প্রবৃদ্ধির কথা চিন্তা করলে বাংলাদেশের যে উন্নয়ন হয়েছে তা প্রশংসনীয়। তবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়। অন্যদিকে আয় বৈষম্যের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি কি দাঁড়াচ্ছে তা চিন্তার বিষয়। বাংলাদেশের ৫০ বছরে অর্থনীতিতে সামগ্রিক অর্জন নিয়ে মূল্যায়ন করতে গিয়ে ড. এবি মীর্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম এ কথা বলেন। দেশের প্রখ্যাত এ অর্থনীতিবিদ ২০০৭-২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন এবং সেখানকার উইলিয়ামস কলেজ থেকে উন্নয়ন অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ও বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ-ডি সম্পন্ন করেন। ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তার সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত মানবজমিন পাঠকের জন্য প্রকাশিত হলো-
মানবজমিন: স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে আমরা পদার্পণ করেছি।
স্বাধীনতা পরবর্তীতে পথচলার এই দীর্ঘ পরিক্রমায় অর্থনৈতিকভাবে আমরা কতোটা মুক্তি পেয়েছি? বাংলাদেশ সেই প্রত্যাশার জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছে কি?
মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম: একটা দেশের অর্থনীতি নানাভাবে বিশ্লেষণ করা যায়। প্রথমত অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি। অর্থনীতির অগ্রগতিতে প্রবৃদ্ধি একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। তবে এটাই একমাত্র সূচক হিসেবে ব্যবহার করা সঠিক হবে না। কেন না এর সঙ্গে আরো অন্য সূচকগুলোও দেখার প্রয়োজন আছে। এরমধ্যে বিশেষ করে স্বাধীনতা লগ্নে আমাদের দেশ দারিদ্র্যে জর্জরিত ছিল। আমরা দারিদ্র্য বিমোচন করতে পেরেছি এটা একটি বিষয়। তবে আরেকটা বিষয় হলো আয়-বৈষম্যের ক্ষেত্রে কি পরিস্থিতি দাঁড়াচ্ছে সেটাও চিন্তা করা দরকার। প্রথমত, আমরা প্রবৃদ্ধির কথা যদি চিন্তা করি, তাহলে বাংলাদেশের যে উন্নয়ন হয়েছে সেটা নিঃসন্দেহে প্রসংশনীয়। আমি যেটা দেখতে পাই যে, ১৯৮০ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রত্যেক ৫ বছরের পিরিয়ডে গড় প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৫ সালে গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৮ শতাংশ, ২০০০ থেকে ২০১০ এ গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০১১ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ছিল ৬ দশমিক ২ শতাংশ, এবং ২০১৬ থেকে ২০১৮তে এটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ।
এখন বিষয় হলো- এই প্রবৃদ্ধিকে ধরে রাখার জন্য আমাদের যেটা দরকার, সেটা হলো বিশেষ করে বিনিয়োগ। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের যে পরিস্থিতি সেটা সন্তোষজনক নয়। যদিও বিনিয়োগ বেড়েছে। জিডিপি’র আনুপাতিক হারে ২০০০ সালে এটা ছিল ২৪ শতাংশ, ২০১৮ সালে দাঁড়িয়েছে ৩১ শতাংশ, কিন্তু পরবর্তীতে এটা আবার কমে আসছে। এখানে আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো-বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ জিডিপি’র আনুপাতিক হার হিসেবে ২২ থেকে ২৩ শতাংশের মধ্যে গত এক দশক ধরে ঘোরাফেরা করছে। তাই বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়ানো অত্যন্ত প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বেশকিছু বাধাও আছে। সেই বাধা-বিপত্তিগুলো যতো দ্রুত সম্ভব সমাধান করা উচিত। এরমধ্যে ভৌতিক অবকাঠামোর ঘাটতি আছে, যোগাযোগসহ ইত্যাদি। এরপর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, সহিংসতা আপাতত নেই কিন্তু অনিশ্চয়তা তো আছে। আবার স্থানীয় পর্যায়ে কিছু কিছু সহিংতাও আছে, সুশাসনের আভাব এবং সুশাসনের যে সূচক আছে এগুলোর সব ক্ষেত্রেই আমাদের অর্জন আশপাশের দেশের তুলনায় বেশ নিচু পর্যায়ে। একইসঙ্গে বাংলাদেশের একটি বড় সম্পদ হলো মানবসম্পদ। টোটাল জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে এখানে ওয়ার্কিং এজ বা কর্মক্ষম অংশ অনেক কম। কিন্তু এই মানবসম্পদ ব্যবহারের জন্য যে শিক্ষার দরকার সেটাও আমাদের খুব সন্তোষজনক নয়। এই সমস্যাগুলো সমাধান করা দরকার আমাদের প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর ক্ষেত্রে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, প্রত্যাশা তো সীমাহীন। আর কোনো দেশেই কোনো সময়েই প্রত্যাশা পুরোপুরি অর্জন হয় না। মূল বিষয়টা হলো- আমরা প্রত্যাশার দিকে অগ্রসর হচ্ছি কি-না; ইতিবাচকভাবে এগিয়ে যাচ্ছি কি-না। সেই দিক থেকে আমি মনে করি আমরা ইতিবাচকভাবেই এগিয়ে যাচ্ছি তবে আমাদের বাধা-বিপত্তি আছে সেগুলো দ্রুত সমাধান করা উচিত।
মানবজমিন: করোনা মহামারিতে অর্থনীতি ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতির কথাও আমরা শুনছি। সবমিলিয়ে বর্তমানে দেশের অর্থনীতির সার্বিক পরিস্থিতি কেমন দেখছেন?
মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম: করোনায় দেশের অর্থনীতিতে বেশকিছু সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। এই মহামারিতে দেশের অর্থনীতির উপরে কয়েকটি প্রত্যক্ষ নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এর একটি হচ্ছে রপ্তানি। রপ্তানি খাতে বেশ বড় রকমের ধস নেমেছিল। সম্প্রতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু এখনো এক্সপোর্ট গ্রোথ ১ শতাংশের নিচে অবস্থান করছে। এই অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গ্রোথ হয়েছে ০.৯ শতাংশ। আর বিভিন্ন রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে ভবিষ্যতে এক্সপোর্ট গ্রোথ আরো ভালো হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। কারণ করোনার সেকেন্ড ওয়েভ চলছে। অনেক দেশ অর্ডার স্থগিত করছে। অনেকে আবার অর্ডার সাপ্লাই নিলেও পেমেন্ট স্থগিত করছে। অন্যদিকে রেমিট্যান্স বেড়েছে বেশ বড় মাত্রায়। এর পেছনে একটি কারণ হচ্ছে যে, যারা বিদেশে ছিল তারা তাদের সঞ্চিত অর্থ দেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ফলে রেমিট্যান্সের গ্রোথ ভালো আছে। তবে এটাও আমার মনে হয় কমে আসবে। কেন না যারা ফিরে আসছেন তারা খুব একটা কর্মস্থলে যেতে পারবেন বলে মনে হয় না। তো এটাও আমাদের জন্য বড় অভিঘাত। কারণ রেমিট্যান্স দারিদ্র্যবিমোচনের ক্ষেত্রে বেশ ভালো ভূমিকা পালন করে থাকে। আরেকটি বিষয় হলো- অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে আমাদের বেশ বড় মাত্রায় ক্ষতি হয়েছে। সাধারণত মানুষ গ্রাম থেকে শহরে আসে আয়- রোজগারের জন্য। কিন্তু করোনার সময়ে উল্টো হয়েছে; মানুষ কাজ হারিয়ে শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে যাচ্ছে। এই যে, শহরাঞ্চল থেকে গ্রামমুখী মাইগ্রেশন হচ্ছে, তাদেরকে উৎপাদনশীল খাতে কীভাবে কাজে লাগানো যাবে এবং গ্রামাঞ্চলে কী উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ড সৃষ্টি করা যায়- সেটাও আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ।
মানবজমিন: করোনায় দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সরকার এসব উদ্যোক্তা ও বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করেছিল। এ বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?
মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম: ক্ষুদ্র মাঝারি ও কুটির শিল্পের জন্য যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছিল, এটার বিতরণের যে গতি সেটাইতো অত্যন্ত শ্লথ। কেন না মিডিয়ার রিপোর্টে যেটা দেখতে পাচ্ছি, এই খাতে যে প্রণোদনা দেয়া হয়েছিল এখন পর্যন্ত তার মাত্র ৪০ শতাংশের নিচে বিতরণ করা হয়েছে। অন্যদিকে বড় বড় শিল্প যেগুলোতে যা ধরা হয়েছিল তার ৮০ শতাংশ বিতরণ হয়েছে। প্রথম কথা হলো বিতরণ নিশ্চিত করতে হবে। এখন এই মূল দায়িত্ব তো পড়েছে ব্যাংকের উপরে। আর ব্যাংকগুলোর নানা কারণে ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পের লোকদের সঙ্গে ব্যবসা করতে অনিহা আছে। আবার এই সমস্ত ব্যবসায়ী ব্যাংকে আবেদনের জন্য যে প্রক্রিয়া আছে সেগুলো তারা পুরোপুরিভাবে পারে না। তো প্রথম কথা হলো, বিতরণের গতি বাড়াতে হবে, দ্বিতীয়ত যাদেরকে দেয়া হচ্ছে তারা আইডিয়ালি ডিজার্বিং কি-না।
মানবজমিন: দেশের বড় একটি সংখ্যার মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। আবার একশ্রেণির লোক খুব দ্রুতই ধনী হয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক এই বৈষম্য কি চলতেই থাকবে?
মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম: প্রথমত, অর্থনৈতিক বৈষম্য আমাদের দেশে বেড়ে যাচ্ছে। বৈষম্য বাড়ার একটা পরিমাপ আছে সেটার মাত্রা অতিক্রম করে এখন বিপদসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছে। প্রবৃদ্ধি যেমন বেড়েছে তেমনি বৈষম্যও বেড়েছে। বৈষম্য দূরীকরণে দুই দিকে ব্যবস্থা নিতে হবে। এক হচ্ছে- সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে। আমি এটা ২০০৮ সালের বাজেটে অনেকটা বাড়িয়েছিলাম। এরপর এটা আর বাড়েনি বরঞ্চ কিছুটা কমে গিয়েছিল। যদিও সাম্প্রতিককালে কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। তবে যাই হোক সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আরো বেশি লোক আনতে হবে; এবং এক্ষেত্রে যে ঋণ দেয়া হয় সেই অনুদানের পরিমাণও বাড়াতে হবে। এর সঙ্গে আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- এর সুষ্ঠু বিতরণ ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত তীব্রভাবে অনুভূত। কেন না এক্ষেত্রে অভিযোগ আছে কয়েক ধরনের। একটি হলো- যারা পাওয়ার যোগ্য নয় তারা পায়। যারা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী অথবা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে যারা পাওয়ার যোগ্য নয় তারা পায়। অন্যদিকে যাদের পাওয়া উচিত তারা বঞ্চিত হয়। কারণ তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকে না। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে তো সরাসরি তছরুপ হয়। আমরা কিছুদিন পর পর মিডিয়ায় দেখি যে, সরকারি চাল ওখানে বিক্রি হচ্ছে সেখানে বিক্রি হচ্ছে। তো এগুলো ঠিক করতে হবে। আর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে।
মানবজমিন: পদ্মা সেতু দেশের অর্থনীতিতে কী ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে?
মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম: প্রথম কথা হলো- পরিবহন খরচ কমে যাবে। বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে। এখন সেতু হওয়ার পর ঐ অঞ্চলে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান হতে পারে। এতে স্থানীয়ভাবে এই অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থান হতে পারে। এছাড়া এ অঞ্চলের উৎপাদিত পণ্য অপেক্ষাকৃত কম খরচে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় পাঠাতে পারবে। এতে তাদের উৎপাদিত ফসলের ভালো মূল্য পাবে। এছাড়া আন্তর্জাতিক ব্যবসার ক্ষেত্রেও কিছুটা সহজতর হবে। সবমিলিয়ে নিঃসন্দেহে এটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এতে প্রবৃদ্ধিও বাড়বে।
মানবজমিন: ব্যাংক খাতের অস্থিরতার কথা অনেকদিন ধরেই আমরা শুনে আসছি। এ সম্পর্কে আপনার সার্বিক পর্যবেক্ষণ কি?
মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম: ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। অনেকদিন ধরেই চলছে। আমাদের দেশে যেটা হচ্ছে যে, ঋণখেলাপি যারা তাদেরকে একটার পর একটা সুবিধা দেয়া হচ্ছে। একদিকে সুদের হার কমানো হলো, দ্বিতীয়ত, ঋণ পরিশোধ করেনি কিন্তু ঋণখেলাপি সেটা বলা যাবে না। ঋণখেলাপি হলে ব্যাংগুলো যে প্রভিশন রাখতো সেটা আর রাখতে পারছে না, কারণ যারা আসলেই খেলাপি কিন্তু কাগজে-কলমে তাদের খেলাপি দেখানো হচ্ছে না। এজন্য অনেক ব্যাংকেরই ফাইন্যান্সিয়াল ভায়োবিলিটি নিয়ে প্রশ্ন আছে। এটা নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। ব্যাংক কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে সেটাও আমি সমর্থন করি না। তার কারণ হলো, এই যে, সমস্যাগুলো এগুলো সমাধান না করে ব্যাংক কমিশন করে কোনো লাভ হবে না।