- ৫০ হাজার হেক্টর আবাদ এলাকা বাড়ছে
- বিনামূল্যে হাইব্রিড ধানের বীজ পাবেন কৃষক
- বীজ ভর্তুকিতেই ব্যয় হবে ৭৫ কোটি টাকা
- অর্ধেকের বেশি বীজতলা তৈরির কাজ সম্পন্ন
ক্রাইমবাতা ডেস্করিপোট ॥ দেশের মোট চালের অর্ধেকের বেশি প্রায় ৬০ ভাগ আসে বোরো আবাদ থেকে। আর তাই আমন ফসল ঘরে তোলার পাশাপাশি ব্যস্ততা বেড়েছে সামনের প্রধান ফসল বোরো আবাদ নিয়ে। ইতোমধ্যেই বোরো ধান নিয়ে জোরালো প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। আগে থেকেই বোরো আবাদ নিয়ে প্রস্তুতি নেয় সরকার। উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের বিনামূল্যে হাইব্রিড বীজ দেবে সরকার। সেই সঙ্গে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য আবাদ এলাকা বাড়বে প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর। খাদ্য নিরাপত্তায় প্রধান ফসল এই বোরো নিয়ে সরকারের পাশাপাশি কৃষকও বীজতলা তৈরি শুরু করেছেন। আবাদ এলাকা বৃদ্ধির পাশাপাশি উচ্চফলনশীল ধানের আবাদ বাড়িয়ে প্রতিবছরই অতিরিক্ত কয়েক লাখ টন বেশি চাল উৎপাদন করতে চায় সরকার।
কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, খাদ্য নিরাপত্তার সরবরাহ ঠিক রাখতে গত বোরো মৌসুমের চেয়ে প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমি বাড়ানো হবে এবারের বোরো মৌসুমে। এছাড়াও জানা গেছে, বোরো মৌসুমে উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের বিনামূল্যে হাইব্রিড বীজও দেবে সরকার। সারাদেশের ১৫ লাখ কৃষককে এক বিঘা জমি চাষের প্রয়োজনীয় বীজ বিনামূল্যে সরবরাহ করা হবে। প্রথমবারের মতো এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় মনে করছে, বিনামূল্যের বীজ পাওয়ার কারণে বাড়তি আরও দুই লাখ হেক্টর জমিতে উচ্চ ফলনশীল ধানের চাষ হবে। বোরো আবাদ নিয়ে এখন থেকেই ব্যাপক প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকও। মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের (এডিপি) বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় বোরো মৌসুমের আবাদ বৃদ্ধির কথাও জানান কৃষিমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, বন্যাসহ নানা কারণে এ বছর আমনের উৎপাদন ভাল না হওয়ায় ধানের দাম খুব বেশি। যা নিয়ে খুব চিন্তার মধ্যে রয়েছি। সেজন্য, যে কোন মূল্যে আমাদের আগামী মৌসুমে বোরো ধানের উৎপাদন বাড়াতে হবে। বোরোর চাষযোগ্য কোন জমি যাতে খালি না থাকে সে ব্যাপারে কৃষকদের উৎসাহ দিতে হবে। বোরোর উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে মাঠ থেকে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত সকল কর্মকর্তাকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এজন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করে কৃষকের পাশে থাকার কথা বলেছেন কৃষিমন্ত্রী। তিনি জানিয়েছেন, কৃষকদের বোরো ধানের যে উন্নত বীজ সরবরাহ করা হচ্ছে, সার, সেচসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণ এবং বন্যার ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় যে প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে তা সুষ্ঠুভাবে বিতরণ নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই এ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রসারণ) মোঃ হাসানুজ্জামান কল্লোল বলেন, দেশে বন্যার কারণে আমনে কাক্সিক্ষত ফলন হয়তো আসবে না তাই বোরোতে আমরা পুষিয়ে নিতে চাই। তাই আবাদ এলাকা বাড়ছে।
কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে আমরা এবার প্রত্যেক জেলায় একটি করে উপজেলায় ‘সমলয়ে’ চাষের আওতায় নিয়ে আসছি। এতে কৃষকদের খরচ কমে আসবে। প্রণোদনাও দেয়া হচ্ছে। খাদ্যে স্বস্তিতে থাকতেই বোরোর অধিক আবাদ উৎপাদনে যাচ্ছি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মোঃ আসাদুল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেছেন, আমরা বোরো নিয়ে কাজ শুরু করেছি আগে থেকেই। আমাদের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। এবছর গতবছরের চেয়ে প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ বাড়বে। আমরা উফশী জাতের চেয়ে হাইব্রিড জাতের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। কেননা হাইব্রিডে ফলন বেশি। এক হেক্টর হাইব্রিড থেকে উফশীর চেয়ে ১ টন বেশি ফলন আসে।
এদিকে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) তথ্য অনুযায়ী, ধান উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ এখন তৃতীয়। চলতি বোরো মৌসুমে মোট দুই কোটি ছয় লাখ টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছর বোরো মৌসুমে উৎপাদন হয় দুই কোটি এক লাখ টন। বোরো উৎপাদনের জন্য এবার ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪৮ লাখ ৪ হাজার ৪০০ হেক্টর জমি নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১১ লাখ ৪ হাজার হেক্টরে হবে হাইব্রিড ধানের চাষ। গত বছর ৯ লাখ ৪ হাজার হেক্টর জমিতে হাইব্রিড ধান চাষ হয়েছে। গত বোরোতে ৪৮ লাখ ৬৬ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও অর্জিত হয় ৪৭ লাখ ৫৪ হাজার ৪০০ হেক্টর জমি। সে হিসেবে অর্জিত জমির চেয়ে এবার ৫০ হাজার হেক্টর আবাদ এলাকা বাড়ানো হচ্ছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক ড. মোঃ শাজাহান কবীর বলেন, আমরা কৃষিমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের দিক নির্দেশনায় শুরু থেকেই একটা প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছি। এবার বোরো আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে আমাদের ১৪টা কৃষি অঞ্চলের মধ্যে ১২টা অঞ্চলে কর্মকর্তাদের নিয়ে ওয়ার্কশপ শেষ করেছি। আমরা মুজিববর্ষ উপলক্ষে বিনামূল্যে কৃষকদের বীজ দিচ্ছি। এছাড়াও নতুন জাতের ২০০ টনের বেশি বীজ অন্যান্য সংস্থার মাধ্যমে বিতরণ করেছি। ব্রি মহাপরিচালক আরও বলেন, সরকারের লক্ষ্য হলো আবাদ ও ফলন বাড়ানো। সে লক্ষ্যে আমরা গত তিন বছর ধরে বরিশালে কাজ করছি যার সাফল্য হিসেবে এবছর থেকে নতুন করে ১ হাজার হেক্টর জমি যুক্ত হচ্ছে যেখানে আগে বোরো হতো না। এবছরই প্রথমবারের মতো ব্রি ৯৭ এবং ব্রি ৯৯ ধান প্রদর্শনীতে যাচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশের ব্যাপক অঞ্চলজুড়ে বন্যা হওয়ায় বোরো মৌসুমে আমনের ঘাটতি পুষিয়ে নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। এ লক্ষ্য অর্জনে হাইব্রিড চাষ বাড়ানো হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জনিয়েছে, গত বছরের চেয়ে এবার দুই লাখ হাইব্রিড ধানের চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এজন্য ১৫ লাখ কৃষককে মাথাপিছু এক বিঘা জমির জন্য দুই কেজি করে বীজ দেয়া হবে। এতে প্রতি কৃষকের জন্য সরকারের খরচ পড়বে ৫০০ টাকা। মোট ব্যয় হবে ৭৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা। বাড়তি জমিতে হাইব্রিড জাতের ধান চাষ হওয়ায় অতিরিক্ত দুই লাখ টন উৎপাদন বাড়বে।
