উপকূলের পাঁচ লাখ মানুষ সুন্দরবনে মৎস্য সম্পদের উপর নির্ভরশীল: প্রতি বছর হাজার কোটি টাকার শুঁটকি মাছ বিক্রি

আবু সাইদ বিশ্বাস: সুন্দরবন ফিরে: সাগরের বুক চিরে জেগে ওঠা পৃথিবীর বৃহত্তম বন সুন্দরবন। কেবল সৌন্দর্যে নয়, জীববৈচিত্র্য এবং মৎস্যসম্পদেও ভরপুর। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুন্দরবন যেমন মানবরক্ষায় ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তেমনি এর মৎস্যসম্পদ দেশ ও দেশের মানুষকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি করেছে। অবস্থান, প্রজাতির বিন্যাস, উৎপাদন, বিস্তৃতি ও আবাস স্থল বিবেচনায় সুন্দরবন দেশের অন্যতম মৎস্য ভান্ডার। অন্তত চার-পাঁচ লাখ মানুষ সুন্দরবনের মৎস্যসম্পদে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছে। শুধু সুন্দরবনের দুবলারচরেই প্রতি বছর হাজার কোটি টাকার শুঁটকি বিক্রি করা হয়। জেলেদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করতে পারলে এ খাত থেকে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বর্তমান সুন্দরবনের আয়তন ১০ লাখ হেক্টরেরও বেশি। এর শতকরা ৬০ ভাগ অর্থাৎ ৫ লাখ ৫৭ হাজার ২৮৬ হেক্টর আয়তনের বনাঞ্চল রয়েছে বাংলাদেশে। উপকূলের তিন জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, ও বাগেরহাটজুড়ে এর বিস্তৃতি। সুন্দরবন সৃষ্টির শুরু থেকে এটি মৎস্যসম্পদের বড় আধার হিসেবে চিহ্নিত। এর নদ-নদী, খাল ও মোহনাগুলো রীতিমতো মৎস্যসম্পদের ভান্ডার। জলাশয়ের মৎস্যসম্পদ ও মৎস্য প্রজাতি সুন্দরবনের সার্বিক জীববৈচিত্র্যেরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে ৪ লাখ ১ হাজার ৬৮৫ হেক্টর বনভূমি এবং বাকি ১ লাখ ৫৫ হাজার ৬ শ’ একর নদী, খাল, খাঁড়ি ও মোহনা।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য সম্পদ বিভাগের মতে পশ্চিম সুন্দরবন সা

