অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখর দেশ

  • প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ করছে

বিশ্বের বিভিন্ন শীতপ্রধান দেশ থেকে কয়েক হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসছে অতিথি পাখি। শীতের তীব্রতা যত বাড়ছে দেশে অতিথি পাখি আগমনের হার ততই বাড়ছে। দৃষ্টিনন্দন এসব পাখির কলকাকলিতে মুখর এখন সারাদেশের হাওড়, বাঁওড়, বিল, ঝিল, নদী, দীঘি, লেক, চরাঞ্চল, সমুদ্র উপকূল ও নৈসর্গিক পাহাড়ী জনপদ। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ করতে আসা অতিথি পাখির কলকাকলি, জলকেলি, আকাশে দল বেঁধে নীল দিগন্তে উড়ে বেড়ানোর দৃশ্য আনন্দ জোগাচ্ছে সব বয়সী পর্যটকদের। এ সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে বিদেশীরাও ছুটে যান পাখিবহুল বিভিন্ন গন্তব্যে। সরকারী ব্যবস্থাপনায় দেশের বিভিন্ন জলাশয়কে অতিথি পাখির অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তুলতে নেয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। তবুও বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে অতিথি পাখিদের নিরাপত্তার অভাব। সুযোগসন্ধানী কিছু মানুষ নানা কৌশলে অতিথি পাখি শিকার করে বাজারে ভোজনবিলাসীদের কাছে চড়া দামে বিক্রি করে। তবে শিকার বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শাস্তিসহ নানামুখী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

অতিথি পাখিকে পরিযায়ী পাখি, দেশান্তরি পাখি ও মাইগ্রেটরি বার্ডও বলা হয়ে থাকে। শীতকালে আমাদের দেশে আসে বলে কেউ কেউ এদের শীতের পাখিও বলে। প্রতিবারের মতো এবারও হিমশীতল সাইবেরিয়া, কাস্পিয়ান, মঙ্গোলিয়া, চীনের জিনজিয়ান, ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল, উত্তর আমেরিকা, রাশিয়া ও হিমালয় পাদদেশসহ শীতপ্রধান অঞ্চলে তীব্র শীত পড়ছে। ওইসব অঞ্চলে এখন দিন-রাতের অধিকাংশ সময়ই তাপমাত্রা থাকছে মাইনাস যা পাখিদের জন্য সহ্যসীমার বাইরে। এ ছাড়া এসব অঞ্চলে সবকিছু বরফে ঢাকা পড়ায় পাখিদের চরম খাদ্যসঙ্কট দেখা দেয়। অতিথি পাখিরা হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত তিব্বতের লাদাখ থেকে সেন্ট্রাল এশিয়ান ইন্ডিয়ান ফ্লাইওয়ে দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ক্ষুধা ও অসহনীয় শৈত্যপ্রবাহের ধকল সইতে না পেরে একটু উষ্ণতার খোঁজে কয়েক হাজার মাইল উড়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ঠাঁই নিচ্ছে প্রায় ৩০০ প্রজাতির অতিথি পাখি।

পাখি বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে নবেম্বর মাস থেকেই সীমিত সংখ্যায় অতিথি পাখি আসা শুরু হয়েছে। জানুয়ারি পর্যন্ত আসবে। তবে সবচেয়ে বেশি আসবে ডিসেম্বরের শেষ দিকে। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জলাশয় ও বনে-জঙ্গলে অবস্থান নিয়ে উড়াউড়ি শুরু করেছে। আরও কিছুদিন অতিবাহিত হলে পাখির আগমন আরও বাড়বে। তখন দেশের হাওড়, বাঁওড়, উপকূল ও চরাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকার জলাশয়গুলো নানা প্রজাতির বাহারি অতিথি পাখির মিলনমেলায় পরিণত হবে। ভোর থেকে শুরু করে রাত হওয়ার আগ পর্যন্ত পাখির কিচিরমিচির ও কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠবে। কোন কোন অতিথি পাখি রাতেও খাদ্যসংগ্রহের জন্য অবাধে বিচরণ করে এবং মধুর সুরে ডাকাডাকি করে। এর ফলে প্রকৃতিও সাজে নবরূপে। রাজধানীতে চিড়িয়াখানার লেক ও ঢাকার অদূরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও আড়িয়াল বিলে নবেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত অতিথি পাখি আসে। হাওড়সহ গ্রামবাংলার বিভিন্ন জলাশয়ের পানিতে লাল শাপলার মাঝে জলকেলিতে মেতে ওঠে অসংখ্য পাখি। এদের দুরন্তপনা দেখে মনে হয় বাংলাদেশই যেন এদের আপন নিবাস। মার্চ থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে অধিকাংশ অতিথি পাখি চলে যায় নিজ নিজ দেশে।

বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. ফিরোজ রহমান জানান, অতিথি পাখি প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে। প্রতিবছর বিভিন্ন দেশ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অতিথি পাখি আমাদের দেশে এসে প্রাকৃতিক পরিবেশকে সমৃদ্ধ করে। আরও আগে থেকে আসা শুরু হয়েছে। তবে ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে বেশি আসে। দেশে এখন অতিথি পাখির বেশ কটি অভয়ারণ্য রয়েছে। তবে কোথাও কোথাও বিশেষ করে উপকূলাঞ্চলে এদের শিকার করে। লোকালয় থেকে দূরে থাকায় শিকারিরা এ সুযোগ পায়। তবে মানুষ এখন আগের চেয়ে সচেতন হওয়ায় দেশের অধিকাংশ এলাকায়ই এখন আর পাখি শিকার করা যায় না। বন বিভাগের অপরাধ দমন ইউনিট অতিথি পাখির নিরাপত্তা রক্ষায় কাজ করে। কেউ অভিযোগ করলে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুসারে অপরাধ দমন ইউনিট শাস্তির ব্যবস্থা করে। তবে অতিথি পাখির নিরাপত্তা রক্ষায় মিডিয়া ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে আরও তৎপর হতে হবে।

অতিথি পাখি প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি পর্যটকদেরও আকর্ষণ করে। বিনোদনের জন্য প্রতিবছরই দেশী-বিদেশী পর্যটকরা ছুটে যায় অতিথি পাখিবহুল বিভিন্ন এলাকায়। এবার করোনা পরিস্থিতিতেও হাজার হাজার পর্যটক ছুটে যাচ্ছেন অতিথি পাখির উড়াউড়ি ও কলকাকলিতে আত্মতৃপ্তি পেতে। ডিসেম্বরের শেষ দিকে পর্যটকদের আনাগোনা আরও বাড়বে। গত কবছর অতিথি পাখির আগমন তেমন বেশি না হলেও পাখি বিশেষজ্ঞদের ধারণা এবার প্রাকৃতিক পরিবেশ তুলনামূলক ভাল থাকায় অতিথি পাখির আগমন বৃদ্ধি পাবে এবং তারা স্বস্তিতে বিচরণ করবে। বাংলাদেশে পাখির প্রজাতির সংখ্যা ৬৫০। এর মধ্যে অতিথি পাখির প্রজাতি ৩০০। আর পৃথিবীতে পাখি আছে ৫ লাখ প্রজাতির। এসব পাখিদের মধ্যে অনেক প্রজাতিই বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে অন্য দেশে যায় আবার প্রজননকালে নিজ দেশে ফিরে যায়।

