-ড. এম এ সবুর
১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবস। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। আমাদের জাতীয় গৌরবদীপ্ত-অহংকারের দিন। ১৯৭১ সালের এ দিনে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে মহান মুক্তিযুদ্ধ চূড়ান্ত সাফল্য লাভ করে। অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আমরা লাভ করি লাল সবুজের গৌরবান্বিত পতাকা। বিশ্ব মানচিত্রে অংকিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমারেখা। এ কারণে আজ মুক্ত-স্বাধীন দেশের নাগরিক আমরা। তাই গভীর শ্রদ্ধা জানাই বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি। যাদের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতা।
বাংলাদেশের মানুষ স্বভাবতই স্বাধীনচেতা। পরাধীনতার নাগপাশ তারা কখনই পছন্দ করে না। কিন্তু প্রাচীন কাল হতেই সবুজ-শ্যামল আর সম্পদে ভরপুর বাংলাদেশ বাইরের শক্তি দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে বার বার। ইতিহাস থেকে জানা যায় খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ১৫০০ বছর আগে আর্যরা ভারতে আক্রমণ চালায়। এ সময় তারা প্রায় সমগ্র ভারতে আধিপত্য বিস্তার করতে পারলেও প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলায় তা সক্ষম হয় নাই। এ সময়ে স্বাধীনচেতা ও নিজ কৃষ্টির গর্বে গর্বিত বঙ্গবাসীরা আর্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল প্রবলভাবে। ফলে করতোয়া পর্যন্ত এসেই তাদের অভিযান সমাপ্ত হয়। তবে সামরিক অভিযানে ব্যর্র্থ হয়ে তারা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালায়। মৌর্য বংশের শাসনকাল পর্যন্ত বঙ্গবাসীরা আর্য সাংস্কৃতিক আগ্রাসন হতে আত্মরক্ষা করতে পারলেও গুপ্ত বংশের শাসনামলে আর্যদের দোর্দন্ড প্রতাপ শুরু হয়। আর রাজা শশাঙ্কের শাসনামলে খ্রিস্টীয় সাত শতকের শুরুতেই প্রায় সমগ্র বাংলাকে আর্যাবর্ত করা হয়। এ শতকের শেষার্ধ থেকে আট শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত প্রায় একশত বছর মৎসন্যায়ের যুগে আর্যরা আরো শক্তিশালী হয়। তবে মৎসান্যয়ের অবসানের পর পাল শাসনামলের প্রায় ৪০০ বছর এ দেশের মানুষের নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চা চলে। পাল রাজাদের দুর্বলতায় দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক দেশীয় সেনরা এ দেশ দখল করার সুযোগ পায়। কিন্তু সেন শাসকেরা ভূমি দখল করতে পারলেও এ দেশের জনগণের মন জয় করতে পারে নাই। তাই সেন শাসনামলে সংস্কৃতিকে দরবারি ভাষা করা হলেও বাঙালিরা ‘বুলি’ বা বাংলা ভাষাকে ছাড়েন নাই এবং সেন শাসকদের তারা মনে প্রাণে গ্রহণ করেন নাই। এ কারণে দেখা যায় ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ১৮ জন সৈনিক নিয়ে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী লক্ষণ সেনের রাজসভা সহজেই দখল করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১২০৬ খ্রীস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর ইন্তিকালের পর থেকে ১৩৩৮ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত ১৩২ বছরে অন্তত ২৩ জন মুসলিম শাসনকর্তা বাংলাদেশ শাসন করেন। দিল্লীর মুসলিম সালতানাতের প্রতি এসব শাসকদের আনুগত্য ছিল নামেমাত্র। ১৩৩৮ সালে ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ সোনারগাঁয়ের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে সেই নামেমাত্র আনুগত্যের বন্ধনও ছিন্ন হয়। এরপর সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ (১৩৪২-১৩৫৮) ‘লাখনৌতি’ ও ‘বঙ্গদেশ’কে একত্রিত করে এই যুক্ত অঞ্চলকে নাম দেন ‘বাঙালাহ্’ এবং এর অধিবাসীদের নাম দেন ‘বাঙালি’। আর তিনি নিজে ‘শাহ-ই-বাঙালাহ্’ উপাধি ধারণ করে স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তার শাসনামল থেকে পরবর্তী দুই শত বছর বাংলাদেশ (বাঙালাহ্) সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিল। তাই এ সময়কালকে স্বাধীন সুলতানী শাসনামল হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়। তবে শের শাহের শাসনামলে (১৫৪০-৪৫) মাত্র পাঁচ বছর সুবহি বাঙালাহ তথা বাংলাদেশ দিল্লীর সাথে সংযুক্ত ছিল। এরপর থেকে ১৫৭৬ সালে রাজমহালের যুদ্ধে নিহত হবার আগ পর্যন্ত দাউদ খান কররানী স্বাধীন সুলতানরূপেই বাংলাদেশ শাসন করেন। আর ১৬০৮ সালের আগ পর্যন্ত বার ভূঁইয়াদের প্রতিরোধের মুখে বাংলায় মুঘলদের কর্তৃত্ব ছিল খুবই সীমিত। