আবু সাইদ বিশ্বাস: ক্রাইমবাতা রিপোট: সাতক্ষীরা: উপকূলীয় জেলা সমূহে চলছে শুটকি মাছ আহরণ মৌসুম। প্রচন্ড শীত ও করোনা ঝুঁিক মাথায় নিয়ে জেলেরা কর্মব্যস্ত সময় পার করছে। চলবে আগামি বছরের মার্চ পযর্ন্ত। শীতে আবহাওয়া শুষ্ক থাকায় শুঁটকি উৎপাদন যেমন বেশি হয়, তেমনি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানিও চলে পুরোদমে। তাই উপকূলীয় অঞ্চলের ছোট-বড় সব শুঁটকি মহালগুলোতে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন জেলে, শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা। আর সরকারী সহযোগিতা পেলে এ শিল্পকে আরও এগিয়ে নেওয়া সম্ভব বলে আশা তাদের। চলতি মৌসুমে শত কোটি টাকার শুটকি মাছ রপ্তানির স্বপ্ন দেখছে তারা। তাই স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতে জেলদের ভাসমান স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র স্থাপনের দাবী জানিয়েছে। সরকারী পৃষ্টপোষকতা পেলে শুটকি মাছশিল্প রপ্তানির অন্যতম খ্যাত হতে পারে দাবী সংশ্লিষ্টদের।
বাংলাদেশের ২৪টি উপকূলীয় জেলায় দুই কোটি মানুষ জেলে পরিবারের সদস্য এর সাথে জড়িত। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সীমানায় ১,১৮,৮১৩ বর্গ কি. মি. এলাকার মৎস্য আহরণে নিবন্ধিত দেশের ১৬ লক্ষ জেলে কর্মরত। দেশের ষোলকোটি মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিনের যোগান নিশ্চিত করার পাশাপাশি মৎস্য রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রায় শত শত কোটি টাকা আয়ের পথও ক্রমে সম্প্রসারিত করে চলেছে আমাদের জেলেরা। অথচ এমন গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মূলশক্তি সমুদ্রগামী জেলেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বীগ্ন সংশ্লিষ্টরা। বছরের পর বছর ধরে সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগরের জেলেরা এমন নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতে বাধ্য হচ্ছে। উত্তাল সমুদ্রে মৌসুমী ঝড়- জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকির চেয়েও নৌদস্যুদের উৎপাত ও নির্মমতার শিকার হয়ে জেলেদের প্রাণ দিতে হচ্ছে তাদের।
মাছ মানুষের আমিষের অন্যতম উৎস। বিশ্বে গড়ে যেখানে প্রাণিজ আমিষের ২০ শতাংশ আসে কেবল মৎস্য থেকে, সেখানে ৭টি দেশে ৫০ শতাংশের বেশি আসে মাছ থেকে; আর বাংলাদেশে আমিষের ৫৮ শতাংশই আসে মাছ থেকে। ১৯৯০-এর দশকে দেশের মানুষ গড়ে বছরে ৭ কেজি মাছ খেত, ২০১০ সালের খানা জরিপে এটি ১২ কেজিতে পৌঁছে এবং এটি এখন ৩০ কেজিতে পৌঁছেছে। দেশের জিডিপিতে কৃষি খাতের যে ১৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ অবদান, তার এক তৃতীয়াংশই মৎস্য খাতের। জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান এখন ৪ শতাংশূত্র জানায়,দেশে জেলে পরিবারের সঠিক তথ্যও সরকারের কাছে নেই। মৎস্য অধিদপ্তর জানায়,জুন ২০১৭ পর্যন্ত দেশে ১৬ লক্ষ ২০ হাজার মৎস্যজীবী-জেলেদের নিবন্ধনের আওতায় আনা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ লক্ষ ২০ হাজার জেলেদের মাঝে পরিচয়পত্র বিতরণ করা হয়েছে।
বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, গত ২০১৮-১৯ শুটকি আহরন মৌসুমে জেলেদের আহরিত ৪১ হাজর ৫৪ কুইনন্টাল শুটকি থেকে বন বিভাগ ২ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ও ২০১৯-২০ মৌসুমে ৪৪ হাজর ৭১৩ কুইনন্টাল শুটকি থেকে বন বিভাগ ৩ কোটি ১৭ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। আর এবার শুটকি খাত থেকে রাজস্ব আদায়ের টার্গেট ধরাছে ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা।
বঙ্গোপসাগর উপকূলে পাঁচটি চর নিয়ে সুন্দরবনের সর্ববৃহৎ সামুদ্রিক মাছ শুটকি পল্লবী কেন্দ্র দুবলার অবস্থান। বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের দুবলারচর, আলোরকোল, নারকেল বাড়ীয়া, শেলারচর ও মেহেরআলীর চর নিয়ে এই অস্থায়ী ভাবে গড়ে ওঠা এই পল্লীতে বর্তমানে সামুদ্রিক মাছ শুটকি করার কাজ চলছে। এছাড়া উপকূলীয় এলাকা কুতুবদিয়া, মহেশখালীর সোনাদিয়া, গোরকঘাটা, তাজিয়াকাটা, কুতুবজোম, কুতুবদিয়া ,বড়ঘোপ, খুদিয়ারটেক, আলি আকবর ডেইল, অংজাখালী, পশ্চিম ধুরুং, টেকনাফের, শাহপরীর দ্বীপ, সেন্টমার্টিন, জালিয়াপাড়াসহ বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় বিপুল পরিমাণ শুঁটকি উৎপাদন হয়ে থাকে।
