আবু সাইদ বিশ্বাস: ক্রাইমবাতা রিপোট: বাজার মুল্যের চেয়ে দেশে আমন ধান সংগ্রহ অভিযান মুখ থুবড়ে পড়েছে। কৃষক ও মিলাররা সরকারি মূল্যের চেয়ে বাজারে দাম বেশি হওয়ায় গুদামে ধান-চাল দিচ্ছে না। ফলে আমন সংগ্রহ নিয়ে বেহাল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ধান ও চাউল সংগ্রহে ধানের ক্রয় মূল্যের সাথে চাউলের ক্রয় মূল্যের সমন্বয় না থাকার প্রতিবাদে সারাদেশে মানববন্ধন করেছে অটো মেজর এন্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতি। চলতি আমন কাটা-মাড়ির মৌসুমে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে ২৬ টাকা কেজি দরে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ২ লাখ টন ধান এবং চালকল মালিকদের কাছ থেকে ৩৭ টাকা কেজি দরে ৬ লাখ টন সিদ্ধ চাল এছাড়া ৩৬ টাকা কেজি দরে ৫০ হাজার টন আতপ চাল সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ৭ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া ধান ও ১৫ নভেম্বর থেকে চাল সংগ্রহ অভিযান চলবে আগামী বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত।
বৃহষ্পতিবার পর্যন্ত সাতক্ষীরা জেলাতে সরকারি গুদামে কোন চাষি ধান বা চাল বিক্রি করতে আসেনি। সরকারি গুদামে ধান চাল দিতে পারে এমন কৃষকদের তালিকা ও প্রকাশ করেছে উপজেলা প্রশাসন। এর পরও কৃষকরা সরকারি দামে ধান বিক্রি করতে চাচ্ছে না।
সূত্রমতে কৃষি উৎপাদন কর্মকান্ডের ভূমিহীন, প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র পরিবারগুলো আমন ধান উৎপাদনের অন্যতম চালিকাশক্তি। এরা নিজেদের জমিতে চাষাবাদ করে, অন্য চাষিদের জমি বর্গা অথবা লিজ নিয়ে চাষাবাদ করে এবং ফসলের মৌসুমে অন্যের জমিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। এমন প্রায় ২ কোটি আমন ধান চাষী ধানের প্রকৃত মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে বছরের ৪ থেকে ৫ মাস তাদের ঘরে চাল থাকে না। প্রান্তিক চাষিদের অভিযোগ যে সময়ে তাদের ঘরে চাল থাকে না তখন বড় বড় ব্যবসায়ী ও মিলারা চালের দাম বাড়িয়ে দেয়। কৃষকদের দাবী সরকার যদি বেশি করে ধান চাল সংগ্রহ করে রাখত তা হলের সারা বছরই চালের দাম একই রকম থাকতো।
২০১৯-২০ মৌসুমে শুধু সাতক্ষীরা জেলায় কৃষকদের কাছ থেকে ১৪ হাজার ৩৪১ মে:টন ধান ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিল সরকার। তার মধ্যে অর্জিত হয় ৫ হাজার ৫০ মে:টন। যা মোট ক্রয়কৃত ধানের ৩৫ শতাংশ। এছাড়া কৃষকরা যে ধান দিয়ে ছিল তার মান নিয়ে প্রশ্ন ছিল। স্বল্প পরিমাণ ধান দ্রুরবর্তী গুদামে পরিবহনে কৃষকের অনীহা এবং নির্ধারিত ব্যাংকে কৃষকের একাউন্ট না থাকাকে সমস্য হিসেবে চিহ্নিত করে জেলা কৃষি বিভাগ। তবে চলতি মৌসুমে সরকারি দামে ধান ক্রয়ের পরিমাণ আরো কমতে পারে।
এ বছর আমন সংগ্রহ অভিযানে সরকার ধানচাষীদের প্রতি সুবিচার করেনি বলে অভিযোগ উঠেছে। একদিকে গত আমন মৌসুমের তুলনায় এ মৌসুমে কম ধান সংগ্রহ করা হবে; অন্যদিকে দফায় দফায় বন্যার কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেলেও ধানের দাম গতবারের মতো প্রতি কেজি ২৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এদিকে মিলারদের কাছ থেকে সংগ্রহতব্য ৬ লাখ টন সিদ্ধ চালের দাম গত বছরের প্রতি কেজি ৩৬ টাকা থেকে ১ টাকা বাড়িয়ে ৩৭ টাকা করা হয়েছে। এতেও চালকল মালিকরা আন্দোলনে নেমেছে।