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর সুবাহদার মুর্শিদ কুলী খাঁ ১৭১৭ থেকে ১৭২৭ সাল পর্যন্ত প্রায় স্বাধীনভাবেই বাংলাদেশ শাসন করেন। তার পর থেকে নবাব সিরাজ উদ্দৌলাহ পর্যন্ত সকল নবাবই নামেমাত্র মুঘল কর্তৃত্বের অধীনে থেকে কার্যত স্বাধীন শাসক হিসেবে বাংলা বিহার ও উড়িষ্যা শাসন করেছেন। মীর জাফর, উঁমি চাঁদ, জগৎ শেঠ, ঘসেটি বেগম প্রমুখদের ষড়যন্ত্রে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আমবাগানে প্রহসনের যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাহ পরাজিত হন। আর অস্তমিত হয় বাংলার স্বাধীনতা সূর্য। তার পর ইংরেজ দখলদার বেনিয়াদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ দুইশ’ বছর আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালে পূর্বপাকিস্তান নামে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর দুঃশাসনের কারণে বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারে নাই। অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক নিপীড়ন, সাংস্কৃতিক গোলামীর জিঞ্জির দিয়ে বাঙালি জাতিকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিল তারা। কিন্তু স্বাধীনচেতা বাঙালিরা অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে বার বার। ’৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬৬ এর ৬ দফা, ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়। সর্বোপরি ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়।
ইতোমধ্যেই আমাদের স্বাধীনতা অজর্নের ৪৮ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। আজ বিজয় দিবসের ৪৯তম বার্ষিকী আর আগামী বছর পালিত হবে মহান বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী। অথচ কাক্সিক্ষত বিজয় আজও অর্জিত হয়নি। দেশের সাধারণ মানুষ যে স্বাধীন বাংলাদেশ কামনা করেছিলেন তারা এখনও তা পায়নি। মুক্তিকামী মানুষেরা যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন তা এখনও বাস্তবে রূপ লাভ করেনি। বরং সুশাসনের অভাবে রাজনৈতিক সংঘাত-সংঘর্ষ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, সাংস্কৃতিক বৈকল্য ও দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তৃতি হয়েছে। এক্ষেত্রে নেতৃত্বের ব্যর্থতাকেই বেশি দায়ী করা চলে। স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে সরকারি-বেসরকারি খাতে আমাদের দেশে পাহাড় পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে। লজ্জাকরভাবে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে একাধিকবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে এবং একাধিক সরকারের শাসনামালে। সব সরকারের শাসনামলেই স্বার্থবাদীরা আলো-অন্ধকারে দুর্নীতির মহোৎসবে হরিলুট করে নিজেদের ভাগ্যন্নোয়ন করেছে। অধিকন্তু বর্তমান সরকারের শাসনামলে দুর্নীতির ব্যাপকতা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করছে। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনীতি কতিপয় উচ্চভিলাসী সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীর হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। অভিযোগ আছে, সরকারের সাথে যোগসাজশে তারা নিজেদের ইচ্ছেমতো পণ্যের দাম বাড়িয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে। সরকারি মদদপুষ্টদের সাম্প্রতিককালের ক্যাসিনো সংস্কৃতি, করোনাকালের বিভিন্ন দান-অনুদান চুরি, বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি, বিভিন্ন দেশের সাথে বাণিজ্য ঘাটতি, বিমান-রেলসহ সরকারি বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক দুর্নীতি, অনিয়ন্ত্রিত বাজারব্যবস্থাপনার অস্থিরতা ইত্যাদি আমাদের অর্থনীতির অগ্রযাত্রাকে রোধ করেছে। আর মেহনতী ও নিরীহ মানুষদেরকে যথাযথ পাওনা থেকে বঞ্চিত করে দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। অথচ পাকিস্তান শাসনামলে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষের কণ্ঠ ছিল উচ্চকিত। এ কারণে ৬৬‘র ছয় দফার বেশীর ভাগই ছিল অর্থনীতি সম্পর্কিত। পাকিস্তান শাসনামলের ২২ পরিবারের অর্থনীতিকে বাংলাদেশের সকল মানুষের অর্থনীতিতে পরিণত করার প্রবল দাবি ছিল।
