করোনার অভিযোগ তুলে শ্রীলঙ্কায় মুসলিমদের পুড়িয়ে মারা হচ্ছে: বিবিসি

শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে গত ৯ ডিসেম্বর ২০ দিনের এক নবজাতক মুসলিম শিশুকে বাবা-মায়ের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও দাহ করা হয়েছে। এ ঘটনায় শ্রীলঙ্কায় মুসলিমদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এ ব্যাপারে শ্রীলঙ্কা ছাড়াও বিশ্বের আরো অনেক দেশ ক্ষোভ ও নিন্দা প্রকাশ করেছে বলে জানা গেছে।

করোনায় মারা গেলে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষ সকলের লাশ পুড়িয়ে ফেলার সরকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে শ্রীলঙ্কার সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তাদের কথা, প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের সরকার মুসলমানদের ধর্মীয় স্পর্শকাতরতাকে ইচ্ছাকৃতভাবে অবজ্ঞা করছে।

জানা যায়, দেশটিতে এখন পর্যন্ত করোনায় মারা যাওয়া ১০৭ জন মুসলমানকে জোর করে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। মারা যাওয়া শেখ নামের শিশুটিকে করোনায় আক্রান্ত সন্দেহে জোর করে দাহ করার ঘটনা মুসলিমদের ক্ষোভকে আরো উস্কে দিয়েছে।

কলম্বোর যে ক্রিমেটোরিয়াম বা দাহ করার স্থানে শিশুটিকে পোড়ানো হয়, সেখানে মুসলিমরা রোববার দলে দলে হাজির হয়ে গেটে সাদা ফিতা ঝুলিয়ে দেয়। সারা শ্রীলঙ্কা জুড়েই অনেক মুসলমান তাদের দরজা-জানালার দেয়ালে সাদা ফিতা বেঁধে প্রতিবাদ জানিয়েছে। ‘স্টপ ফোসড ক্রিমেশন’ হ্যাশট্যাগে প্রতিবাদ চলছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।

আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটেন ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেও প্রবাসী শ্রীলঙ্কান মুসলমানেরা বিক্ষোভ করেছেন। তাদের সাথে যোগ দেন অন্য দেশের মুসলিম ও মানবাধিকারকর্মীরা। চারজন ব্রিটিশ এমপি এক যৌথ বিবৃতিতে দাহ করার বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহারে শ্রীলঙ্কার ওপর চাপ দিতে ব্রিটিশ সরকারকে অনুরোধ করেছেন।

এ ছাড়া, ৫৭টি মুসলিম দেশের জোট ওআইসি গত সপ্তাহে এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো বিবৃতিতে মুসলিমদের দাহ করার বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহারের দাবি করছে।

শিশু শেখের দাহ
কলম্বোর দরিদ্র একটি মুসলমান দম্পতির যে শিশুটির লাশ জোর করে দাহ করা হয়, তার করোনা হয়েছিল সেই বিতর্ক এখনো সুরাহা হয়নি।

শিশুটির অটোচালক বাবা ফাহিম ও তার স্ত্রী সাফিনা জানান, ছয় বছর চেষ্টার পর তাদের ছেলের জন্মে তারা ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। ৭ ডিসেম্বর বাচ্চাটি অসুস্থ হওয়ার পর দ্রুত তাকে কলম্বোর একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

করোনা শনাক্ত করতে ডাক্তাররা ওই রাতে তিনজনের শরীরে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করেন। ফাহিম ও সাফিনা করোনা নেগেটিভ হিসেবে শনাক্ত হলেও তাদের বাচ্চাকে পজিটিভ বলে জানানো হয়। ডাক্তাররা বাচ্চাটিকে রেখে রাতে জোর করে মা-বাবাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন।

মোহাম্মদ ফাহিম বলেন, ‘আমি ও আমার স্ত্রী কান্নাকাটি করেছি যেন আমাদের বাচ্চার পাশে থাকতে দেয়া হয়। তারা তা দেয়নি।’

পর দিন অর্থাৎ ৮ ডিসেম্বর বাবাকে ফোন করে জানানো হয় যে শিশুটি করোনায় মারা গেছে। বাবা ফাহিম এখনো মানতে চান না যে তার বাচ্চার আসলেই করোনা হয়েছিল। তার কথা, তারা স্বামী-স্ত্রী দু’জন যেখানে নেগেটিভ, সেখানে বাচ্চার কীভাবে কেরোনা পজেটিভ হয়।

কেবল অ্যান্টিজেন পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে দেয়া সিদ্ধান্ত তিনি মানছেন না।
শুধু সন্তানের মৃত্যুই নয়, যেভাবে জোর করে তাদের আপত্তি সত্ত্বেও ২০ দিনের বাচ্চাকে দাহ করা হয়েছে তা নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ পুরো পরিবার। দেশে-বিদেশে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করছে যে বাচ্চার লাশ নিতে বাবা-মা অস্বীকার করার পর দাহ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

