আবু সাইদ বিশ্বাস: সুন্দরবন থেকে ফিরে: বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অখন্ড বনভূমি সুন্দরবনে বাঘের পরই হরিণের স্থান। এ বনের অন্যতম আকর্ষণ সৌন্দর্যের রাণী মায়াবী চিত্রল হরিণের বিচরণ বেড়েছে। দর্শণীয় স্থান কটকা, হাড়বাড়িয়া, করমজল, দুবলারচর, হিরণপয়েন্ট, কচিখালী, সুপতি, মান্দারবাড়িয়া,ঢাংমারী,কলাগাছি,দোবেকি এলাকায় যাওয়ার পথে দলে দলে হরিণের দেখা মিলছে। মায়াবী নিরীহ এ হরিণ পড়ন্ত বিকেলে কিংবা সূর্যোদয়ের সাথে সাথে মুক্ত হরিণের দল নদীর চরে দেখা মিলছে। কেওড়া গাছ সমৃদ্ধ এলাকায় হরিণের পদচারণা বেশি। কোন কোন এলাকাতে পর্যটকদের হাত থেকে হরিণ খাবার খাচ্ছে। কিন্তু প্রতিনিয়ত শিকারির ফাঁদে পড়ে হুমকির মুখে পড়েছে এ চিত্রা হরিণ।
সূত্র মতে, ২০০১ সালের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ীসুন্দবনে হরিণের সংখ্যা ১ থেকে দেড় লাখ। এন্টাগ্রোটড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট প্রকল্প ১৯৯৬-৯৭ সালে বন্য প্রাণীর উপর জরিপ অনুযায়ী সুন্দরবনে ১ থেকে দেড় লাখ হরিণ থাকার কথা বলা হয়। ১৯৯৫ সালের এফ,এ,ও এবং ইউএনডিসি’র কারিগরি সহযোগিতায় পরিচালিত পশু শুমারী অনুযায়ী ৯১ হাজার চিত্রল হরিণ ও শংঙ্ক হরিণের সংখ্যা ছিল ২৯ হাজার। ১৯৯৩ সালের হিসাব অনুযায়ী সুন্দরবনের হরিণের সংখ্যা ছিল ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ। সর্বশেষ জরিপে হরিণের সংখ্যা ছিল ১ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার। তবে বর্তমানে এর সংখ্যা আরো বেড়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
চলতি বছরের এপ্রিল মে মাসে অর্ধশতাধীক হরিণ শিকারের খবর পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৫ মে বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবনে শিকারের ফাঁদে আটকে থাকা জীবিত ২২টি চিত্রল হরিণ উদ্ধার করা হয়। এ সময় ৩০ কেজি হরিণের মাংস, ৭০০ ফুট হরিণ শিকারের ফাঁদ, তিনটি ট্রলার ও একটি নৌকাসহ তিনজনকে আটক করা হয়। এর আগে গত ২৮ মার্চ সুন্দরবনের চরখালী থেকে ৫০০ ফুট হরিণ শিকারের ফাঁদ, ১০ এপ্রিল কচিখালী থেকে ৫০০ ফুট হরিণ শিকারের ফাঁদ, ১৭ এপ্রিল চান্দেশ্বর থেকে ৭০০ ফুট হরিণ শিকারের ফাঁদ, ২৩ এপ্রিল শরণখোলা উপজেলার সোনাতলা গ্রাম থেকে ১০ কেজি হরিণের মাংস উদ্ধার ও ২ মে ১৫০০ ফুট হরিণ শিকারের ফাঁদসহ দুই চোরা শিকারিকে আটক করেন সুন্দরবনের বন রক্ষীরা। এছাড়া পশ্চিম সুন্দরবন অংশ তেখে কয়েক দফায় হরিণের মাংস উদ্ধার করা হয়।
