আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা : সবজির দাম কমে যাওয়ায় হাজার হাজার টন সবজি ক্ষেতে নষ্ট হচ্ছে। ক্ষেত থেকে সবজি তুলে বাজারে বিক্রি করে পরিবহন খরচ উঠছে না। সাতক্ষীরাসহ ‘ভেজিটেবল জোন’অঞ্চলে সব ধরণের সবজি বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি মাত্র ১০ টাকায়। ‘ভেজিটেবল জোন’ সাতক্ষীরা, যশোর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, বগুড়া, রংপুর, কুমিল্লা, নরসিংদী, মেহেরপুর, রাজবাড়ি, ফরিদপুর ও দিনাজপুরসহ দেশের পাইকারী বাজারের সকজিতে সয়লাভ। হিমাগার না থাকায় সংরক্ষণের অভাবে প্রছির সবজি এসব সবজির এক-চতুর্থাংশই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সরবরাহের তুলনায় চাহিদা কম থাকায় এবছরও কোটি কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা করছে চাষিরা।
কৃষকরে অক্লান্ত পরিশ্রম আর নিবিড় চাষের মাধ্যমে বাংলাদেশ সবজি উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে উন্নীত হয়েছে। সবজি উৎপাদন বেড়ে ১ কোটি ৭২ লাখ ৪৭ হাজার মেট্রিক টন হয়েছে। আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ উদ্বৃত্ত এবং বিশ্বে সপ্তম। খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশে নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে চলৈছে চাষির। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি জনসংখ্যার বিপরীতে খাদ্য উৎপাদন ছিল মাত্র ১ কোটি ১০ লাখ টন। বর্তমানে বাংলাদেশে বার্ষিক খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ ৪ কোটি টনের কিছু বেশি। দেশের মোট জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পাওয়া, কৃষিজমির পরিমাণ প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ হ্রাস পাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থাকার পরও খাদ্য উৎপাদনে এই সাফল্য কল্পনাতীত। বর্তমানে বাংলাদেশে খাদ্যশস্য উৎপাদিত হচ্ছে স্বাধীনতার পরের সময়ের চেয়ে তিন গুণ বেশি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যমতে, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়, ধান আর মাছ উৎপাদনে চতুর্থ, আলু উৎপাদনে সপ্তম এবং আম উৎপাদনেও বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের শীর্ষদশে। বাংলাদেশের কৃষি খাতে সবচেয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে একই জমিতে বছরে একাধিকবার ফলন সম্ভব করেছে কৃষকরা। মাত্র দুই যুগ আগেও যেখানে দেশের অর্ধেক জমিতে বছরে একবার এবং বাকি অর্ধেক জমিতে বছরে দু’বার ফলন হতো সেখানে এখন দেশের আবাদযোগ্য প্রায় সব জমিতেই বছরে গড়ে দু’বার ফলন সম্ভবপর হচ্ছে। বাংলাদেশের কৃষিতে এই পরিবর্তনের মূল কৃতিত্ব কৃৃষি গবেষকদের এবং তা বাস্তবায়নে ভূমিকা রেখেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও মাঠের কৃষকরা।
সরকারি হিসাবে, বছরে দেশে সবজির চাহিদা এক লাখ ৬২ হাজার মেট্রিক টন। ২০১৯-২০ অর্থবছর দেশে বিভিন্ন প্রকার সবজি উৎপাদন করা হয়েছে এক লাখ ৭২ হাজার মেট্রিক টন। চাহিদার তুলনায় ১০ লাখ মেট্রিক টন সবজি বেশি উৎপাদন করা হলেও দামের ক্ষেত্রে স্বস্থি পায়নি দেশের সাধারণ মানুষ। অপরদিকে বেশি উৎপাদনের ফলে কৃষকও তার উৎপাদন খরচ পান না। এতে একদিকে কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের সঠিক দাম পাচ্ছেন না, অপরদিকে উৎপাদিত সেসব সবজি সাধারণ ক্রেতাদের মাত্রাতিরিক্ত দামে কিনতে হচ্ছে। এর ফলে কৃষক ও ক্রেতা উভয়ই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। মাঝখান থেকে ফায়দা লুটে নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশে দু’টি মৌসুমে সবজি আবাদ হয় ৭ লাখ ১২ হাজার হেক্টর জমিতে। মোট উৎপাদন হয় ১ কোটি ৬০লাখ মেট্রিটন। এর মধ্যে বড় অংশই হয় শীতকালে। এবার শীতকালীন সবজি উৎপাদনের টার্গেট ছিল সাড়ে ৫ লাখ হেক্টর জমিতে। বাংলাদেশে ৬০ ধরনের ২০০ জাতের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। প্রায় দেড় কোটি কৃষক সবজি চাষের সঙ্গে জড়িত। চলতি মৌসুমে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ৫ জেলায় ৫৪ হাজার ৪৮৯ হেক্টর জমিতে সবজির আবাদ হয়েছে। উত্তর অঞ্চলে ১২ হাজার ৯শ’ হেক্টর জমিতে সবজির আবাদ হয়েছে আর দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ৫২ হাজার হেক্টর জমিতে ১১ লাখ টন শীতকালীন সবজি উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। শুধু সাতক্ষীরা জেলাতে সবজির আবাদ হয়েছে ৯ হাজার ৫শ হেক্টর জমিতে। উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা প্রায় ২ লক্ষ মে:টন।
শুক্রবার সাতক্ষীরার বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, শিমের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২০- টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল ৪০ থেকে ৫০ টাকা। আর দুই সপ্তাহ আগে ছিল ১০০ টাকা কেজি। শিমের পাশাপাশি শীতের অন্যতম সবজি ফুলকপি ও বাঁধাকপির দামও কমেছে। মাঝারি সাইজের ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ টাকার মধ্যে, যা গত সপ্তাহে ছিল ৩০ থেকে ৫০ টাকা। বাঁধাকপি বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ৮ থেকে ১০ টাকার মধ্যে, যা গত সপ্তাহে ছিল ২০ থেকে ৩০ টাকা। দুই সপ্তাহ আগে ৪০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া মূলা এখন ৫ থেকে ৭ টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। বেগুন বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকার মধ্যে। সব সবজির বিক্রি একই অবস্থা। সরেজমিনে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ফিংড়ী,ফয়জুল্যাপুর,জোড়দিয়া,কুলতিয়া, আগরদাড়ি,গোবরদাড়ী, এলাকার মাঠ সবজিতে ভরপুর। চাষিরা জানান,হঠাৎ সব ধরণের সবজির দাম কমে গেছে। এতে মাঠ থেকে সবজি বাজারে বিক্রি করে ভাল দাম পাব না। বাজারে পাইকারী ব্যবসায়ীরা যে দাম দিচ্ছে তাতে যাতায়াত ভাড়া উঠা কঠিন হয়ে পড়েছে বলে চাষিরা জানান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে একদিকে মানুষ এখনো নিত্য আহার্য খাবারগুলোর মধ্যে ভাত ছাড়া বাকি কোনো খাদ্য পর্যাপ্ত পরিমাণে খাচ্ছে না। সবচেয়ে কম খাওয়া হচ্ছে ফল, সবজি আর দুধ; যদিও এই মুহূর্তে দেশে এ ধরনের খাবারের সংকট নেই বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) গবেষণার ফল অনুসারে, কৃষিজাত ফসলের ক্ষেত কিংবা প্রাণিজ উৎসর খামার থেকে শুরু করে বিভিন্ন খাদ্যপণ্য মানুষের মুখে যাওয়ার পথে ধাপে ধাপে নষ্ট ও অপচয় হয়। সঠিক
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে দেশের হাওর ও দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় কৃষকের জন্য ৭০শতাংশ এবং অন্যান্য এলাকার জন্য ৫০ শতাংশ হারে কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ভর্তুকি প্রদান করা হচ্ছে। এসডিজি ২০৩০, রূপকল্প ২০২১ এবং রূপকল্প ২০৪১ এর আলোকে জাতীয় কৃষিনীতি,৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট, ডেল্টাপ্লান: ২১০০ এবং অন্যান্য পরিকল্পনা দলিলের আলোকে সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
কৃষি বিপণন অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহম্মদ ইউসুফ জানিয়েছেন, মূল্য বৃদ্ধির অস্বাভাবিক প্রবণতা ঠেকাতে চাল ও আলুর পর এবার বাজারে সবজির দরও নির্ধারণ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। দাম নির্ধারণ করে দিলে বাজারে এসব পণ্যের দাম আর অস্বাভাবিক হবে না বলে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ মনে করছে।
Check Also
সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ডের উদ্যোগে সভা অনুষ্ঠিত
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ড (রাজারবাগান ও সরকারপাড়া ইউনিট) এর উদ্যোগে …