ছড়া/কবিতা
ঘোরে–অঘোরে
–কে জি মোস্তফা
সুপ্রভাত,
রূপবতী আলো আমাকে সুগভীর ঘুম থেকে
জাগিয়ে তোলে
আমি টের পাই আমার ঠোঁটের কোণে
আনন্দের চিহ্ন, জিহ্বায় দুর্বোধ্য বাক্য-
যা হয় একটা কিছু কর।
অসংখ্য অলীক কল্পনায়
মাথা আমার বোঝাই হতে থাকে
কল্পনা আনন্দে ভরা
জীবনে যা কিছু আমার আদরণীয়
পাপ, পবিত্রতা, লোভ ও লালসা
এমনকি ভালোবাসার ব্যর্থতা
সবকিছুর ওপর বিরাজ করছে উল্লাস।
বালিশের ওপর মাথা রেখে আমি
কথা বলি, কথা বলি নিজের সঙ্গে
টের পাই বিভ্রান্ত মনের বিচ্ছিন্ন ধারণাগুলো
বিছানার চারদিকে নেচে নেচে
আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে এই বলে-
এমন একটা লোক দেখাও
যে প্রকৃতই সুসম্পন্ন।
জীবনের কাসিদা
–আবদুল হালীম খাঁ
জীবনটা খুব সুন্দর নিশ্চয়
কিন্তু বড়ই ছোট মনে হয়।
সকাল হতে না হতেই বিকাল যেন
জানি না এমন মনে হয় কেন!
ছোট এ জীবনে শত বেদনা বিরহ
দুঃখ শোক বঞ্চনা অহরহ।
না পাওয়ার কত অনুক্ত রণম
দিনরাত হৃদয় করে দহন।
কী চেয়েছিলাম পেলাম না কী যে
ভেবে তা গোপনে চোখ যায় ভিজে
হৃদয়ে কত শত বেদনার ঢেউ
কভু জানলো না দেখলো না কেউ।
বুক ভরা শুধু কষ্ট দলা দলা
কারো কাছে কভু গেল না বলা।
সারা অঙ্গে যেনো শত বিষ মাখা
এই কী জীবন এই কী বেঁচে থাকা।
প্রিয় স্বদেশ
–শরীফ আবদুল গোফরান
ঘোর অন্ধকারে ঢেকে গেছে
স্বদেশের সুনীল আকাশ
রুদ্ধশ্বাস হয়ে আছে সবুজাভ তরুলতা
পাহাড় নদী আর দরিয়ার গর্জন
ঝুলন্ত আকাশের মেঘগুলো
নিশ্চল হয়ে গেছে
স্তব্ধ বেদনায় তাবৎ নিসর্গ প্রকৃতি
শুষ্ক পদ্মার চরের উপর দিয়ে
উড়ে যেতে যেতে সুখ পাখিরাও এখন
দৃষ্টি মেলে দেখে শৈশব স্মৃতি
আর সবুজাভ ছায়াবীথি
অশ্রুঝরা চোখে ডানা উঁচিয়ে বলে-
বিদায়। বিদায় বন্ধু
প্রিয় স্বদেশ আমার
তোমায় বিদায়।
পথ চলায় মুক্তি
–মুহাম্মদ রেজাউল করিম
কোথায় যাবে কোন প্রান্তে
সবখানে তিনি আছেন
জ্বলে তার আলো
খুঁজে ফিরো পথ
পথতো তার দেয়া পথ
ওই পথেই চলো নির্ভীক
যদি ক্লান্তি আসে
তবে প্রার্থনা করো তাঁর কাছে
ঘুঁচে যাবে হতাশার আলো
আবার পথ চলো
পথ চলায় শান্তি
পথ চলায় মুক্তি।
বাতাসের প্রতিকূলে
–হেলাল আনওয়ার
নিদ্রাহীন রাতগুলো বেশুমার বিমর্ষতা
আঙ্গিনায় জমে থাকা পাথর চাপা ঘাসের মতো
বেদনার শৈশব কৈশর নিমগ্ন বিমূঢ়তা
মেঘের স্বাদহীন জলের জলামগ্ন শতদল।
আমার জীবনও ছিলো স্বাদহীন
আমার শৈশব কৈশর ছিলো গন্ধহীন
শুকনো হাসিতে ছিলোনা প্রেমের পরশ
এভাবেই জীবন আমার-
এভাবেই বেড়ে ওঠা-
এভাবেই পার হয় পঞ্চাশের সিঁড়ি।
এখন ক্লান্ত আমি লাঙলী চাষির মতো
কেবল বার বার শূণ্যে চাহনী-সূর্যের দিকে
অস্তের প্রতিক্ষায় থাকা রাখাল যেন।
বিভৎস উৎসবে মেতে আছে স্বপ্ন শালুক
আরিক্ত রোদনে রোষাণল ছিটিয়ে
ক্রমাগত পার হয় স্বাপ্নিক সময়।
তবু আমি ছুটছি নিরন্তর বাতাসের প্রতিকূলে।
ছেড়া ভালোবাসা
–মাহতাব উদ্দিন
গহীন আঁধারে ঢেকে গেছে স্বপ্নের ধরণী
শান্ত পিলসুজে মিটমিট করে জ্বলে জ্ঞানের লণ্ঠন
ঘোর ঠেলে আলোকচ্ছটার ব্যর্থ আগোয়ান