মোহাম্মদ ফাহিম হাসপাতালের দাবি অস্বীকার করে বলেছেন, হাসপাতালের কথা ‘ডাহা মিথ্যা’, বরং তাকে ডেকে নিয়ে জোর করে কাগজে সই করার জন্য চাপ দেয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, দাহ করার আগ মুহূর্তে তাকে ফোন করে ক্রিমেটোরিয়ামে আসতে বলা হয়। কিন্তু তিনি ভেতরে ঢোকেননি। তিনি বলেন, ‘আমি কী করে দেখব যে আমার ২০ দিনের বাচ্চাকে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এমন কষ্ট যেন আর কাউকে সহ্য করতে না হয়।’

ভয়ে মুসলিমরা হাসপাতালে যাচ্ছেন না

শ্রীলঙ্কায় মুসলিম সংগঠনগুলোর জোট ‘মুসলিম কাউন্সিল অব শ্রীলঙ্কা’র ভাইস-প্রেসিডেন্ট ইলমি আহমেদ বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন ও বিশেষজ্ঞদের মতামতের তোয়াক্কা না করে মুসলমানদের সাথে যে আচরণ করা হচ্ছে তা এক কথায় বর্ণবাদ।’

তিনি বলেন, ‘২০ দিনের একটি বাচ্চার লাশ জোর করে দাহ করা সমস্ত অসভ্যতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে।’

আহমেদ আরো বলেন, ‘করোনায় মারা গেলে লাশ দাহ হতে হবে ওই ভয়ে শ্রীলঙ্কার মুসলমানেরা আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। শুধু ওই ভয়ে অনেক মুসলমান করোনার উপসর্গ দেখা দিলেও হাসপাতালে যাচ্ছে না, গোপন রাখছে। আর গোপনে পরিচিত ডাক্তারদের কাছে যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, প্রতিদিন তাদের সংগঠনের কাছে শত শত ফোন আসছে সাহায্য চেয়ে। তারা বুঝতে পারছেন না কী করবে। তারা সাহায্য চাইছেন।

এপ্রিল মাসে করোনায় মৃতদের জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে দাহ করার সিদ্ধান্ত জারির পর থেকে দেশটির মুসলিম সংগঠনগুলো ও মুসলিম রাজনৈতিক নেতারা সরকারের সাথে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য আলাপ করছেন। সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে লাশ দাহ করা ইসলামের অনুশাসন বিরোধী ও মুসলিমদের কাছে স্পর্শকাতর একটি বিষয়।

কিন্তু সরকার এতে কানে দিচ্ছে না। করোনা আক্রান্তদের কবর দেয়া পুরোপুরি নিরাপদ বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন ও ১৯০টি দেশে কবর এবং দাহ দুটিই করা হচ্ছে, এসব যুক্তিও সরকার মানছে না।

ইলমি আহমেদ বলেন, ‘সরকার বারবার দোহাই দিচ্ছে টেকনিক্যাল কমিটির পরামর্শে ওই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা জানি, যিনি ওই কমিটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি একজন জুডিশিয়াল মেডিক্যাল অফিসার। তিনি কোনো ভাইরোলজিস্ট নন। আমরা সত্যিকারের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ওই টেকনিক্যাল কমিটির পুনর্গঠন চেয়েছি। চিকিৎসা বিজ্ঞানে নৈতিকতারও একটি বিষয় রয়েছে, কমিউনিটির কথা রয়েছে। কোনো কথাই কানে তোলা হচ্ছে না।’

আহমেদ আরো বলেন, ‘তারা সরকারকে এমন প্রস্তাবও দিয়েছেন যে কংক্রিটের কফিন বানিয়ে লাশ কবর দেয়া হোক, যাতে ভূগর্ভস্থ পানিতে কোনো সংক্রমণ না ছড়াতে পারে। কিন্তু তবুও তারা শোনেননি।’

সরকার যুক্তি দিচ্ছে, বিশেষজ্ঞ কমিটি সরকারকে বলেছে যে শ্রীলঙ্কায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ভূপৃষ্ঠের অনেক গভীরে নয়। ফলে, করোনা রোগীকে কবর দিলে ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত হয়ে সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি তৈরি হবে।

মুসলিমরা এখন পর্যন্ত আদালতে এ নিয়ে যত আবেদন করেছে, দেশটির সুপ্রিম কোর্ট তার সবগুলো খারিজ করে দিয়েছে।

উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ

ইলমি আহমেদ বলেন, তাদের এখন ভয় সরকারের এই একগুঁয়েমি আচরণের প্রভাব মুসলিম তরুণ-যুবকদের ওপর কীভাবে পড়ে তা নিয়ে। মুসলিম তরুণরা দেখছে, তাদের বাবা-দাদা-চাচাদের কবর না দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। তারা অবশ্যই এতে খুশি নয়। অনেকেই কট্টরপন্থার দিকে ঝুঁকতে পারে।’

‘মুসলিম কাউন্সিল অব শ্রীলঙ্কা’র এই ভাইস-প্রেসিডেন্ট বিশ্বাস করেন, করোনায় মারা গেলে মুসলমানদেরও দাহ করার সিদ্ধান্তের সাথে শ্রীলঙ্কায় ‘কট্টর বৌদ্ধ ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ’ উত্থানের সম্পর্ক রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘কট্টর বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতারা এখন রাজনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন। গত নির্বাচনের আগে এসব বৌদ্ধ নেতারা খোলাখুলি বলেছেন শ্রীলঙ্কা একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্র। সুতরাং সরকার হবে বৌদ্ধ সরকার। তারা একটি অভিন্ন আইন করার কথা বলছেন। বিয়ে, সম্পত্তি ও জন্ম-মৃত্যু নিয়ে মুসলিমদের নিজস্ব যে সব ধর্মীয় আইন-কানুন রয়েছে সেগুলো কেড়ে নিতে চান তারা। তারা এক দেশ, এক আইন চায়। মুসলিমদের জোর করে দাহ করার নির্দেশও তারই অংশ।’

বিদেশে নিয়ে কবর

শ্রীলঙ্কার সরকার এখন করোনায় মৃত মুসলমানদের লাশ মালদ্বীপে নিয়ে গিয়ে কবর দেয়ার জন্য সরকার চেষ্টা করছে- এমন একটি খবর শ্রীলঙ্কান মুসলিমদের মধ্যে নতুন ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।

বার্তা সংস্থার এএফপি জানিয়েছে, মালদ্বীপের সরকার শ্রীলঙ্কায় করোনায় মারা যাওয়া মুসলমানদের কবর দেয়ার অনুমতির বিষয়টি বিবেচনা করছে।

মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল্লাহ শহীদ টুইট করেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট ইব্রাহীম মোহাম্মদ সোলিহ ইসলামী ধর্মমতে শেষকৃত্যের বিষয়ে শ্রীলঙ্কাকে সহযোগিতা করা নিয়ে তার মন্ত্রীদের সাথে পরামর্শ করছেন।’

মালদ্বীপের মন্ত্রী বলেন, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের অনুরোধে মালদ্বীপ সরকার এটি বিবেচনা করছে।

মুসলমান সম্প্রদায়ের নেতা ইলমি আহমেদ বলেন, পাকিস্তান ও মালয়েশিয়ায় লাশ নিয়ে কবর দেয়া যায় কিনা, তা নিয়ে কিছু মুসলিম অধিকারকর্মী এবং কয়েকটি মুসলিম ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান যোগাযোগ শুরু করেছে।

তবে বিদেশে নিয়ে কবর দেয়া নিয়ে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে টুইটারে কলম্বোর সাংবাদিক মুনযা মুশতাক লিখেছেন, ‘আমরা সংখ্যালঘু হতে পারি, কিন্ত আপনার মতো আমরাও এদেশের নাগরিক। সুতরাং দয়া করে আমাদের এদেশেই কবর দেয়ার অনুমতি দিন।’

ইলমি আহমেদ স্বীকার করেন, বিদেশে লাশ নিয়ে সেসব দেশে কবর দেয়ার বিষয়ে মুসলমানদের দ্বিধা রয়েছে।

বিবিসি সিনহালা ভাষা বিভাগ কয়েক দিন ধরে শ্রীলঙ্কার স্বাস্থ্যমন্ত্রী পবিত্র ওয়ান্নিয়ারাচ্চি-সহ করোনা নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে মুসলিমদের লাশ দাহ করার বিষয়টি নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এতে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

তবে সরকারের আরেকজন মন্ত্রী কেহেলিয়া রামবুকওয়েলা বলেন, মুসলমানদের প্রতি কোনো বৈষম্য করা হচ্ছে না। তার যুক্তি, ‘বৌদ্ধরাও তো অভিযোগ করতে পারে যে তারাও পুরোপুরি ধর্মমতে শেষকৃত্য করতে পারছে না।’

অতি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে টুইট বার্তায় জানানো হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে তার মন্ত্রী ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের ডেকে উঁচু কোনো জায়গা যেখানে পানির স্তর বেশ নিচে এমন জায়গায় কবর দেয়ার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন।

সূত্র : বিবিসি

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।