এদিকে মুজিব বর্ষ উপলক্ষে সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের জেলেদের মাঝে শীতবস্ত্র, লাইফ জ্যাকেট ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ করেছে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড। বুধবার দুপুরে শ্যামনগর উপজেলার কৈখালীতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের মহাপরিচালক রিয়ার এডমিরাল এম. আশরাফুল হক জেলেদের মাঝে এসব উপকরণ সামগ্রী বিতরণ করেন। বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের পশ্চিম জোনাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন এম হাবিবুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন, পশ্চিম জোন মিডিয়া কর্মকর্তা লেঃ কমান্ডার বিএন এম হামিদুল ইসলাম। এ সময় উপকূলীয় এলাকার তিন’শ জন দুঃস্থ জেলে বাওয়ালীদের মাঝে কম্বল এবং এক’শ জন জেলে বাওয়ালীদের মাঝে লাইভ জ্যাকেট, রেডিও, টর্চলাইট, রেইন কোট ও সাবানসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ করা হয়।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সাগরে আহরিত মাছের অপচয় রোধে এর সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন এবং জেলে পরিবারগুলোর কর্মসংস্থান নিশ্চিত করাই একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে আধুনিক পদ্ধতিতে বছরে প্রায় ১৪ হাজার মেট্রিক টন মানসম্পন্ন শুঁটকি উৎপাদন সম্ভব হবে। মাছের সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ ব্যবস্থাপনার জন্য কক্সবাজারের খুরুশকূলে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শুঁটকি প্রক্রিয়া কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। আগামী ২০২১ সালের জানুয়ারিতে কাজ শুরু হয়ে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বাস্ত বায়নের কাজ শেষ হবে বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। এক্ষেত্রে, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ২০২০-২১ অর্থবছরের এডিপিতে মৎস্য ও প্রাণিম্পদ মন্ত্রণালয়ের নতুন অননুমোদিত প্রকল্পগুলোর উচ্চ অগ্রাধিকার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ‘ভ্যালু অ্যাডেড পণ্য শুঁটকি মাছ ও সাপ্লাই চেইন উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটির পরিবর্তে ‘কক্সবাজার জেলায় শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প কেন্দ্রস্থাপন’ প্রকল্পটি অন্তর্ভুক্ত করে একনেক অনুমোদন করেছে।
জেলেদের এ যৌক্তিক দাবির বিষয়ে সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, করোনা প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই দুবলা চরের অস্থায় শুটকি পল্লীর ১৫ থেকে ২০ হাজার জেলে ও বহরদারা মাছ আহরণ ও শুটকি তৈরির কাজ করতে জড়ো হবে। সেখানে যেহেতু অনেক লোকের সমাগম ঘটবে তাই তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতে সেখানে ভাসমান স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র স্থাপন জরুরী বলে তিনি মনে করেন।
গার্ডের মহাপরিচালক রিয়ার এডমিরাল এম আশরাফুল হক এ সময় বলেন, সুন্দরবনের সুরক্ষা ও দস্যু মুক্ত করতে কোস্ট গার্ডের তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। একই সাথে জেলে বাওয়ালীদের জীবন-জীবিকা নিরাপদ করতে কোস্ট গার্ড সবসময় আন্তরিকভাবে কাজ করছে, আগামীতেও এই তৎপরতা অব্যাহত থাকবে।
কীটনাশক ঔষধ ব্যবহার বন্ধ, স্বাস্থ্য সম্মত উপায়ে শুঁটকি তৈরি, বর্ষা মৌসুমে শুঁটকি তৈরির প্রযুক্তি সরবরাহ এবং এই খাতে ঋণ প্রাপ্তি নিশ্চিত করা গেলে শুঁটকি রফতানিতে অনায়াসে ১শ’ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন শুঁটকি ব্যবসায়ীরা।