আবু সাইদ বিশ্বাস:সুন্দরবন ফিরে: বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে বিশ্ব-ঐতিহ্য সুন্দরবনের বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার বিলুপ্ত হতে পারে৷ সুন্দরবন বিভাগের তথ্য মতে, ২০০১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৪৮টি বাঘ মারা গেছে। এর মধ্যে ২২টি সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগে এবং ১৬টি পশ্চিম বিভাগে মারা যায়। এ সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ১০টি বাঘের চামড়া ও হাড়গোর উদ্ধার করে। ১১৪টি বাঘ নির্ধারন করার পরে বনের পূর্ব বিভাগের গত বছরের ২০ আগষ্ট কচিখালীতে ১টি, চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারী কুকিলমনির কবরখালীতে ১টি ও ১১ জুলাই পশ্চিম সুন্দরবনের আন্দারমানিক এলাকায় ১টি বাঘ মারা যায়। ২০১৭-২০১৮ বাঘশুমারিতে সেখানে ১১৪টি বাঘ শনাক্ত করা হয়। যেখানে সুন্দরবনে ২০০৪ সালে ছিল ৪৪০টি বাঘ । সারা বিশ্বে বাঘের সংখ্যা এখন মাত্র ৩ হাজার ৮৯০টি, যা একশ বছর আগে ছিল এক লাখের মতো। যাদের উল্লেখযোগ্য অংশের আভাস ছিল সুন্দরবন। ফলে প্রবৈচিত্র আজ হুমকির সম্মুখীন।
অষ্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের করা ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনের বিপন্ন বাঘ’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়, ক্রমাগত সাগরের পানি বাড়ার কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত সুন্দরবনের বাসিন্দা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে৷ গবেষণার পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে, আগামী ৫০ বছরে, অর্থাৎ ২০৭০ সালের মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল সুন্দরবন বিলুপ্ত হয়ে যাবে৷ অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী ড. শরিফ মুকুল বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশ এবং ভারত মিলিয়ে সুন্দরবনের ১০ হাজার কিলোমিটারের বেশি এলাকা নিয়ে গঠিত প্যারাবনটি সারাবিশ্বে সুন্দরবন হিসেবে পরিচিত৷ এটিই পৃথিবীর একক বৃহত্তম প্যারাবন৷ তবে এখানে বাঘদের টিকে থাকার জন্যে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে৷’’তার মতে, বন ধ্বংসের পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের বাইরে অন্যান্য কারণ হলো, বনাঞ্চলের পাশে কলকারখানা স্থাপন, রামপালের বিদ্যুৎ প্রকল্প, নতুন রাস্তাা তৈরি এবং নির্বিচার শিকার৷ তিনি বলেন, ‘‘একদিকে মানুষের আগ্রাসন এবং অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তন বাঘের আবাসস্থলকে সঙ্কটাপন্ন করে ফেলেছে৷’’ তবে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার নিয়ে পিএইচডি করেছেন এমন দু’জন গবেষক সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন, শুধু বৈশ্বিক জলাবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে এমন ধারণাকে পূর্ণ গবেষণা বলা যাবে না৷ এখানে বাঘ বিলুপ্তির সঙ্গে আরো অনেক কিছুই জড়িত৷ সেগুলো যদি মোকাবেলা করা যায়, তাহলে বিলুপ্ত না-ও হতে পারে৷ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট কিন্তু সি লেভেল অনুযায়ী নিজেকে মানিয়ে নেয়৷ সি লেভেল বাড়লে সুন্দরবন হয়ত ল্যান্ডের দিকে সরে যেতে পারে৷ বা উত্তর দিকেও সরে যেতে পারে৷ তারা জানান আজকে সুন্দরবন যেখানে আছে, ৫০০ বছর আগে তো এখানে ছিল না৷ যদি সুন্দরবন থাকে, তাহলে কিন্তু বাঘ থাকবে৷
