ব্যবহার কমায় সুন্দরবনে গোলপাতা নষ্ট হচ্ছে

আবু সাইদ বিশ্বাস: সুন্দরবন ঘুরে ফিরে: ব্যবহার কমায় সুন্দরবনে গোলপাতার আহরণ কমছে। কম দামে টেকসই নির্মাণসামগ্রীর ব্যবহার বাড়ায় শত বছর ধরে ঘর তৈরির প্রধানতম সামগ্রী গোলপাতার ব্যবহার হ্রাস পেয়েছে। কমেছে মৌসুমে পাস পারমিট ইস্যু। ফলে হাজার হাজার কুইন্টাল গোলপাতা নষ্ট হচ্ছে সুন্দরবনে। বনবিভাগের কড়াকড়ি আরোপ ও তুলনামূলকভাবে গোলপাতার চেয়ে টিনের দাম কম হওয়াতে দিনকে দিন এর ব্যবহার কমছে। বাওয়ালীরা বলছে গোলপাতার চাহিদা কমে যাওয়া, পারমিট নিতে বনবিভাগের নানা জটিলতা ও হয়রানিসহ নিরাপত্তার কারণে সুন্দরবনে গোলপাতার আহরণ হ্রাস পাচ্ছে। এতে লক্ষ লক্ষ টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। তারপরও জীবিকার তাগিদে পুরানো পেশা টিকিয়ে রাখতে ও নিতান্তই দরিদ্র মানুষের চাহিদা মেটাতে সংশ্লিষ্ট মহাজন-বাওয়ালীরা তাদের এ পেষা ধরে রেখেছে। গোলপাতার চাহিদা সৃষ্টির দাবী জানিয়েছে তারা। প্রতিবছর সুন্দরবন থেকে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার মেট্রিক টন গোলপাতা সংগৃহীত হয়। এ কাজে মৌসুমে প্রায় ৩০ হাজার লোক নিয়োজিত থাকে।
বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, গোলপাতা বাংলাদেশের একটি সম্ভাবনাময় ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ প্রজাতি। গোলপাতা সুন্দরবনের একটি অতি মূল্যবান প্রাকৃতিক অর্থকরী সম্পদ। নামে গোল হলেও গোলপাতা আসলে গোলাকার নয়, লম্বা লম্বা। এর পাতা সবুজ বর্ণের অনেকটা নারিকেল গাছের পাতার মতো। বহুমুখী ব্যবহার ও সহজলভ্যতার কারণে খুলনা ও বরিশাল বিভাগের প্রায় ১৬টি জেলার নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ঘরবাড়ি ও আশ্রয়স্থাল নির্মাণে গোলপাতা সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
অভয়ারণ্যসহ বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার মণ পাতা নষ্ট হচ্ছে। বনের কয়েকটি অঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, যেসব স্থানে গোলপাতার কূপ (প্রজনন ক্ষেত্র) রয়েছে সেসব স্থানে গোলগাছের পাতা মরে যাচ্ছে। এক জায়গায় অধিক গাছ হওয়ার কারণে এসব গাছের পাতার এমন অবস্থা। কোনো কোনো গাছে মাইজ পাতা (মধ্যখানের শিশু পাতা) বাদে সব পাতাই নষ্ট হয়ে গেছে। স্থানীয় বন বিভাগের কর্মকর্তা ও বাওয়ালিরা বলছেন, পাতা না কাটার কারণেই নষ্ট হচ্ছে। এতে ফল প্রদানের পরিমাণও কমে যাবে গাছের।
আব্দুল্লাহ নামে এক বাওয়ালি বলেন, আগে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল বনজীবীরা সারা বছর কিছু না কিছু আয় করতে পারত। এখন সেই অবস্থা সংকুচিত হওয়ার কারণে শিকারিদের সংখ্যা বেড়েছে। ফলে গত কয়েক বছরে যে পরিমাণ হরিণ শিকারি ধরা পড়েছে অতীতে সংখ্যাটা এত বেশি ছিল না।
