সাতক্ষীরাসহ উপকূলে গ্রামের পর গ্রাম ফাঁকা হচ্ছে:গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন

জলবায়ু পরিবর্তন আর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে অসংখ্য মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন। একের পর এক গ্রাম ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। মানুষ পিতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে কোনো না কোনো শহরে আশ্রয় নিচ্ছে। এসব নিয়ে অনলাইন গার্ডিয়ান একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে- ফারুক হোসেন যে বাড়িতে বড় হয়েছেন, ৬ মাস ধরে সেই বাড়ি পানির নিচে। গ্রামের আরো যেসব বাড়ি ছিল সবই এক অবস্থায়। ধীর গতিতে পানি যখন নামতে শুরু করে ফারুক ফিরে যান বাড়িতে। দেখতে পান তার বাড়ি বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার চাকলার কাছে আরো গ্রাম এখনও পানির নিচ থেকে উঠে দাঁড়ায়নি। সুপার-সাইক্লোন আম্ফানে সেখানে বন্যা সৃষ্টি হয়। সেই পানিতেই আটকে আছেন তারা। ওই আম্ফান মে মাসে দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে তছনছ করে দেয়। ফারুক হোসেনের বয়স ৫৬ বছর। তিনি গ্রাম ছাড়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন। কৃষিকাজ করতেন তিনি। সেই পেশাও ত্যাগ করেছেন। এখন কাছাকাছি শহর খুলনায় একটি ছোট্ট ঘর ভাড়া নিয়ে সেখানে বসবাসের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি বলেছেন, পিতৃভূমি ছেড়ে যাচ্ছি চিরদিনের মতো। আমার অন্য চার ভাইও একইভাবে এখানে বসবাস করেছেন কয়েক দশক আগে। ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমরা এই জায়গা ছেড়ে যেতে পারিনি। আমার অন্য ভাইয়েরা অনেক আগেই ছেড়ে গেছেন। সর্বশেষ আমিও যাচ্ছি। ৬ মাস ধরে পিতৃপুরুষের ভিটায় বসবাস করেছি মারাত্মক সব জটিলতার মুখে। আস্তে আস্তে গ্রামগুলোকে গিলে খাচ্ছে নদী। শেষ পর্যন্ত আমি তা রক্ষা করতে পারছি না।

সাইক্লোন ভোলা’র ৫০ বছর পূর্তি হয়েছে গত মাসে। ওই সাইক্লোনে মারা গিয়েছিলেন কমপক্ষে তিন লাখ মানুষ। যদিও সম্প্রতি মৃতের সংখ্যা কমেছে, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ গ্রামবাসীকে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে দিচ্ছে না। সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলার উপকূলীয় অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষই গৃহহীন। খুলনার প্রতাপনগর এলাকায় ১৮টি গ্রামের সবটাই পানির নিচে। বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ বলেছে, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তিন লাখ মানুষ। স্থানীয় এনজিও লোকাল এনভায়রনমেন্ট ডেভেলপমেন্ট এন্ড এগ্রিকালচারাল রিসার্স সোসাইটির এক জরিপ মতে, এখনও বাস্তুচ্যুত ৫০ হাজার মানুষ। আম্ফানের পর এসব মানুষ সরকারি জমিতে বসবাস করছেন। না হয় নদীর পাড়ে বসবাস করছেন। না হয় সড়কের পাশে অথবা সাইক্লোন আশ্রয়শিবিরে। অনেক মানুষ পাশের কোনো গ্রামে অথবা শহরে চলে গিয়েছেন।