মাঠ পর্যায়ে হাইব্রিড বীজ সরবরাহ করা নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মোঃ আসাদুল্লাহ বলেন, আমাদের বোরো নিয়ে জোরালোভাবে কার্যক্রম চলছে মাঠ পর্যায়ে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় আবাদ এলাকা ও উৎপাদন বাড়ানোর জন্য আমাদের কর্মকর্তারা কাজ করছেন। ইতোমধ্যেই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কার্যালয়গুলোতে বীজ সরবরাহ করা শুরু হয়েছে। ৫৫ শতাংশ বীজতলা তৈরি হয়েছে। যে এলাকার যে জাতের হাইব্রিড ধান চাষ হয়, তাদের সেই জাতের বীজই সরবরাহ করা হবে বলেও তিনি জানান।
এছাড়াও এ বছর দেশের ধান চাষ ব্যবস্থায় নতুনত্ব আসছে। প্রত্যেক জেলার একটি করে উপজেলায় ‘সমলয়ে’ ধান চাষ করা হবে। সমলয়ে চাষ বলতে একটি নির্দিষ্ট এলাকার সব জমি একসঙ্গে চাষ করা হবে। চাষ শেষে উৎপাদিত ফসল জমির মালিকদের জমির অনুপাতে ভাগ করে দেয়া হবে। ধান চাষে যান্ত্রিকীকরণ ব্যবস্থা জনপ্রিয় করা এবং খরচ কমাতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। পরীক্ষামূলকভাবে এই চাষের বীজ ও সার বিনামূল্যে দেবে সরকার।
জানা গেছে, হাইব্রিড ও উচ্চফলনশীল ধানের আবাদ বাড়িয়ে প্রতিবছর কয়েক লাখ টন করে বেশি চাল উৎপাদন করা হবে। চলতি বোরো মৌসুমেই কয়েক লাখ টন ধান বেশি উৎপাদন হবে। হাইব্রিড ধানের ফলন হেক্টরে চার দশমিক নয় টন। আর দেশী জাতের ধানের গড় উৎপাদন সর্বোচ্চ ১ দশমিক ৯৪ টন হেক্টরে। আর উফশীতে ফলন হয় ৪.১১ টন হেক্টরে। ধানের পাশাপাশি এবার অন্যান্য ফসল উৎপাদনে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ধান বীজ, সেচকাজে বিদ্যুত ও ডিজেল সরবরাহ এবং সারের দাম কমিয়ে সরকার কৃষকের জন্য সহজলভ্য করেছে। বোরো মৌসুমে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহ নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জলবায়ুসহ নগরায়ণের ফলে দেশে কৃষি জমি প্রতিদিনই কমছে। তাই হাইব্রিডের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্য উৎপাদনের স্বয়ংসম্পূর্ণতা ধরে রাখতে চায় সরকার। লবণাক্ত জমিতেও এবার হাইব্রিড ধান আবাদের কথা ভাবা হচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে লবণ সহিষ্ণু ধানের জাত দেয়া হচ্ছে। শুধু ধান নয়, সবজি, ডাল জাতীয় শস্য, মসলা ফসলেও হাইব্রিড জাত বাড়ানো হচ্ছে। জানা গেছে, দেশে এখন খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে তিন কোটি ৭০ লাখ টন। আর চাহিদা প্রায় তিন কোটি। এর মধ্যে ৫০ লাখ টন বীজ ধান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। চলতি রবি মৌসুমের জন্য তিন লাখ ৫৫ হাজার ৩৬৪ হেক্টর জমিতে গমের আবাদ করা হচ্ছে। ভুট্টা চাষ হচ্ছে চার লাখ ৭১ হাজার ৫৪৭ হেক্টর জমিতে। প্রায় ৪০ লাখ ৬৮ হাজার ৫২৬ হেক্টর জমিতে আলু হচ্ছে। দুই লাখ ৪৯ হাজার ৯৪০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ হচ্ছে।