বাংলাদেশে আগত অতিথি পাখির মধ্যে উল্লেখযোগ্য রাজ সরালি, পাতি সরালি, বালিহাঁস, রাজহাঁস, দাগী রাজহাঁস, মান্দারিন হাঁস, গোলাপি রাজহাঁস, ঝুঁটি হাঁস, চকাচকি, লেঞ্জা হাঁস, খুন্তে হাঁস, টিকিহাঁস, তিলি হাঁস, গিরিয়া হাঁস, পিয়ং হাঁস, ভূতি হাঁস, চীনা হাঁস , স্মিউ হাঁস, বুনো হাঁস, কালোহাঁস, টিকি হাঁস, ফ্লাইকেচার, চ্যাগা, সারস পাখি, লালশির, নীলশির, খঞ্জনা, পাতি মারগেঞ্জার, শুমচা, পাপিয়া, ফুটকি, সাহেলি, গুলিন্দা, সারস, গ্রিধিনি, মানিকজোড়, এশীয় শামুকখোল, নীলকণ্ঠ, বৈরী, চামচ ঠুটো বাটান, জলপিপি, পানি মুরগি, কমনচিল, কটনচিল, নর্দান পিনটেইল, কার্লিউ, গ্যাডওয়াল, পিয়াং, কালোকুট, নিশাচর হেরন, পান্তামুখী, রাঙ্গামুড়ি, গিরিয়া, কাদাখোঁচা, গায়ক রেন, পাতারি, কালামাথা, বৈকাল, নীলশীর, ডুবুরি পাখি সোনাজঙ্গ, খুরুলে, কাদাখোঁচা, কুনচুষী, বাতারণ, শাবাজ, হরিয়াল, দুর্গা, টুনটুনি, রাজশকুন, লালবন মোরগ, তিলে ময়না, রামঘুঘু, জঙ্গী বটের, ধূসর বটের, কুলাউ ও বিভিন্ন প্রজাতির গাংচিল ইত্যাদি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক গাজী আসমত জনকণ্ঠকে বলেন, শীত শুরুর সঙ্গে সঙ্গে দেশে অতিথি পাখি আসা শুরু হয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণেও এদের অবদান অনন্য। তিনি বলেন, অতিথি পাখির সঠিক পর্যবেক্ষণের জন্য ‘গ্লোবালি মনিটরিং টিম থাকা প্রয়োজন। অতিথি পাখি আমাদের দেশে এসে অবাধ বিচরণ করলেও মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ায় আগের মতো শিকার করে খেয়ে ফেলে না। এসব পাখি কয়েক মাসব্যাপী আমাদের দেশে নিরপদে আশ্রয় নেয়ার পাশাপাশি খাদ্যগ্রহণ করে থাকে। নির্দিষ্ট সময় পর আবার ফিরে যায়। নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার পর মানুষ পাখি শিকার করে খায় বলে আমরা জানতে পারি। তাই যেসব দেশ থেকে অতিথি পাখিগুলো আসে তাদের কাছ থেকে আমাদের আর্থিক সহায়তা নেয়া উচিত।

