ক্রাইমবাতা ডেস্করিপোট: নোনা পানিতে ভিজে ভিজে কম মজুরিতে দিনভর খাটেন, তবু তারা স্বপ্ন দেখেন- মেয়ের বিয়ে হবে; ছেলের বউ ঘরে আসবে; ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া হবে। সেসঙ্গে তারাও একদিন সুখের মুখ দেখবেন।
সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকায় চিংড়ি খামারে নোনা পানিতে কাজ করা এমন অনেক নারীর স্বপ্ন এটি। তারা ঘর সংসার করেন। মাঠে-ঘাটে চিংড়ি ঘেরে কাজ করেন। সামান্য রোজগারে ভর করেই চলে তাদের জীবন।
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার গদাইপুর গ্রামের পালতে সরকার। রোজ সকালে চলে যান ঘের এলাকায়। খোঁজ করেন কাজের। মিলেও যায়। কাজ না মিললে সেদিন খুব কষ্টে কাটে। পালতে রাণীর এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে এইচএসসি’র গণ্ডি পার করেছে। কিন্তু করোনার কারণে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারছেন না। তার ওপর টাকা-পয়সার সমস্যা তো আছেই। ছেলেকে অনেক দূর পর্যন্ত লেখাপড়া করাতে চান পালতে রাণী। পালতে রাণীর মতে, ছেলেকে ডাক্তারি পড়াব ভেবেছিলাম।
কিন্তু রেজাল্ট যথেষ্ট ভালো ছিল না। তাছাড়া বেসরকারি মেডিকেলে পড়ানোর সামর্থ্য আমাদের নেই। তবু যতদূর পারি লেখাপড়া ওকে শিখাব। এখন চিংড়ি ঘেরে কাজ কম। এখন চিংড়ি মৌসুম নয়। এখন কাজ ঘের পরিষ্কার করা। ঘেরের শেওলা ও বর্জ্য পরিষ্কার করে চিংড়ি মাছের পোনা ছাড়বে মহাজনরা। তারপর আবার আমাদের কাজ হবে। তাই চিংড়ি ঘের পরিষ্কার করছি।
পালতে সরকার আরও বললেন, তার জোনের দাম ১৫০ টাকা। এর বেশি কোনো মালিক বা মহাজন মজুরি দিতে চায় না। এ টাকায় কাজ না করলে মহাজন অন্য জোন খুঁজে নেয়। শুধু বসতের একটি ঘর আছে তার। জমি জিরাত নেই কিছু-ই। ঘরে অপ্রকৃতিস্থ স্বামী। মেয়েটিকে কিছুদিন আগে পাত্রস্থ করেছি। একই গ্রামের খুকী সরকার। তিন ছেলের মা তিনি। ছেলেরা বিয়ে করে পৃথক সংসার পেতেছে। মা-বাবার খোঁজ নেয় না ছেলেরা। খুকী ও তার স্বামী জিতেন্দ্র দু’জনে কোনো রকমে দিন পার করছেন। স্বামী জিতেন্দ্রের বয়স হওয়ায় কিছু-ই করতে পারেন না। খুকী চিংড়ি ঘেরে কাজ করে যা রোজগার করেন তা দিয়েই চলে তাদের দু’জনের সংসার।
খুকী সরকারের মতে, তার জোন মজুরির দাম ১৫০ টাকা। এর বেশি চাইলে কাজে নেয় না কেউ। এভাবেই চলছে আমার দিনকাল।
শুধু চিংড়ি ঘের নয়, নদীতে পোনা ধরেও দিন কাটছে দক্ষিণ উপকূলের পিছিয়ে পড়া নারীদের। সকাল-সন্ধ্যা নদীতে ভাটার সময় ছোট জাল টেনে পোনা ধরেন নারীরা। এতে দৈনিক এক থেকে দেড়শ’ টাকা আয় হয়। কোনোদিন কম অথবা বেশি। কালিগঞ্জের কাকশিয়ালি নদীতে এভাবেই পোনা ধরেন মমতা বেগম।
এ প্রসঙ্গে মমতা বেগম বলেন, সংসারে চারটি মুখ। একা পেরে উঠি না। তাই ছেলের বউও মাঝে মাঝে নদীতে আসে আমার সঙ্গে। ছেলে মাঠে-ঘাটে জোন দেয়। ওর বাবা কাজ করতে পারেন না অসুস্থতার কারণে। তবু জোন খেটে নতুন ঘর তুলেছি। মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। এ টানাটানির সংসার সবাই মিলে চালিয়ে নেই।
শ্যামনগরের রমজাননগরে চিংড়ি ঘের পরিষ্কার করতে পানিতে নেমেছেন নারীরা। শেওলা তুলে দিলে দৈনিক পান দেড়শ’ টাকা। মাস দুয়েক এভাবে চলবে। তারপর আবারও চিংড়ি ধরা কাজে নামবেন তারা। ঘেরে শেওলা তুলতে তুলতে সুর করে সুখ-দুঃখের গান গায় মজিদা বেগম, রূপালি আর শান্তি রাণী। ওদের সবার আছে সংসার। ঘরে রয়েছে ছেলেমেয়ে। তাদের দেখভাল করতে হয়।
মজিদা বেগম বললেন, পুরুষদের জোনের দাম বেশি। আমরা তো সমান কাজ করি। কাজে ফাঁকি দেই না। তবু আমাদের মজুরি কম কেন। মহাজনের ডিপোতে চিংড়ি জমা হয়ে আছে। এখন সেই চিংড়ির মাথা ছাড়াতে হয় উপকূলীয় নারীদের; সেখানেও মজুরি কম। তবু পেটের দায়ে সব কিছু মেনে নিতে হয়।
এমন একজন নারী শ্রমিক নীলিমা বললেন, নোনা পানিতে থেকে চিংড়ি ধরায় তার হাতে-পায়ে চুলকানি দেখা দিয়েছে। হাতে খানিকটা ক্ষতও দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় যন্ত্রণা সহ্য করেও কাজ করি। না হলে চলবে কী করে। সংসার চালাতে হবে। ছেলেমেয়ের লেখাপড়াও চালাতে হবে।