কেউ কেউ একটু শুকনো জমিতে সরে গেছেন। তারা সেখানে কুড়েঘর বা কোনোমতে একটু বসতি গেড়েছেন। যখন কোভিড-১৯ বিভিন্ন শহরে এবং বিদেশে অভিবাসীদের উপার্জনে আঘাত হেনেছে, তখন আম্ফান আরো বেশি অর্থনৈতিক ক্ষতি করেছে প্রান্তিক এসব মানুষের। ধান রোপন ও কাটার দুটি মৌসুম এরই মধ্যে পাড় হয়ে গেছে। যেসব পুকুরে মাছ চাষ করে গ্রামবাসী টিকে থাকতেন তা ধ্বংস হয়ে গেছে। চিংড়ি ঘেরগুলোরও একই অবস্থা। যেসব পরিবহনে করে দূরের বাজারে পণ্য পৌঁছে দেয়া হতো সেই পরিবহনের চালক তার গাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন। তারা নৌকার মধ্যে বসবাস করছেন। কুড়িকাহনিয়া গ্রামের শাহজাহান মোড়ল (৪৫) বলেন, আমি কৃষিকাজ করতাম। ধান লাগাতাম। তাতে ভাল ধান হতো। কিন্তু সেইসব জমি এখন পানির নিচে। এখন সেই ধানক্ষেতের ভিতর দিয়ে নৌকা চালাই। নৌকায় যাত্রী পরিবহন করে দেই একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। তাতে ১০০ থেকে দেড়শ টাকা আয় হয়। এত কম উপার্জন দিয়ে পরিবার চালাতে পারি না।

ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের পরিচালক আলেকজান্দ্রা বিলাক বলেন, একই সঙ্গে করোনা ভাইরাস মহামারি ও সাইক্লেন এই সংকটকে জটিল সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। যদি বাস্তুচ্যুতের তথ্য যথাযথভাবে পাওয়া যেত তাহলে টেকসই সমাধান বের করা সহজ হতো। এছাড়া টেকসই গৃহায়ন ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। টেকসই নগরায়ন গড়ে তুলতে হবে। আর্থ সামাজিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাস্তুচ্যুত হওয়ার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনা যেতে পারে।

বাংলাদেশ তার বন্যা সতর্কীকরণ ব্যবস্থার উন্নতি করেছে। ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে এমন কৌশলের প্রশংসা করেছে জাতিসংঘ। তবে এতেই সব শেষ হয়ে যায় না বলে মনে করেন অনেকে। কয়রা সদর এলাকার স্থানীয় কাউন্সিলের প্রধান হুমায়ুন কবির বলেন, বার বার ঝড়ের কারণে ১৯৬০ এর দশকে তৈরি করা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এগুলো মেরামতের জন্য সরকারি দপ্তরে যোগাযোগ করা হয়েছে। কিন্তু কোনো জবাব মেলেনি। কুড়িকাহনিয়া গ্রামের আবদুস সাত্তার গাজী বলেন, ১৯৮৬ সাল থেকে এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে আসছি। আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসে। আর আমরা নিঃস্ব হই। এভাবেই আমরা বেঁচে আছি।যদি শক্তিশালী বাধ থাকতো তাহলে এই সমস্যা হতো না। তিনি ও তার স্ত্রী জাহেরা খাতুন যে বাড়িতে বসবাস করেন তা একেবারেই নদীর কিনারে।

সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার আবুল খায়েরের মতে, তহবিল চেয়ে আবেদন অনুমোদন হয়নি। ফলে বাধ্য হয়ে তারা বার্ষিক বাজেটের অর্থ দিয়ে কোনোমতে মেরামত কাজ করেন। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদী বন্যায় এসব অঞ্চলের মানুষ পাড়ি দিচ্ছেন ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোতে। এর ফলে বাড়ছে বস্তির পরিধি। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ এন্ড ডেভেলপমেন্ট-এর পরিচালক সলিমুল হক বলেছেন, আমরা দুর্যোগের আগে লাখ লাখ মানুষকে সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছি। এতে প্রচুর মানুষের জীবন রক্ষা করা গেছে। কিন্তু মানুষজন এখনও তাদের বাড়িঘর, জমিজমা ও জীবিকা হারাচ্ছেন। ঘূর্ণিঝড়ের পরে সহায়তায় ঘাটতি আছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে নিম্ন উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষগুলো জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে ধীরে ধীরে তাদের জীবনজীবিকা হারাবেন। কৃষক, জেলে তাদের কাজ হারিয়ে বাধ্য হয়ে বাস্তুচ্যুত হবেন। এ জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সরকারগুলোর সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন।

Check Also

সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন এর আয়োজনে বিজয় দিবস পালন ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান

নিজস্ব প্রতিনিধি : সাতক্ষীরায় বিজয় দিবস উপলক্ষে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা,পুরুষ্কার বিতারণ ও আলোচনা সভা  অনুষ্ঠিত হয়েছে। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।