সুন্দরবন বন বিভাগ সূত্রানুযায়ী, ১৮৭৪-৭৫ সালে সংরক্ষিত সুন্দরবন ব্যবস্থাপনার গোড়াপত্তন হয় বন বিভাগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এর কয়েক বছর পর ষষ্ঠ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আর এল হেইনিগ তার ১৫.০৭.১৮৯৫ থেকে ০৪.০৩.১৮৯৮ মেয়াদকালে সুন্দরবন থেকে গোলপাতা কর্তনের বর্তমান নিয়ম চালু করেন। সেই থেকে এখন পর্যন্ত প্রতি বছরের শীতকালে ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস মাস পর্যন্ত বাওয়ালিরা নির্দিষ্ট ফি পরিশোধ করে বন বিভাগে থেকে পাস নিয়ে বনের নির্ধারিত এলাকা থেকে গোলপাতা কাটেন। সে পাতা নৌকা ভরে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে বিক্রি হয়।
গোলপাতা প্রধানত ঘরের চাল ছাউনির কাজে লাগে। ছাউনি ছাড়াও ঘরের বেড়া দিতেও অনেকে ব্যবহার করেন। জ্বালানি হিসেবে শুকনো গোলপাতা পাতা ব্যবহার হয়। পাতার ডাঁটা মাছ ধরার সময় জালে ভাসিয়ে রাখার জন্য জেলেরা ব্যবহার করে থাকেন। গোলপাতা দিয়ে একধরনের ছাতা, ঝুড়ি, মাদুর, থলে, খেলনা প্রভৃতি তৈরি হয়। গোলের কচি ফলের শাঁস খাওয়া যায়। শাঁস বেশ সুস্বাদু।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ সূত্র জানায়, এ বিভাগ এলাকা থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬৩ হাজার ৭৯১ কুইন্টাল গোলপাতা আহরণ হয়। এ থেকে রাজস্ব পাওয়া যায় ১৬ লাখ ১০ হাজার ৪৮৩ টাকা। ২০১৭-১৮ বছরে ৭২ হাজার ১০ কুইন্টাল আহরণে রাজস্ব আসে ১৮ লাখ ২৪৮ টাকা, ২০১৬-১৭ বছরে ৫০ হাজার ৯৯০ কুইন্টাল আহরণে রাজস্ব আসে ১২ লাখ ৬৬ হাজার ৬৭৯ টাকা, ২০১৫-১৬ বছরে ৩৪ হাজার ৫৬ কুইন্টাল আহরণে রাজস্ব আসে ১৮ লাখ ৬৫ হাজার ৫৬৫ টাকা এবং ২০১৪-১৫ বছরে ৯৫ হাজার ৭১৬ কুইন্টাল গোলপাতা আহরণে রাজস্ব পাওয়া যায় ২৩ লাখ ৯২ হাজার ৯০৩ টাকা।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, এ বিভাগে এলাকা থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২২ হাজার ৪৫৪ কুইন্টাল গোলপাতা আহরণে রাজস্ব আয় হয়েছে ছয় লাখ ২৫ হাজার ৯০৭ টাকা। ২০১৭-১৮ বছরে ২৯ হাজার ৩৭৯ কুইন্টাল আহরণে রাজস্ব আয় হয়েছে আট লাখ ৯ হাজার ৭৬৭ টাকা এবং ২০১৬-১৭ বছরে ৪৫ হাজার ৫০০ কুইন্টাল গোলপাতা আহরণ থেকে রাজস্ব আয় হয় ১৫ লাখ ৫১ হাজার ৫৯ টাকা। সুন্দরবনের দুই বিভাগ মিলিয়ে ২০১৭-১৮ বছরে এক লাখ এক হাজার ৩৮৯ কুইন্টাল এবং ২০১৮-১৯ বছরে ৮৬ হাজার ২৪৫ কুইন্টাল গোলপাতা কাটা হয়। এ বছরে পাতা আরো অনেক কম আহরণ হবে বলে বন কর্তৃপক্ষ এ পর্যন্ত যে পাস ইস্যু হয়েছে তার ভিত্তিতে ধারণা করছেন।