চালকল মালিকরা বলেছেন, প্রতি কেজি ধানের দাম ২৬ টাকা হলে তা মিলে চালে পরিণত করতে গিয়ে প্রতি কেজির দাম পড়ে ৪১ টাকা। চালের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণে সরকার তাদের সঙ্গে আলোচনা করেনি। সরকার-নির্ধারিত দামে চাল সরবরাহ করতে পারবেন কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয়ে রয়েছে।
গত মৌসুমে ১ কোটি ৪০ লাখ টন আমন উৎপাদনের বিপরীতে যখন ১০ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়, তখন চলতি বছর ১ কোটি ৫৪ লাখ টন আমন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সাড়ে ৮ লাখ টন, যার মধ্যে ধানের পরিমাণ মাত্র ২ লাখ টন। যেখানে গত আমন মৌসুমে ধান সংগ্রহের পরিমাণ ছিল ৬ লাখ টন, সেখানে আসন্ন আমন মৌসুমে সাড়ে ৮ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহে ধানের পরিমাণ মাত্র ২ লাখ টন।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গত বছর আমন উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৪০ লাখ টনের সামান্য বেশি। গত আমন মৌসুমে সরকার ১০ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। আগের তিন আমন মৌসুমে (২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে) ধান সংগ্রহ না করার ধারা থেকে বের হয়ে এসে গত মৌসুমে সরাসরি ধানচাষীদের কাছ থেকে ৬ লাখ টন ধান সংগ্রহের সিদ্ধান্তকে চাষিরা
ইউএসডিএর তথ্য অনুসারে, ১৯৬৫ সালের পর সবুজ বিপ্লবের কারণে বর্তমানে বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। ৩ কোটি ৬০ লাখ টন চাল উৎপাদন করে বাংলাদেশ চাল উৎপাদনে বিশ্বের মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। মে ২০১৯ থেকে চলতি বছর এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৩ কোটি ৫৮ লাখ টন খাদ্যশস্য (চাল ও গম) সরবরাহ হয়েছে। ইউএসডিএ মাসিক পরিসংখ্যান অনুসারে, বাংলাদেশে গত এক বছরে মোট ৩ কোটি ৮৮ লাখ টন খাদ্যশস্য ভোগ করা হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সাতক্ষীরার উপ পরিচালক নুরুল ইসলাম জানান, বাজারের সাথে সরকারী মূল্যের তারতম্য রয়েছে। বিভিন্ন জটিলতার কারণ দেখিয়ে কৃষকরা সরকারী দামে ধান বিক্রি করতে অনিহা দেখাচ্ছে। এছাড়া তফশিলভুক্ত ব্যাংকে নিজ নামে কোন ব্যাংক একাউন্ট না থাকায় কৃষকরা গোডাউনে ধান বিক্রয় করতে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। তকে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষকদের সরকারী গোডাউনে ধান বিক্রয় করতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, মিলাররা সরকারকে চাল দিতে ব্যর্থ হলে বিদেশ থেকে চাল আমদানি করা হবে ।
কৃষিমন্ত্রী ড. মো: আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন বন্যাসহ নানা কারণে এ বছর আমনের উৎপাদন ভাল না হওয়ায় ধানের দাম খুব বেশি। যেটি নিয়ে খুব চিন্তার মধ্যে রয়েছি। সেজন্য, যে কোন মূল্যে আমাদের আগামী মৌসুমে বোরো ধানের উৎপাদন বাড়াতে হবে।