প্রতিবছর শীতকালে দেশের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল এবং বৃহত্তর সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার হাওড়-বাঁওড়, বিল, ঝিল, নদী, দীঘি, লেক ও বন-বাদাড়ে অতিথি পাখি ভিড় করে। যেসব এলাকায় অতিথি পাখি বেশি আসে তার মধ্যে রয়েছে সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার মধ্যে অবস্থিত হাকালুকি হাওড়, সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওড়, মৌলভীবাজারের বাইক্কা বিল (হাইল হাওড়),পাবনার চলন বিল, গোপালগঞ্জের বর্ণিবাঁওড় টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে ধলাপাড়ার চাপড়া বিল ও কাপ্তাই হ্রদসহ বিভিন্ন জলাশয়। এ ছাড়া দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের বহির্নোঙ্গর, পতেঙ্গা, হালিশহর, কাট্টলী, কর্ণফুলী নদীর মোহনা, সীতাকুণ্ড, বাঁশখালী, আনোয়ারা, হাতিয়া, নিঝুম দ্বীপ, সন্দ্বীপ, উড়িরচর, মীরসরাই, কক্সবাজারের টেকনাফ, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, শাহপরীর দ্বীপ, মহেশখালী, সোনাদিয়া, কুতুবদিয়া, বদরখালী, চকরিয়া, ভোলা, চরফ্যাশন, রাঙ্গাবালি, চরকুকরি-মুকরি হয়ে দক্ষিণে পাথরঘাটা, মহিপুর, দুবলার চর, সুন্দরবনের নদ-নদী ও খাল, রায়মঙ্গল পর্যন্ত ৭১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বঙ্গোপসাগরের তটরেখা বরাবর বর্তমান সময়ে অতিথি পাখিদের মিলন মেলা জমজমাট। পাখ-পাখালির ঝাঁক সমুদ্র উপকূলের আকর্ষণকে বাড়িয়ে তুলে। সাগর কৈতর, সী-গাল, হাঁসসহ অসংখ্য প্রজাতির পাখি সমগ্র উপকূলজুড়ে সৃষ্টি করেছে অনিন্দ্য সুন্দর প্রকৃতির মেলা। এ ছাড়া চর বা দ্বীপাঞ্চলের জলাশয় ছাড়াও গাছ-গাছালির ওপর বাসা বেঁধে ওরা থাকে। আবার খুব ভোর বেলায় স্বাস্থ্যোপযোগী আবহাওয়ায় সাগরবক্ষে কিংবা চরের ভেজা ও উষ্ণ মাটিতে গা এলিয়ে দেয়। আর দিনভর খাদ্যের অন্বেষণে চর, দ্বীপগুলোতে দল বেঁধে পাখিরা ঘুরে বেড়ায়। সন্ধ্যা লগ্নেই নীড়ে ফেরে। তবে নিশাচর প্রজাতির অতিথি পাখিরা রাতের বেলায় বিচরণ করে খাদ্য সংগ্রহ করে।

উপকূল এলাকায় নির্বিচারে প্যারাবন ধ্বংসের কারণে অতিথি পাখিদের বাসস্থান সঙ্কট, সমুদ্র সৈকত বরাবর ভেসে আসা আবর্জনা ও বর্জ্যতেলের বিষাক্ত আস্তর জমে ওঠা এবং উপকূলসহ বিভিন্ন এলাকায় জালসহ বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে পাখি-শিকারিদের অপতৎপরতা, জলাশয় ভরাট করে ফেলা, কৃষিকাজে কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সঙ্কটের কারণে অতিথি পাখিরা তেমন ভাল নেই। দেখা দিয়েছে নিরাপত্তা সঙ্কট। তবে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় আগের মতো অতিথি পাখি শিকার করে বাজারে প্রকাশ্যে বিক্রি করা কিছুটা কমেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতাও আগের চেয়ে বেড়েছে।

পাখি পর্যবেক্ষক ইনাম আল হকের গবেষণা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের পরিবেশ অতিথি পাখির জন্য খুবই অনুকূল। তাই সারাদেশেই অতিথি পাখির আনাগোনা চোখে পড়ে। শীতকালে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি আসে কয়েক হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে। এরা টানা ১০০ মাইল উড়ার পর বিশ্রাম নেয়। ঘণ্টায় উড়ে ২৫ থেকে ৭০ মাইল বেগে। অতিথি পাখির নিরাপত্তার জন্য অনেক ব্যবস্থা নেয়া হলেও গ্রামের গরিব মানুষ পেটের দায়ে পাখি শিকার করে বিক্রি করছে। কিন্তু যারা কিনছে তারা শহরে শিক্ষিত ও ধনী শ্রেণীর। রুচির পরিবর্তনের জন্যই তারা নিজেরা শিকার করে কিংবা কিনে নেয় অতিথি পাখি। এ বিষয়ে সচেতনতা বেড়েছে তবে আরও জনসচেতনতা বাড়াতে পত্র-পত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশনে বিভিন্ন ডকুমেন্টারি প্রচার করা যেতে পারে। শিকারিদের হাত থেকে এই পাখিদেরর রক্ষা করা সরকার ও প্রশাসনের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি।