কৃষিক্ষেত্রে আমাদের অর্জন সীমিত। ফসল উৎপাদনের পরিমাণ বেড়েছে ঠিক কিন্তু খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়নি এখনও। কৃষিভিত্তিক নতুন শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা না করে পুরনোগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো বন্ধের প্রক্রিয়া চলছে। ইতোমধ্যে কিছু বন্ধ হয়ে গেছে। ‘প্রাচ্যের ড্যান্ডি’ নামে খ্যাত আদমজী জুট মিল এখন শুধুই ইতিহাস। শিক্ষা-সংস্কৃতি ক্ষেত্রেও আমাদের অর্জন আশানুরূপ নয়। শিক্ষার হার বাড়লেও বাড়েনি শিক্ষার মান। অধিকন্তু বেশির ভাগ শিক্ষিত লোক দুর্নীতিগ্রস্ত। ‘যে যত বেশী শিক্ষিত সে তত বেশী দুর্নীতিগ্রস্ত’ বলে জনসাধারণের বিশ্বাস। বাঙালি সংস্কৃতির অবস্থা খুবই করুণ। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতি। আগ্রাসন রুখে দেয়ার পরিবর্তে অনুগামী হবার প্রতিযোগিতা চলছে আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনে। সাম্প্রতিককালের উদ্ভট অপসংস্কৃতি তরুণ প্রজন্মকে বিপথগামী করেছে। ইন্টারনেট, ফেইসবুক, মোবাইলের মাধ্যমে অনৈতিক সম্পর্ক গড়া এবং অশ্লীলতা ছড়িয়ে দেয়ার সহজ পদ্ধতি আমাদের সংস্কৃতিকে কলুষিত করেছে। এ ছাড়া আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে চরম বৈরিতা বিরাজ করছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন নির্বাসিত। জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন প্রহসন মাত্র। আর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের শালীনতার অভাবে দেশের রাজনীতি চরম কলুষিত। জনকল্যাণ নয় বরং আত্মপ্রতিষ্ঠাই যেন বর্তমানের নেতৃবৃন্দের রাজনৈতিক আদর্শ। অধিকন্তু স্বাধীনতার প্রায় ৪ যুগ পরও স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ বিভাজন দেশের ঐক্য-সংহতি পরাহত। অধিকন্তু প্রতিবেশী দেশ দু‘টির কৌশলী আগ্রাসনে অনেকে আমাদের দেশের স্বাধীনততা-সার্বভোমত্ব বিষয়ে শংকিত। এমনিভাবে স্বাধীনতা অর্জনের চার দশক পরেও আমাদের কাক্সিক্ষত সামগ্রিক বিষয়ই প্রশ্নবিদ্ধ। তবে কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা অর্জিত না হলেও আমাদের সফলতা কম নয়। অনেক বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও শিক্ষার হার বেড়েছে, কমেছে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বেড়েছে মানুষের গড় আয়ু ও জীবন যাত্রার মান। এ সময়ে যোগাযোগের যুগান্তকারী উন্নয়ন হয়েছে, দ্রুত উন্নতি ঘটছে আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই Millennium Development Goal (MDG) বা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম হয়েছে এবং Sustainable Development Goal (SDG) বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ব্যক্ত করেছে। দেশবাসীর আশা সুশাসনের মাধ্যমে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি দুর্নীতিমুক্ত সুখী-সমৃদ্ধশালী ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত হবে। এতে বাংলাদেশের কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা অর্জিত হবে। তবে ‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা কঠিন’-এর বাস্তবতা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে।
Check Also
সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন এর আয়োজনে বিজয় দিবস পালন ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান
নিজস্ব প্রতিনিধি : সাতক্ষীরায় বিজয় দিবস উপলক্ষে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা,পুরুষ্কার বিতারণ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। …