তক্ষীরা অংশে ৫৫ হাজার ৫২৪ হেক্টর জায়গা জুড়ে মৎস্য সম্পদ বলয় গড়ে উ

ঠেছে। এখান থেকে প্রতিবছর ১৪শ মে:টন সামুদ্রিক মাছ আহরণ করা হয়। একই এলাকাতে সাগরের মোহনা রয়েছে ১৮ হাজার ২৮৮ হেক্টর। যেখান থেকে প্রতিবছর ৫৭ মে:টন সামুদ্রিক মাছ আহরণ করা হয়। এছাড়া প্লাবনভুমি আছে ৮টি যার আয়তন ২২০ হেক্টর। যেখান থেকে প্রতিবছর ১৮৬.৫ মে:টন মাছ উৎপাদন হয়। মাছের সাথে জড়িত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নিবন্ধিত এমন জেলের সংখ্যা জেলাতে ৪৯ হাজার ১৭৫ জন। এছাড়া জেলাতে মৎস্য চাষে জড়িত আছে আরো ৮১ হাজার ৪৩২জন। সবমিলে সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে জেলাতে মৎস্য খাতে এক মহা কর্মযোগ্য।
সুন্দরবনের অভ্যন্তরে প্রতিদিন দুইবার জোয়ার-ভাটা বয়ে যায়। সমুদ্র থেকে আসা জোয়ারের পানি বনাঞ্চলের উদ্ভিদ ও জলজ প্রাণীকে স্বাভাবিকভাবেই লবণাক্ত সহিষ্ণু করে। এর পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ নদীসমূহের পলি, খনিজ ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ মিষ্টি পানি মোহনাঞ্চলের লবণ পানির সঙ্গে মিশে যায়। বনের লতাপাতাও পানিকে সমৃদ্ধ করে। ফলে জৈব-অজৈব পুষ্টি পানির উবর্রতাকে যেমন বাড়ায়, তেমনি মাছের পরিবেশ করে অনুকূল। সুন্দরবনে একই সঙ্গে তাই দ্রুত বাড়ে মিঠা ও লবণ পানির মাছ। বিশ্বে খুব কম জায়গাতেই এমন পরিবেশ আছে। এখানে খুব সহজে মেলে সাগরের ইলিশ। পাশাপাশি ছুরি, লইট্টা, পোয়া, রূপচাঁদা, ভেটকি, পারসে, চিতরা, বিশতারা, পানপাতা, টেকচাঁদা, দাতিনা মাছও মেলে। গলদা এবং বাগদা চিংড়ি তো রয়েছেই। সুন্দরবনে মোট ২০৪ প্রজাতির মাছ রয়েছে। এরমধ্যে ২০ প্রজাতির মাছ তরুণাস্থির এবং ৪০ প্রজাতির মাছ অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া রয়েছে ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ৭ প্রজাতির কাঁকড়া ও ৩ প্রজাতির কচ্ছপ। যার সবগুলোই মূল্যবান। সুন্দরবনে মাছ ধরায় ইলিশ জাল, কারেন্ট জাল, বেহুন্দি জাল, ফাঁস জাল, বেড় জাল, ভেসাল ও ঠেলাসহ ১৪ ধরনের জাল ব্যবহার করা হয়।
সুন্দরবনে মোট কতসংখ্যক জেলে মাছ ধরে, তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া মুশকিল। তবে বন বিভাগ প্রতিবছর গড়ে কমবেশি ১৫ হাজার জেলে নৌকাকে রাজস্ব আদায়ের বিপরীতে মাছ ধরার অনুমতি দেয়। প্রতিটি নৌকায় গড়ে ৭ জন জেলে ধরা হলে মোট জেলের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৫ হাজারে। এরা প্রত্যক্ষভাবে মাছ ধরায় যুক্ত। এর বাইরে আরও তিন-চারগুণ সংখ্যক মানুষ পরোক্ষভাবে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। সে হিসেবে অন্তত চার-পাঁচ লাখ মানুষ সুন্দরবনের মৎস্যসম্পদে জীবন-জীবিকায় যুক্ত রয়েছে। সারাদেশে উৎপাদিত মাছের শতকরা পাঁচ ভাগেরও বেশি আসে সুন্দরবন থেকে। যার পরিমাণ প্রায় আড়াই লাখ মেট্রিক টন। এর বাইরে শুঁটকি শিল্পেও সুন্দরবনের অবদান ব্যাপক। সুন্দরবনের দুবলারচরেই প্রতি বছর হাজার কোটি টাকার শুঁটকি তৈরি হয়। এখানে কাজ করে ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ। এছাড়া অবৈধ হলেও সুন্দরবন থেকে প্রতিবছর শত কোটি বাগদা ও গলদা চিংড়ির পোনা সংগ্রহকরা হয়। যার ওপর টিকে আছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চিংড়ি শিল্প।
সুন্দরবনের মৎস্য খাত দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও নানাবিধ কারণে এর বিকাশ তেমন ঘটছে না। সারাদেশে মৎস্য খাত মৎস্য বিভাগ পরিচালনা করলেও সুন্দরবনের কর্তৃত্ব একক বন বিভাগের হাতে। বিভাগীয় বন কর্মকর্তার দুটি কার্যালয়ের আওতায় ৪টি রেঞ্জের ১৭টি বিট অফিস থেকে এর সকল কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। বন বিভাগ কেবলমাত্র রাজস্ব আদায়ে মনোযোগী। সুন্দরবনের মৎস্যসম্পদের ওপর নেই পর্যাপ্ত গবেষণা। মৎস্যসম্পদের উন্নয়নে নেই কোন পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন। ফলে সুন্দরবনের মৎস্যসম্পদের যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না বলেই সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
চলতি সপ্তাহে সুন্দরবনের চুবলার চরে সুন্দরবনের মৎস্য আহরণে এলাহি কান্ড চোখে পড়লো। জেলেরা তাদের জাল থেকে মাছ নামাতে দেখা গেল। তারা জানালো ট্যাংরা মাছের একটি ঝাক তাদের জালে ধরা পড়েছে। যোর ওজন হয়েছে ৪১ মণ । প্রতি নিয়ত জেলেদের জালের শত শত মণ সামুদ্রিক মাছ ধরা পড়ছে।
বনবিভাগ জানান, সুন্দরবনের মৎস্যসম্পদ উন্নয়নে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। যার শুরুতেই রয়েছে মৎস্যসম্পদের জরিপ। এছাড়া, গত দুই মৌসুম ধরে বনবিভাগ প্রজনন কাল নির্বিঘœ রাখতে বছরে দুই মাস মাছ ধরা বন্ধ রাখছে। যা মৎস্যসম্পদের উন্নয়নে বড় ধরনের পদক্ষেপ। এ ধরনের আরও কিছু উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। যা সুন্দরবনের জন্য হবে ইতিবাচক।

Check Also

আশাশুনিতে কর্মী সম্মেলনে আওয়ামী লীগকে জামায়াত নেতার কঠোর হুঁশিয়ারি বার্তা

স্টাফ রিপোর্টার:আশাশুনিতে ইউনিয়ন জামায়াতে ইসলামীর কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর নিজস্ব কার্যালয় আলামিন …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।