দেশে অতিথি পাখির অভয়ারণ্যের মধ্যে রয়েছে ঢাকা চিড়িয়াখানার লেক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের লেক, সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত এশিয়ার সর্ববৃহৎ হাকালুকি হাওড়, সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওড়, দিনাজপুরের রামসাগর, বরিশালের দুর্গাসাগর ইত্যাদি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক পরিবেশ বিজ্ঞানী মনিরুজ্জামান সরকার বলেন, প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় অতিথি পাখি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই আমাদের সবারই উচিত অতিথি পাখির জন্য নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করা। আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ বছর ধরে পাখিদের জন্য অভয়ারণ্য তৈরি করেছি। এখন এই ক্যাম্পাসে পাখিরা অবাধে বিচরণ করে। পাখির কিচিরমিচির শুনতে হলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আসা যেতে পারে। বিশেষ করে ডাহুকের ছানার অবাধ বিচরণ ও তাদের কলকাকলিতে ক্যাম্পাস মুখরিত থাকে।

রাজধানীর অনতি দূরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২টি লেক অতিথি পাখির অভয়ারণ্য। সেখানে হরেক রকম অতিথি পাখি পর্যবেক্ষণ করতে ঢাকা থেকে অনেকেই ছুটে যায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে লীলাভূমি ও অতিথি পাখির স্বর্গ নামে খ্যাত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। নজরকাড়া অতিথি পাখি দেখতে সাধারণ দর্শনার্থীদের পাশাপাশি শৌখিন পাখিপ্রেমী ও পেশাদার আলোকচিত্রী ও বিদেশী পর্যটকেরাও ভিড় করেন। ২২টি লেকের মধ্যে প্রশাসনিক ভবনের সামনের লেক, জাহানারা ইমাম ও প্রীতিলতা হল সংলগ্ন লেক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনের লেকে অতিথি পাখির পদচারণা চোখে পড়ার মতো।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসে আগত অতিথি পাখির সার্বিক নিরাপত্তা কার্যক্রম তদারকি করে। এ জন্য প্রতিবছরই এখানে আগত অতিথি পাখির সংখ্যা বাড়ছে। নবেম্বর-জানুয়ারিতে অতিথি পাখি বেশি আসে, আবার মার্চ-এপ্রিলের দিকে ফিরে যায় আপন ঠিকানায়। এরপর তারা প্রজনন কার্য সম্পন্ন করে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব পাখি আসে, তার মধ্যে বেশিরভাগই হাঁস জাতীয় এবং এরা পানিতে বসবাস করে। এর মধ্যে রয়েছে সরালি, পচার্ড, ফ্লাইকেচার, গার্গেনি, ছোট জিরিয়া, মুরগ্যাধি, কোম্বডাক, নীলকণ্ঠ ও পাতারি। এ ছাড়া অন্য প্রজাতির অতিথি পাখির মধ্যে রয়েছে মানিকজোড়, কলাই, ছোট নগ, জলপিপি, নাকতা, খঞ্জনা, চিতাটুপি লাল গুড়গুটিসহ আরও কিছু প্রজাতি।

অতিথি পাখি বিশেষজ্ঞ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোস্তফা ফিরোজ জানান, পরিবেশ অনুকূলে থাকায় এবার অতিথি পাখির আগমন অন্যান্য বছরের চেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ইতোমধ্যেই ১০ প্রজাতির পাখি এসেছে। এখন পর্যন্ত যত অতিথি পাখি এখানে এসেছে তা গত কয়েক বছরের তুলনায় অনেক বেশি। অন্যান্য বছর এ বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকগুলোতে ৭ হাজারের মতো অতিথি পাখি আসলেও এ বছর ১০ হাজারেরও বেশি আসবে। দেশের অন্য এলাকায়ও এবার অতিথি পাখি বেশি আসবে বলে এ যাবত আসা পাখিদের ‘ট্রেন্ড’ দেখে মনে হচ্ছে। ডিসেম্বরের শেষ দিকে সবচেয়ে বেশি আসবে।