প্রাণী বিশেজ্ঞরা জানান, হরিণী এক বছরের মধ্যেই প্রজননক্ষম হয়ে ওঠে। গর্ভকাল প্রায় ৭ মাস। সাধারণত ১ থেকে ২টি বাচ্চা প্রসব করে। দু’তিনটি পুরুষ হরিণসহ এরা ১০ থেকে ৩০টি একত্রে দলবদ্ধ থাকে। সেই হিসেবে সুন্দরবনে বছরে হরিণের সংখ্যা ৫০ হাজার বৃদ্ধি হওয়ার কথা।
বন রক্ষকরা বলছেন, সুন্দরবনের হরিণ মানুষের মনকে এক পলকে কেড়ে নেয়। হরিণেরা নিশাচর বা দিবাচর। ঘাস, লতাপাতা, ওড়া, কেওড়া, গোল, ধুন্দল, গেউয়া গাছের ফল খুব পছন্দ হরিণের। এরা ছোট ছোট দলে বাস করে। এরা যাওয়ার পথে পায়ের চিহ্ন রেখে যায়। অত্যন্ত আরামপ্রিয় এবং সৌখিন। হরিণ অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতি সম্পন্ন এবং সজাগ। বনের হরিণ বাঘের অন্যতম প্রধান শিকার। তাই বাঘের আক্রমণের পূর্বাভাস পেলেই তারা ক্ষিপ্ত গতিতে পালিয়ে যায়। এমনকি মানুষের উপস্থিতি টের পেলেও এরা বনের ভেতর চলে যায়। তারা আরও বলেন, বাঘ হরিণের চিরশত্রু হলেও ব্যতিক্রম বানরের সঙ্গে সম্পর্ক। বনের বানরেরা কেওড়া গাছে উঠে নিজেরা যেমন পাতা ও ফল খায়, গাছের নিচে অপেক্ষমান হরিণের জন্য অনুরূপভাবে গাছের ফল বা পাতা নিচে ফেলে দেয়। হরিণের সংগে বানরের সম্পর্ক চমৎকার । কোনো বিপদের সংকেত পেলে বানর ডাক দিয়ে হরিণকে সতর্ক করে দেয়।
সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার মৎস্যজীবীসহ অন্যান্য পেশাজীবীরা জানান, চোরা শিকারির সংঘবদ্ধচক্র গভীর অরণ্যে হরিণের আবাসস্থল এলাকায় অবস্থান নেয়। কখনও ট্রলারে, কখনও নৌকায়, আবার কখনও বনের গাছে মাচা বেঁধে হরিণের গতিবিধি লক্ষ করে শিকারিরা। তারা রাতে, বিশেষ করে কৃষ্ণপক্ষের রাতে জঙ্গলে বেশি হানা দেয়। সুন্দরবনে যে অঞ্চলে কেওড়া গাছ বেশি জন্মে, হরিণের আনাগোনা সেখানে সবচেয়ে বেশি থাকে। ভোরে অথবা পড়ন্ত বিকালে হরিণ চরাঞ্চলে ঘাস খায়। শিকারিরা হরিণের এই স্বভাব বুঝে সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নেয় এবং জীবন বাজি রেখে রাতের আঁধারে গহিন অরণ্যে নামে। সুযোগ বুঝে তারা গুলি করে কিংবা ফাঁদ পেতে শিকার করে। হরিণ শিকারের পর গোপন আস্তানায় বসে মাংস প্রস্তুত করা হয়। পরে তা বিক্রি করা হয় বিভিন্ন এলাকাগুলোতে।
সুন্দরবন বিভাগের তথ্য মতে ১৮২৮ সালে তৎকালীন বৃটিশ সরকার সুন্দরবনের স্বত্তাধিকার অর্জন করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় ৫৫টি কম্পার্টমেন্ট বাংলাদেশে পড়ে। যার আয়তন ৬,০১৭ বর্গকিলোমিটার।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মোঃ বেলায়েত হোসেন বলেন, সুন্দরবনের বনজ সম্পদ ও বন্যপ্রাণী সুরক্ষায় পূর্বের তুলনায় অভয়ারণ্য এলাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং বনবিভাগসহ প্রশাসনের কঠোর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।