আরো বেশি। এসব ঘেরের মিষ্টি পানিতে ধান ও মাছ এক সাথে চাষ করা গেলে সাতক্ষীরায় মৎস্য উৎপাদনে বৈপ্লবিক উন্নয়ন হতে পারে এ খাতে সংশ্লিষ্টদের দাবি।
সূত্র জানায় জেলায় বাগদা ও গলদা পোনার চাহিদা প্রায় সাড়ে ৩৪৪ কোটি। এর মধ্যে বাগদা পোনার চাহিদা ৩৩৪ কোটি এবং গলদা পোনার চাহিদা ১০ কোটি ৫৫ লক্ষ।

জানা যায়, চলতি ২০১৯-২০ মৌসুমে সাতক্ষীরার সাতটি উপজেলাতে নিবন্ধিত ৪৯ হাজার ১৭৫ জন নিবন্ধিত জেলৈ রয়েছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা সদর উপজেলাতে দুই হাজার ১০৫টি, তালায় এক হাজার ২৯৫টি, দেবহাটায় দুই হাজার ৮২৯টি, আশাশুনিতে ১৩ হাজার ২১৭টি, কালিগঞ্জে ১৪ হাজার ৫৫৯টি ও শ্যামনগরে ১৩ হাজার ১৫৮ এবং কলারোয়াতে দুই হাজারটি।

সূত্র জানায়, জেলায় ৮১ হাজার ৪৩২জন মাছ চাষি রয়েছে। মৎস্য খাতকে আরো উন্নত করে তুলতে জেলার ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ জমির মালিককে প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে তাদের মাছ চাষে আগ্রহী করে তুযলতে জেলা মৎস্য বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে।

কৈ , মাগুর , শিং, শোল, পাঙ্গাস, মনোসেক্স তেলাপিয়া ছাড়াও জেলাব্যাপী কাঁকড়া ও কুচিয়ার চাষ ছড়িয়ে পড়েছে। জেলার ৫৪ হাজার ৯৩৫ টি বাগদা চিংড়ি ঘের ও সাড়ে ১১ হাজার গলদা চিংড়ি ঘেরের এক চতুর্থাংশে আধা নিবিড় ও নিবিড় চিংড়ি চাষ করা গেলে জেলার চিংড়ি উৎপাদন ৮ থেকে ১০ গুণ বেড়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। বেসরকারি হিসাবে বাগদা ও গলদা চিংড়ি ঘেরের সংখ্যা আরো বেশি। এসব ঘেরের মিষ্টি পানিতে ধান ও মাছ এক সাথে চাষ করা গেলে সাতক্ষীরায় মৎস্য উৎপাদনে বৈপ্লবিক উন্নয়ন হতে পারে বলেও জানানো হয়।

সাতক্ষীরার তালার খলিখখালির মঙ্গলানন্দাকাটী গ্রামের মাছচাষি মুক্তাদির শেখ (লিমন) জানান, ১৬ বিঘা জমিতে মিশ্র কার্প জাতীয় মাছ চাষ করেছেন। ঘেরে ভাইরাসের আক্রান্ত না হলে ৬ লক্ষ টাকার মাছ বিক্রি করতে পারবে। এতে তার দুই থেকে তিন লক্ষ টাকা লাভ থাকতে পারে। আধুনিক পদ্ধতিতে সে মাছ চাষ করে। যে কারণে তার ঘেরে মাছের রোগ ব্যাধি কম হয়। তার দাবী সব মৎস্য চাষিদের প্রশিক্ষণ নেওয়ার ব্যবস্থা করলে মাছের উৎপাদন বাড়বে।

শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জবাজারের নিয়মিত মাছ বিক্রি করেন দাতিনা খালির আব্দুস সাত্তার। তিনি জানালেন,চাষিদের প্রশিক্ষণ দেয়া,মৎস্য বিভাগের তদারকি বাড়ানো সহ মৎস্য খাদ্যের দাম একটু কমলে মৎস্য চাষে লাভবান হবে চাষিরা।

এদিকে মৎস্য সপ্তাহ উপলক্ষ্যে জেলাতে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি করি সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়ি’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে চাষিদের উৎসাহ প্রদান করা হচ্ছে। এর মধ্যে ২৩ জুলাই মাছে ক্ষতিকর রাসায়নিক প্রয়োগ বিরোধী অভিযান, ২৪ জুলাই মৎস্য চাষিদের মাছ চাষ বিষয়ক নিবিড় পরামর্শ সেবা প্রদান,পুকুরের মাটি পানি পরীক্ষা, ২৫ জুলাই মৎস্য সেক্টরে অগ্রগতি ও সাফল্য বিষয়ে নির্মিত প্রামান্যচিত্র প্রদর্শণ, ২৬ জুলাই চাষি/সুফলভোগিদের মাঝে মাছ চাষের বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ করা হবে।

মো. মশিউর রহমান জানান, দেশি মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। পুকুরে মাছ চাষের কারণে গত তিন দশকে জেলাতে মোট উৎপাদন বেড়েছে ছয় থেকে সাত গুণ। জেলা মৎস্য বিভাগ নদী ও জলাশয়ে মাছের পরিমাণ এবং তার কতটুকু আহরণ করা যাবে, তা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। বিলুপ্তপ্রায় মাছগুলো পুকুরে চাষের বিষয়েও কাজ করছি।

 

Check Also

আশাশুনি সদর ইউনিয়ন জামায়াতের ৮টি ওয়ার্ডে আংশিক কমিটি গঠন

এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি প্রতিনিধি।।বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আশাশুনি সদর ইউনিয়নের ৮টি ওয়ার্ডে আংশিক কমিটি গঠন করা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।