দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা কারোর দানে পাওয়া নয়

‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা/কারোর দানে পাওয়া নয়।/দাম দিছি প্রাণ লক্ষ কোটি/জানা আছে জগৎময়।’ প্রাণের দামে কিনতে হয়েছে বাংলাদেশ। একটি নয় দুটি নয় লাখ লাখ প্রাণ।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদাররা বাংলার মানুষের ওপর পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম নারকীয় ও ঘৃণ্যতম হত্যাযজ্ঞ চালায়। গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া, ভৌত অবকাঠামো ধ্বংস, নারীদের সম্ভ্রমহানি- সবকিছুই তারা করেছে।

কিন্তু বাঙালির রণকৌশলের কাছে তারা টিকতে পারছিল না। তাই বাঙালির চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র দু’দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামসের সদস্যরা বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিধনে মাঠে নামে।

রাতের অন্ধকারে বাসা কিংবা কর্মস্থল থেকে চোখ বেঁধে নিয়ে তারা শিক্ষাবিদ, গবেষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, কবি ও সাহিত্যিকদের হত্যা করে।

এ হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করা। দেশের নানা জায়গায় হত্যাযজ্ঞ চললেও মূল হত্যাযজ্ঞ চলে রাজধানীর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে।

আজ সেই ১৪ ডিসেম্বর। বাঙালির বেদনাবিধুর দিন। বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দেশের মানুষ আজ জাতির সেই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ করবে। দিবসটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বাণীতে রাষ্ট্রপতি বলেছেন, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রেখে যাওয়া আদর্শ ও পথকে অনুসরণ করতে হবে। অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়তে পারলেই তাদের আত্মত্যাগ সার্থক হবে।

প্রধানমন্ত্রী বাণীতে বলেন, ‘২০০৯ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে আওয়ামী লীগ সরকার বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় এনেছে। বিচারের রায় কার্যকর করা হচ্ছে। এ কুখ্যাত মানবতাবিরোধীদের যারা রক্ষার চেষ্টা করছে, তাদেরও একদিন বিচার হবে। এসব রায় বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মা শান্তি পাবে। দেশ ও জাতি কলঙ্কমুক্ত হবে।’

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসকে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কলঙ্কময় দিন উল্লেখ করে তিনি বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিনগুলোয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি ও তাদের দোসররা পরাজয় নিশ্চিত জেনে বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করতে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে।

দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতি ও পেশাজীবী সংগঠন নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ভোরে এসব দল ও সংগঠনের নেতাকর্মীরা মিরপুর ও রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধা জানাবেন।

এছাড়া আলোচনাসভার আয়োজন করেছে অনেক দল ও সংগঠন। পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসররা পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের পর ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের লাশ ফেলে রাখে।

১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পরপরই হত্যাযজ্ঞের শিকার বুদ্ধিজীবীদের নিকটাত্মীয়রা বধ্যভূমিতে লাশ খুঁজে পান। বুদ্ধিজীবীদের নিথর দেহজুড়েই ছিল আঘাতের চিহ্ন, চোখ, হাত-পা বাঁধা, কারও কারও শরীরে একাধিক গুলি।

অনেককে হত্যা করা হয়েছিল ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলা কেটে। ক্ষতচিহ্নের কারণে অনেকেই প্রিয়জনের মৃতদেহ শনাক্তও করতে পারেননি।

বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে শহীদ হয়েছেন- অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. মোহাম্মদ মুর্তজা, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য, ডা. মোহাম্মদ শফি, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, নিজামুদ্দিন আহমেদ, খন্দকার আবু তালেব, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, শহীদ সাবের, সৈয়দ নাজমুল হক, জহির রায়হান, আলতাফ মাহমুদ, ড. আবদুল খায়ের, ড. সিরাজুল হক খান, ড. ফয়জল মহী, ডা. আবদুল আলীম চৌধুরী, সেলিনা পারভীন, অধ্যাপক হবিবুর রহমান, কবি মেহেরুন্নেসা, গিয়াস উদ্দীন আহমদ প্রমুখ।

চার দশক পর ঘাতকদের বিচার চলছে। ইতোমধ্যে আদালতের রায়ে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে হয়েছে মিরপুরের কসাই নামে খ্যাত জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা ও জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে।

ফাঁসি কার্যকর হয়েছে আলবদর নেতা ও জামায়াতে ইসলামীর আমীর মতিউর রহমান নিজামী, বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ অন্যদের। কিন্তু বিচার এখনও শেষ হয়নি।

আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছে অন্য ঘাতকদের। এবারের বুদ্ধিজীবী দিবসে জাতিকে পুরোপুরি কলঙ্কমুক্ত করার শপথ নেবে স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ।

আওয়ামী লীগের কর্মসূচি : আওয়ামী লীগের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবন ও দেশব্যাপী সংগঠনের কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন এবং জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ।

সকাল ৯টায় মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন। সকাল সাড়ে ৯টায় বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে এবং সকাল ১০টায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ।

জাতীয় পার্টির কর্মসূচি : বুদ্ধিজীবী দিবসে জাতীয় পার্টি সকাল সাড়ে ৮টায় মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবে। এ সময় পার্টি চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের এমপি উপস্থিত থাকবেন।

এছাড়া বিজয়ের দিন ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৭টায় জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবে জাতীয় পার্টি। এদিন বেলা ১১টায় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয় মিলনায়তনে জাতীয় সাংস্কৃতিক পার্টি আলোচনাসভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করবে।

বেলা ৩টায় একই স্থানে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা পার্টি আলোচনা সভা করবে। দুটি কর্মসূচিতেই প্রধান অতিথি থাকবেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের।যুগান্তর।

Check Also

ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়

দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।