জানা যায়, দেশের সর্ববৃহৎ হাওড় হাকালুকি, কাউওয়া দীঘি ও বাইক্কার বিলসহ বিভিন্ন জলাশয়ে এবার অতিথি পাখি আগমনের সংখ্যা গত কয়েক বছরের চেয়ে বেশি। এ ছাড়া পাহাড়ী এলাকার মধ্যে এবার রাঙ্গামাটির বিভিন্ন লেক, সুভলং, লংগদু, কাট্টলী, মাইনিমুখ, সাজেক, বাঘাইছড়ি, হরিণা, বিলাইছড়ি, বরকলসহ বিভিন্ন বিলে জলাশয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে আসছে থাকে অতিথি পাখি। উপকূলীয় অঞ্চলেও এবার পাখির আগমন বেশি। সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার ছোট-বড় ২৪০টি বিল ও ১০টি নদীর সমন্বয়ে গঠিত হাকালুকি হাওড়ে এবার অনেক বেশি পাখি এসেছে বলে জানা যায়। অন্যান্য হাওড় ও বিলেও অতিথি পাখির আনাগোনা বাড়ছে। প্রতিটি হাওড়ে পাখির কলতানে মোহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।

অতিথি পাখি শিকার আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও একশ্রেণীর অসাধু মানুষ অর্থের লোভে সে অপরাধে নিজেদের যুক্ত করছে। এরা জাল, বড়শি, বন্দুকের গুলি ও বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে অতিথি পাখি শিকার করে বাজারে বিক্রি করে। এ ছাড়া ইদানীং অতিথি পাখির আবাসস্থলগুলো বায়ু ও পরিবেশ দূষণের শিকার হচ্ছে। এ বিষয়ে সতর্ক না হলে এবং অতিথি পাখির নিরাপত্তায় জনসচেতনতা না বাড়লে দেশের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হবে। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন- ২০১২ অনুযায়ী, অতিথি পাখি হত্যা বা শিকারের দায়ে একজন অপরাধীকে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড অথবা সর্র্বোচ্চ ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। একইভাবে কোন ব্যক্তি যদি এ পাখির মাংস, দেহের অংশ সংগ্রহ করেন, দখলে রাখেন কিংবা ক্রয়-বিক্রয় করেন বা পরিবহন করেন, সে ক্ষেত্রে তার সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার আইন প্রচলিত রয়েছে।

মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার ফারুক আহমদ জানান, হাওড়াঞ্চলে অতিথি পাখি আসছে। পাখির নিরাপত্তা রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর রয়েছে। অতিথি পাখি যাতে অবাধে বিচরণ করতে পারে সে জন্য আমরা সর্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করি। এ ছাড়া কেউ অতিথি পাখি শিকারসহ কোন অনিয়ম করার চেষ্টা করলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানাসহ শাস্তির ব্যবস্থা করে থাকি।

অতিথি পাখি সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, প্রতিবছর এসব পাখি কয়েক হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে পছন্দের গন্তব্যে আসা ও নিজ দেশে ফিরে নিজের বাসস্থান চিনতে একটুও ভুল হয় না। সমুদ্রের নাবিক যেমন কম্পাস ব্যবহার করে পথ চলে অতিথি পাখিদের দেহে সেরকম কিছু একটা জন্মগতভাবে থাকে, যা তাদের পথ চলার সময় দিক চিনতে সাহায্য করে। তাছাড়া তারা সূর্য, তারা, পাহাড় ও সমুদ্র উপকূলের অবস্থানের ওপরই নির্ভর করে। পরিষ্কার মেঘমুক্ত রাতে যখন আকাশে নক্ষত্র দেখা যায় তখন পরিযায়ী পাখিরা নির্বিঘ্নে পথ চলতে পারে। সাধারণত অতিথি পাখিরা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আড়াইহাজার থেকে ১০ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে। অতিথি পাখিদের গতিপথসহ বিভিন্ন তথ্য জানতে বিশেষ প্রক্রিয়ায় পাখি ধরে তাদের পায়ে এক ধরনের রিং পরিয়ে দেন গবেষকরা।

