আবু সাইদ বিশ্বাস: উপকূলীয় অঞ্চল ঘুরে ফিরে: সঠিক তথ্য উপাত্তের অভাবে উপকূলীয় জেলা সমূহে জলবায়ু তহবিলের বরাদ্দ কাজে আসছে না। পানি বৃদ্ধির পরিবর্তে জাগছে চর। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের তথ্য-উপাত্ত ও আন্তজার্তিক জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক তথ্য-উপাত্তে ভিন্নমত থাকায় সমুদ্রেপৃষ্টের উচ্চতা বাড়ছে না কমছে তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছ। আন্তজার্তিক সংস্থা বলছে ২০২০ সালের পর থেকে প্রতি পাঁচ বছরের জন্য ২০ সেন্টিমিটার করে পানির উচ্চতা বাড়বে। ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রেপৃষ্টের উচ্চতা বেড়ে বাংলাদেশের ১০ শতাংশ এলাকা সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে যাবে ও উপকূলীয় অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) বলছে স্বাধীনতার পর থেকে উপকূলীয় অঞ্চলের পানি ০ দশমিক ৫১ মিটার কমেছে। তারা বলছেন, ২০২০ সাল তো শেষ, কিন্তু বাংলাদেশের কোনও এলাকা তলিয়ে যাওয়ার তথ্য নেই। বরং দেখা যাচ্ছে যেসব এলাকা তলিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হতো, সেখানে শত কিলোমিটার এলাকা নতুন করে জেগে উঠছে। বিশেষ করে দক্ষিণের বঙ্গোপসাগরের দিকে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে নতুন চর জেগে উঠছে। এছাড়া নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, সন্দীদ্বীপ, ভোলা, বরিশাল ও পটুয়াখালী এলাকায়ও নতুন নতুন চর জেগে উঠছে। ফলে গবেষণার তথ্যে চরম গরমিল থাকায় জলবায়ু তহবিল প্রকল্পগুলে হাজার হাজার কোটি টাকা কাজে আসছে না। বরং দিনের পর দিন উপকূলীয় অঞ্চল তছনছ হচ্ছে।
আন্তজার্তিক সংস্থার তথ্য মতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ঝুঁকির মধ্যে থাকা বিশ্বের শীর্ষ ১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০৩০ ও ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বর্তমানের তুলনায় যথাক্রমে ১৪ ও ৩২ সেন্টিমিটার এবং ২১০০ সাল নাগাদ ৮৮ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। এতে বাংলাদেশের কমপক্ষে ১০ শতাংশ এলাকা সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে যাবে ও উপকূলীয় অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষ উদ্বাস্ত হবে। এছাড়া সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা ৬৭ সেন্টিমিটার বাড়লে গোটা সুন্দরবনই পানিতে তলিয়ে যাবে।
সম্প্রতি বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) ৫টি গেজ স্টেশনের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে স্বাধীনতার পর থেকে ওই স্থানগুলোর পানি ০ দশমিক ৫১ মিটার কমেছে। যেখানে দেশীয় জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমুদ্রের উচ্চতা বাড়লে নদীর উচ্চতাও বাড়ার কথা। তাতে আশঙ্কা অনুযায়ী বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ ডুবেও যাবে। কিন্তু সেটার কোনও লক্ষণ নেই। উপকূলীয় অঞ্চলে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় অবস্থিত বিআইডব্লিউটিএ‘র গেজ স্টেশনগুলোর তথ্য সংগ্রহে দেখা যায়, স্বাধীনতা পরবর্তী গত চার দশকে ওই এলাকায় ০ দশমিক ৫ মিটার পানি কমেছে।
সাতক্ষীরার হিরণ পয়েন্ট, পশুর নদীসহ একই এলাকায় এই গেজ স্টেশনে ১৯৭৭ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু করে বিআইডব্লিউটিএ। ওই বছর থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত ১০ বছরে পানির গড় উচ্চতা ছিল ৩ দশমিক ২৯ মিটার। কিন্তু সর্বশেষ ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে এর পরিমাণ ০ দশমিক ৯ মিটার বেড়ে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৩৮ মিটারে। উল্লেখিত ৫টি নদীর শুরুর ১০ বছরের গড় উচ্চতা দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৮৩ মিটার। আর সর্বশেষ দশ বছরের গড় উচ্চতা দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৭৩ মিটার। অর্থাৎ, আগের তুলনায় শেষ ১০ বছরে ০ দশমিক ৫১ মিটার উচ্চতা কমেছে। তারা বলছে ১৯৮২ সাল থেকে টেকনাফের নাফ নদীর পানির উচ্চতা নির্ণয় করে আসছে বিআইডব্লিউটিএ। তখন থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত নাফে পানির সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল ৪ দশমিক ১৪ মিটার। কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত শেষ ১০ বছরে এ স্টেশনে পানির গড় উচ্চতা ০ দশমিক ৩২ মিটার কমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৮২ মিটারে। ১৯৭৯ সাল থেকে নোয়াখালীর হাতিয়ার চরচেঙ্গা নদীর পানির পরিমাণ রেকর্ড করে আসছে একই সংস্থা। ওই বছর থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে এ নদীতে পানির গড় উচ্চতা ছিল ৩ দশমিক ৮৯ মিটার। সর্বশেষ ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ে ০ দশমিক ২৩ মিটার বেড়ে এর গড় পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ দশমিক ১২ মিটারে।
জলবায়ু ও নদী বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীরা বলছে, বাংলাদেশের মানুষের কাছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়গুলো প্রকল্প আকারে যে ভাবে তুলে ধরা হচ্ছে তা সঠিক নয়। জলবায়ুর প্রভাবে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থের তালিকা না করে এনজিও গুলো তাদের মণগড়া প্রকল্প তৈরি করে হাজার কোটি টাকা লোপাট করছে। ফলে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। উপকূলীয় জেলা সমূহের নিন্ম অঞ্চল এখনো পানির তলে। টেকশই বেঁড়ি নির্মান না করার কারণে হাজার হাজার মানুষ উদ্বুস্তু হচ্ছে। ঝুঁকি কমাতে নানা পদক্ষেপের কথা বলা হলেও যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না কোনোটির। জলবায়ু তহবিলের প্রকল্পগুলোতেও চলছে অর্থের তছরুপ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অদক্ষতা, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা,বাগেরহাটসহ ১১টি জেলার নিন্মাঞ্চল এখনো পানির তলে। বোরোর চাষাবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায়। বিশ্ব ঝুঁকি প্রতিবেদনে ১৭২ টি দেশের ভূমিকম্প, সুনামি, হারিকেন এবং বন্যার ঝুঁকি বিশ্লেষণে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর ঝুঁকি মোকাবেলার সক্ষমতা নেই বলে দাবী করা হয়েছে।
শিল্পোন্নত দেশগুলোর মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সামনের সারিতে থাকলেও ক্ষতিপূরণ আদায়ে এখনও বেশ পিছিয়ে। যেসব দেশের কারণে বাংলাদেশকে এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে সেই দেশগুলো ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে না। উপরন্তু বিমা এবং বন্ডভিত্তিক কার্যক্রমের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোকে ঋণের বোঝায় ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুষ্ঠু নীতিমালা, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও অদক্ষতার ফলে এ খাতে বরাদ্দ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ।
প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী প্রতিবছর এ তহবিলে ১০০ বিলিয়ন ডলার করে অর্থায়নের কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ১০ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়েছে। অথচ প্রকল্প জমা পড়েছে ২০ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের। আর ২০১৫ থেকে এখন পর্যন্ত প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে ২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। এ থেকে সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ বাংলাদেশসহ ১০টি দেশকে গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ) মাত্র ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে অনুমোদিত সর্বমোট তহবিলের মাত্র ০.০৭ শতাংশ।
বিআইডব্লিউটিএ’র হাইড্রোগ্রাফি হাইড্রোগ্রাফি বিভাগের একজন শীর্ষস্থানীয় প্রকৌশলী বলেন, ‘আমাদের যতগুলো গেজ স্টেশন রয়েছে প্রতিটিতেই জন্মলগ্ন থেকে যে লেভেল থেকে পানি মাপা হয় আজও সেই লেভেল থেকে মাপা হচ্ছে। এগুলো অবশ্যই স্থায়ী স্টেশন।