মানব-পশুর হিংস্র ঝড়ে পরিশেষে নিভে যায়।
দানবীয় ঝড়- জলোচ্ছ্বাসে উবে যায় হাড্ডিসার মনুষ্যত্ব
সব হারিয়ে ভাগ্যেরা হালে দুর্গত অঞ্চলের বাসিন্দা
মুমূর্ষু প্রাণ বাঁচাতে দুর্লভ ত্রাণের খুঁজে কায়ক্লেশে মানবতা
চরণে শিকল-পরা রোদ পঙ্কিল দুঃখকে শুকাতে আসে না।
বাঘের কবল থেকে বেঁচে গিয়ে অসহায় হরিণীরা-
নামধারী কুলীনের পাশবিক অভিলাষে বন্দি
উত্তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে সহসা পতিত যেন
ছেঁড়া ভালোবাসা শুধু হাতছানি দেয় অবলারে।
তামাটে মানুষের সংগ্রাম
–জয়নুল আবেদীন আজাদ
জনপদে রোদে পোড়া ঘামে ভেজা
তামাটে মানুষ আমরা
অবিরাম সংগ্রাম যেন নিয়তি আমাদের।
পূর্বপুরুষরা ভিটেমাটির জন্য লড়েছেন
আমরা লড়েছি স্বাধীন পতাকার জন্য,
এসব লড়াই অস্তিত্বের মতো মৌলিক
শুধু ঘাম নয়, রক্তও ঝরেছে অনেক
তবুও লড়ে গেছি আমরা-
মাটি ও মানুষকে ভালোবেসে
অন্তর্গত নিগূঢ় বিশ্বাসে।
বাংলার তামাটে মানুষ আজন্ম লড়াকু
বাতাসের বিপরীতে ওরা টানে গুণ
পেশীর বলে বায় বৈঠা,
লাঙলের সঙ্গিনে বিদীর্ণ করে জমিন
ফলায় ফসল, ক্ষুধার অন্ন।
প্রকৃতির সুরে এবং ছন্দে
বেঁচে থাকে ওরা,
বেঁচে থাকে নীলকর বিরোধে
বিদ্রোহের কবিতায়।
সব মানুষ হয় না মানুষ,
সংগ্রামী কৃষকের বহু সন্তান আজ
কক্ষচ্যুত সুবিধাভোগী
দেশ বিদেশ ঘুরে চাতুর্যে চৌকস,
ওদের ক’জনা আজ শিকড়-সন্ধানী
কিংবা কৃতজ্ঞ ভূমিপুত্র?
তামাটে চামড়ায় মেখেছে প্রসাধন
হৃদয় জমিনে ভোগের দূষণ
সংশয়ে অস্থির ওদের বুদ্ধির ভুবন।
পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি কিংবা
লোকজ আহারে-বিহারে
ওদের নেই কোন রুচি,
বাংলার পলিমাটি নদীর কূল
টানে না ওদের,
বটের ছায়ায় দু’দণ্ড বসেনি কখনো-
কী করে গাইবে ওরা দেশের গান?
পিতৃপুরুষের দু’হাত আজ তাই ঊর্ধ্বমুখী
ওদের সুমতির জন্য জানায় প্রার্থনা
আত্মবিশ্লেষণের এই কঠিন দিনে।
বাওকুড়ানি
–আহসান হাবিব বুলবুল
বাঁশের খুঁটি দিয়ে তৈরি আমার ঘর
ছনের ছাউনি দেয়া দোচালা
রাতের শিশির ঝরে ঘরের চালে
জোছনা এসে মুক্তো ছড়ায় পলে পলে।
অপরূপ সুষমা জাগে ঘুমের ভিতর
ধন্য ধান্যে পুষ্পে ওঠে ভরে
স্বপ্নের পরীরা এসে ভিড় করে
শান্তির শ্বেতপত্র হাতে দলে দলে।
উত্তরে হিম চলে গেছে বেশ আগে
এখন বসন্ত, দখিনা বাতায়নে
মায়াবী পর্দায় কাঁপন তোলে
হঠাৎ শিহরণ, আকাশ ভরে নীলে নীলে।
ওঠে বাওকুড়ানি; কিন্তু
কালবৈশাখী আসতে ঢের দেরি
খাপে মোড়ানো তরবারি
আমার ঘরখানি দোলে দোলে!
প্রিয় ভূমি ফিরে ফিরে ডাকে
স্বপ্ন বিভোর করে সময়ের বাঁকে
চোখ রগরানো ঝাপসা কাটে
প্রেমের জোয়ার আসে দিলে দিলে!!
কিছু হতে পারিনি
–আবুল খায়ের নাঈমুদ্দীন
কুসুমের মতো শ্রেষ্ঠ শ্রোতা হতে পারিনি
ওকে বুঝতেও পারিনি হাজার বছর
তাই কারো আপনও হতে পারিনি।
শিরিনের হৃদয় ভাঙা কষ্ট বুঝিনি বলে,
তাকে নিয়ে লিখতে পারিনি,
তাই মানুষের দুঃখও বুঝিনি।
শাহীনের মতো বিচক্ষণ হইনি বলে
তার লাবণ্যময়ী হাসি দেখিনি তাই