গবেষণা রিপোর্ট থেকে আরও জানা যায়, অতিথি পাখি নানাভাবে আমাদের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে। পরিবেশে প্রাণী বা উদ্ভিদ নির্দিষ্ট সংখ্যার চেয়ে কম-বেশি হলেই সে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়। আমাদের দেশের ক্ষতিকর পোকামাকড়, জলজউদ্ভিদ, পচাগলা বিভিন্ন উপাদান খেয়ে পরিবেশকে ঠিক রাখে অতিথি পাখি। এ ছাড়া অতিথি পাখির বিষ্ঠা মাটিতে নাইট্রোজেন সারের জোগান দিয়ে ফসল উদপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। গ্রামীণ গাছগাছালি হ্রাস, জমিতে কীটনাশক প্রয়োগ, প্লাস্টিক দূষণ, দেশের ৬ দশমিক ৮ মিলিয়ন হেক্টর জলাভূমির মধ্যে কোন কোন জলাভূমি ভরাট করে ফেলা, হাওড়-বাঁওড়সহ জলাশয়ে ব্যাপক হারে মাছ শিকার, জেলে এবং শিকারিদের উৎপাত, যথেচ্ছভাবে পাখি পাচার ও নিধনের ফলে অতিথি পাখির সংখ্যা একযুগ আগের চেয়ে কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। তবে এবার পাখির আগমন গত বছরের তুলনায় বেশি মনে হচ্ছে।

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারী কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন মোহাম্মদ শাহজাহান ভূইয়া বলেন, বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল হওয়ায় শীতের তীব্রতা কম। তাই কয়েক হাজার মাইল আকাশপথ উড়াল দিয়ে অতিথি পাখি বা পরিযায়ী পাখিরা আমাদের দেশে ছুটে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে। অতিথি পাখি আমাদের পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য বাড়িয়ে আকর্ষণীয় করে তুলে। এরা আমাদের পর্যটন-বিনোদনের অপরূপ অনুষঙ্গ। সমুদ্রের ঢেউয়ের তালে তালে আনন্দে নেচে বেড়ায় বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখি। এ ছাড়া বিভিন্ন জলাশয়ে অবাধ বিচরণ তাদের। শীতকালে এ যেন এক অভূতপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য। কোন কোন এলাকায় অতিথি পাখির অভয়ারণ্য থাকলেও বিচ্ছিন্নভাবে কোন এলাকায় এদের শিকার করে বাজারে বিক্রি করার কথা শোনা যায়। তাই আমাদের সকলের অতিথি পাখিদের প্রতি সদয় হতে হবে। শিকারিদের হাত থেকে এদের বাঁচাতে হবে। তাদের নিরাপদ বিচরণ, বসবাস, খাবার সংগ্রহ যেন কোনভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয় সেদিকে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে।

সমুদ্রবিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদ আন্দোলনের নেতা মিহির বিশ্বাস বলেন, অতিথি পাখি জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশকে সমৃদ্ধ করে। এবার পরিবেশ অনুকূলে থাকায় দেশে অতিথি পাখি আগমনের সংখ্যা বেশি। তবে সমুদ্র উপকূলসহ বিভিন্ন এলাকায় অতিথি পাখি শিকার করে বাজারে ভোজনরসিকদের কাছে বিক্রি করার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ আইন অনুসারে পাখি শিকারি ও ক্রেতাদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

দীঘিনালা সরকারী কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কম্প্রমিস চাকমা বলেন, পাহাড়ী এলাকার জলাশয়গুলোতে এবারও এসেছে অতিথি পাখি। এরা আমাদের প্রকৃতির দান। তবে কোথাও কোথাও অতিথি পাখির নিরাপত্তাহীনতা রয়েছে। তাই কেউ যেন এদের শিকার না করে এ জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

Please follow and like us:

Check Also

সাতক্ষীরায় বছরে ২৫০ কোটি টাকার গাছের চারা উৎপাদন

মাটি ও আবহাওয়ার কারণে সব ধরনের গাছের চারা উৎপাদন হয় সাতক্ষীরায়। এসব চারার মধ্যে রয়েছে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।