করোনাকালে এখন পর্যন্ত মোট ৪৪৩ জন বিদেশ ফেরত প্রবাসীকে ১৮ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন। তিনি বলেন, দেশে ফিরে বিমানবন্দর থেকে ৫ হাজার টাকা নিতে বিদেশ ফেরতরা যতটা না আগ্রহ দেখান প্রবাসী ঋণ নিতে তাদের তেমন কোনো আগ্রহ নেই।
শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর ইস্কাটনে প্রবাসী কল্যাণ ভবনে বিশ্ব অভিবাসী দিবস উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনে নয়া দিগন্তের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি একথা জানান।
করোনাকালে নানা কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরত আসা প্রবাসীদের জন্য ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড ২০০কোটি টাকা এবং প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে ৫০০কোটি টাকা মো ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্ধ দেয় সরকার। সহজ শর্তে বিদেশ ফেরত কিংবা বিদেশে মারা যাওয়া প্রবাসীর কোনো বৈধ প্রতিনিধিকে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে এই টাকা ঋণ দেয়ার কথা। কিন্তু, এই ঋণ বিতরণ নিয়ে বরাবরই সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করে আসছেন প্রবাসী ঋণ পেতে নানা ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে তাদের। শর্তের জালে আটকে আছে প্রবাসী ঋণ বিতরণ প্রক্রিয়া।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ সচিব, প্রথম দিকে ঋণ পাওয়ার শর্ত নিয়ে কিছু সংশয় ছিল। শাখা অফিসগুলো সিদ্ধান্ত নিতে পারতো না, আরো কিছু জটিলতা ছিল, সেগুলো আমরা দূর করেছি। এখন আশা করছি বিগত ৬ মাসে যা হয়েছে, আগামী ৬ মাসে তার কয়েকগুন লোন নেয়ার পরিমাণ বাড়বে। এখন আর লোন নেওয়ার প্রক্রিয়া জটিল নয় উল্লেখ করে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, শাখা বা স্থানীয় পর্যায়ে যাতে সিদ্ধান্ত দিয়ে ঋণ বিতরণ করতে পারে সে সুযোগ করে দেয়া হয়েছে, যা আগে ছিল না। আগের চেয়ে লোন প্রদান প্রক্রিয়া অনেক সহজ হয়েছে।
করোনা মহামারীর কারণে এবার বিশ্ব অভিবাসী দিবসের তেমন কোনো কর্মসূচি নেই। ১৮ ডিসেম্বর অন্য বছর দিনব্যাপী নানা আয়োজন থাকলেও এবার সংবাদ সম্মেলনে শুধু বছর জুড়ে এই সেক্টরের নানা অর্জন ও আগামী দিনের পরিকল্পনার কথা তুলে ধরতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। সংবাদ সম্মেলনে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, আগামী ৬ জানুয়ারি দিবসটি উপলক্ষে অনলাইনে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। যেখানে প্রধান অতিথি থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ‘মুজিববর্ষের আহ্বান, দক্ষ হয়ে বিদেশ যান’- এই প্রতিপাদ্যে দিবসটি বাংলাদেশে উদযাপিত হয় খুবই স্বল্প পরিসরে।
সংবাদ সম্মেলনে ইমরান আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও বেকারত্ব দূরীকরণে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের গুরুত্ব অপরিসীম। এ দেশে প্রতিবছর আনুমানিক ২০ থেকে ২৫ লাখ কর্মী শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রতি বছর প্রায় সাত থেকে আট লাখ লাখ বৈদেশিক কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশে গমন করে। বিএমইটি’র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯ সালে সাত লাখ ১৫৯ জন কর্মী বিদেশ গেছেন। কিন্তু বর্তমানে মহামারি করোনাভাইরাস ও বিভিন্ন গন্তব্য দেশের অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বৈদেশিক কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছে। এই করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে মন্ত্রণালয় দেশে-বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসী কর্মী ও তাদের পরিবারের আর্থ-সামাজিক রি-ইন্ট্রিগেশনসহ সামগ্রিক সুরক্ষা, বর্তমান শ্রমবাজার ধরে রাখা, নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধান, বন্ধ শ্রমবাজার উন্মুক্তকরণসহ করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ কর্মী তৈরিকে প্রাধান্য দিয়েছে। এ লক্ষ্যে করোনা মহামারিকালে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে মন্ত্রণালয়।
গৃহীত কার্যক্রমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বিদেশে বাংলাদেশ মিশনের শ্রম কল্যাণ উইংয়ের মাধ্যমে দুস্থ ও কর্মহীন হয়ে পড়া প্রবাসী কর্মীদের মাঝে বিশেষ বরাদ্দ হিসেবে ৯ কোটি ৮৫ লাখ ২৫ হাজার টাকার ওষুধ, ত্রাণ ও জরুরি সামগ্রী বিতরণ, করোনাকালে সৌদি আরবের ডিপোর্টেশন সেন্টারে অবস্থানরত মোট ২০৭ জন নারী কর্মীকে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তহবিল হতে বিমান ভাড়া প্রদান করে দেশে ফেরত আনা হয়েছে, একইভাবে লেবানন থেকে ৯৫ জন কর্মী এবং ভিয়েতনামে আটকে পড়া ১০৫ জন কর্মীকে দেশে ফেরত আনা হয়েছে। লকডাউনেরসময় গত ২৯ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত বিদেশ প্রত্যাগত ৫ হাজার ৯ শত ৭৪ জন কর্মীকে জনপ্রতি ৫ হাজার টাকা করে বিমানবন্দরে তাৎক্ষণিক মোট ২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী বলেন, দক্ষ কর্মী তৈরির লক্ষ্যে সারাদেশে ৬৪টি টিটিসি ও ৬টি আইএমটি চালু আছে। উপজেলা পর্যায়ে ৪০টি টিটিসি নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে আছে। মুজিববর্ষের বিশেষ উদ্যোগে মহান মুক্তিযুদ্ধের বছরের স্মারক হিসেবে উপজেলা পর্যায়ে আরাও ১০০টি টিটিসি নির্মানের প্রকল্প রয়েছে। ইতোমধ্যে এর ডিপিপি প্রণয়নের কাজ সমাপ্ত হয়।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতি উপজেলা থেকে প্রতিবছর গড়ে ১ হাজার জনকে বিদেশে কর্মসংস্থানের অঙ্গীকার করেছেন। গত অর্থবছরে গড়ে এই সংখ্যার চেয়েও বেশি কর্মী বিদেশে পাঠানো হয়। অদূর ভবিষ্যতে প্রতি উপজেলা থেকে ন্যূনতম ১ হাজার জনকে বিদেশে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
মন্ত্রী বলেন, প্রবাসী কর্মীদের একটি অংশ দেশে ফেরত এসেছে। গত ১ এপ্রিল থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ৩ লাখ ২৬ হাজার ৭৫৮ জন প্রবাসী কর্মী দেশে ফিরে এসেছেন। তাদের অনেকে কাজের মেয়াদ শেষে বা কাজ না থাকায় দেশে ফেরত এসেছেন। যদিও আশঙ্কা করা হয়েছিল, অর্থনৈতিক মন্দা এবং করোনার প্রভাবে প্রধান কর্মী নিয়োগকারী দেশসমূহে শ্রমবাজার বিপর্যস্ত হওয়ার কারণে অনেক বিদেশী কর্মী বেকার হয়ে পড়বে। কিন্তু আশার কথা হলো, এখন পর্যন্ত ফেরত আসা কর্মীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হয়ে উঠেনি। এক্ষেত্রে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিদেশি মিশন ও দূতাবাস একযোগে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে।
সংবাদ সম্মেলনে বিএমইটির মহাপরিচালক মো. শামসুল আলম, ওয়েজ অনার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক মো. হামিদুর রহমান, বোয়েসেল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাইফুল হাসান বাদল, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. শহীদুল আলম ও খাদিজা বেগম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।