গোলপাতা ব্যবসায়ীরা জানান, আগে গোলপাতা বহনকারী নৌকার দুই পাশে ঝুল (ভারসম্য) হিসেবে বনের বিভিন্ন ধরণের গাছ কেটে আনা হতো। কিন্তু এখন সেগুলো কাটা নিষিদ্ধ করায় দেশীয় গাছ নিয়ে ঝুল হিসেবে ব্যবহার করায় খরচও বাড়ছে ব্যবসায়ীদের। এতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে তারা।

গোলগাছের পাতামরা রোগের বিষয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের প্রফেসর নজরুল ইসলাম বলেন, ফুল এবং ফলের জন্য গোলগাছ পরিষ্কার করা জরুরি। না হলে নষ্ট হয়ে যাবে। পাতা না থাকলে গাছের বদ্ধি পাওয়ার হারও কমে যাবে। বাওয়ালিদের নির্দেশনাই থাকে যে পাতা কাটার সঙ্গে সঙ্গে গাছ পরিষ্কার করে দেওয়া। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা হয় না। তারা কোনো রকমে পাতা কেটে নিয়ে চলে যায়। আবার অনেক ক্ষেত্রে তাদের তীক্ষ ধারালো দায়ের আঘাতেও মাইজ পাতা বা ফলের ক্ষতি হয়। সেক্ষেত্রে ঐ গাছ আর ফল উত্পাদন করতে পারে না। এ জন্য উচিত হবে বন বিভাগের কর্মকর্তারা বাওয়ালিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তবেই পাঠানো। তাহলে পাতা কাটলে অসুবিধা হবে না।তিনি বলেন, সুন্দরবনের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে এক জায়গায় নষ্ট হলে অন্য জায়গায় বৃদ্ধি পাবে। এ বিষয়ে সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা বলেন, কিছু গোলপাতা ঝড়ের কারণে বা অন্য কারণে নষ্ট হতেই পারে। পাতা কাটলে পাতা বাড়ে একথা ঠিক তবে এখন গোলপাতার চাহিদা বাইরে কম। এক সময় ১০ লাখ টন পরিমাণ পাতা আহরণ করা হতো। এখন তা কমে ২ লাখ টনে নেমেছে। যে কারণে অনুমতিও কম দেওয়া হয়। তিনি বলেন, সুন্দরবনের কোনো গাছ মানুষ লাগায়নি। ফলে এ বনের গাছও নিজস্ব নিয়মেই তার বিস্তার বৃদ্ধি করবে।

বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মাহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, আগে বড় বড় নৌকা নিয়ে এসে বাওয়ালীরা তাদের পাস পারমিট ছাড়া অতিরিক্ত গোলপাতা কেটে নিতেন। এতে তারা অধিক লাভবান হলেও বনবিভাগ প্রকৃত রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হতো। যার ফলে গত বছর থেকে বড় নৌকা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ১৪ মিটার দৈর্ঘের নৌকার ব্যবহার ও বনের কোন ধরনের গাছ না কেটে দেশীয় গাঠ/কাঠ দিয়ে নৌকার ঝুল ব্যবহারের কড়াকড়ি নিয়ম করায় বাওয়ালীদের সংখ্যা এবার কিছুটা কম দেখা যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন বনে গোলপাতা কাটতে মৌসুমে হাজার ত্রিশেক লোক প্রবেশ করে। এত মানুষকে পাহারা দেয়ার মতো সামর্থ্য বন বিভাগের নেই। ফলে আমাদের অজান্তে বনে অনেক অপরাধ হয়। লোকসংখ্যা এবারে কম হচ্ছে। এ কারণে বনের অপরাধ স্বাভাবিকভাবেই কম হবে।

Check Also

সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন এর আয়োজনে বিজয় দিবস পালন ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান

নিজস্ব প্রতিনিধি : সাতক্ষীরায় বিজয় দিবস উপলক্ষে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা,পুরুষ্কার বিতারণ ও আলোচনা সভা  অনুষ্ঠিত হয়েছে। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।