বাঘ নিয়ে পিএইচডি করা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের আরেকজন অধ্যাপক ড. আব্দুল আজিজ বলেন, ‘‘৫০ বছর পর কী হবে সেটা এখনই বলা মুশকিল৷ আসলে বাঘ বেঁচে থাকার জন্য জরুরি বিষয় হল তার খাবার এবং আবাসস্থল৷ খাবারের ৮০ ভাগই আসে চিত্রা হরিণ থেকে৷ আর ১৫ ভাগ আসে ওয়ার্ল্ড বিট থেকে৷ এই চিত্রা হরিণ-শিকারীদের প্রধান টার্গেট৷ এটাকে যদি বাঁচিয়ে না রাখা যায়, তাহলে বাঘও বাঁচানো যাবে না৷’’
চলতি মাসে চার দিন সুন্দরবন ঘুরার অভিজ্ঞগতার আলোকে বলতে পারি সুন্দরবনে কোথাও বাগের আনাগোনা চোখে পড়েনি। জেলে বাওয়ালিরাও বাঘকে ভয় পাচ্ছে না। কারণ গত ৫ বছরের মধ্যে বাঘে মানুষ ধরে খেয়েছে এমনটা হয়নি বললেই চলে। বন সংশ্লিস্টরা ও জেলেরা জানান,সুন্দরবনে চিত্রা হরিণের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কারণে বাঘের খাবারের বাড়তি প্রয়োজন হয়না। এছাড়া ডাকাতের সংখ্যাও কমে গেছে । আসলে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে নাকি বাঘ বিলুপ্তি হচ্ছে তা ২০২১ সালের গননার পরই বলা যাবে।
কনজারভেশন গ্রুপ ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে৷ ২০১৬ সালে তাদের প্রকাশ করা তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে বাঘের সংখ্যা ছিলো ৩২০০, আর বর্তমানে ৩৯০০৷ ভারত, রাশিয়া এবং নেপালে ডাব্লিউডাবিব্লউএফ এর কার্যক্রমের জন্য বাঘের সংখ্যা বেড়েছে৷
জেলে মৌয়ালদের বরাত দিয়ে বন বিভাগ বলছেন, লকডাউনের মধ্যে পর্যটকদের পদচারনা বন্ধ থাকায় বাঘের বিচারন লক্ষ করা যাচ্ছে। তাদের প্রজনন ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা না থাকায় ইতিমধ্যে বাঘের সংখ্যা আগের তুলনায় বাড়তে পারে বলে ধারনা তাদের । “বাঘ সংরক্ষণ” নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, প্রকল্পটি চালু হলে ২০২১ সালের নতুন করে বাঘ গননা ও এর সংরক্ষনে কাজ শুরু করবে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ।
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, ‘বাঘসহ বন্যপ্রাণী শিকার প্রতিরোধে সুন্দরবনের মধ্যে জিপিএস সিস্টেমের সাহায্যে চলছে ‘স্মার্ট পেট্রোলিং’। বন বিভাগ, পুলিশ, র্যাব, কোস্ট গার্ড ও নৌ পুলিশ যৌথভাবে বাঘ শিকার প্রতিরোধে কাজ করছে। বাঘ রক্ষা ও সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বন বিভাগ সচেষ্ট রয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অসুস্থ বাঘকে সেবাদানের জন্য খুলনায় একটি ‘ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টার’ স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া লোকালয়ে আসা বাঘ রক্ষায় সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামগুলোতে ৪৯টি ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম গঠন করা হয়েছে।’
বেঙ্গল টাইগারসহ বিশ্বখ্যাত ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন বিলুপ্ত হয়ে গেলে গোটা বাংলাদেশের প্রাকৃৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। বহুলাংশে বাড়িয়ে দেবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকের আশংকা। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে প্রচন্ড তির সম্মুখীন হবে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের সুন্দরবন বলেও উল্লেখ করেন বিষেশাজ্ঞরা।
Check Also
আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি
এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …