আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা: বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় জেলা সমূহে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় কয়েকলক্ষ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ফলে বোরো উৎপাদন নিয়ে হতাশায় পড়েছে হাজার হাজার কৃষক। জলাবদ্ধার কারণে শুধু সাতক্ষীরা জেলার ৩৬ হাজার ৮০৪ হেক্টর নিচু জমিতে বোরোর আবাদ করা সম্ভব হচ্ছে না। একই অবস্থা অন্য জেলা গুলোতেও। সরেজিমনে দেখা গেছে, বিস্তীর্ণ এলাকার নিচু জমি পানিতে তলিয়ে আছে। পানি সরিয়ে দেওয়ার জন্য সেচযন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স ২০১০ অনুসারে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলা সমূহ বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। অতি বৃষ্টি ও অনা বৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতা ও বন্যায় প্রায় ২.০ মিলিয়ন হেক্টর জমির ধান আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এছাড়া বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি অসম বন্টনের কারণে দেশের প্রায় তিন মিলিয়ন হেক্টর জমির ধানের ফলন কমে যাচ্ছে। এর পরও দেশের মানুষের খাদ্য নিশ্চিত করতে চাষিরা দিন রাত পশ্রিম করে যাচ্ছে।
জেলাতে মোট এক লক্ষ ৭৭ হাজার ৮১৪ হেক্টর জমির মধ্যে আবাদি জমির পরিমাণ এক লক্ষ ৩১ হাজার ৭৮৮ হেক্টর। এর মধ্যে স্থায়ী পতিত জমি রয়েছে ৪৫ হাজার ১১০ হেক্টর। এর বাইরে চাষ যোগ্য জমির মধ্যে মাঝারি ও নিচু জমির পরিমাণ ৩৬ হাজার ৮০৪ হেক্টর। এসব জমির বেশির ভাগ অংশ এখনো পানির তলে। ফলে বড় ধরণের জলাবদ্ধতায় রূপ নিয়েছে জেলার নিন্ম অঞ্চল।
কৃষকরা জানান, খাল, বিল ও নদীতে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ,ঘেরের কারণে পানি সরানোর ব্যবস্থা না থাকায় বিলের পানি যাচ্ছে না। এই সময় ধান, আলু, গম, খেসারী সবকিছু তৈরি করি। এখন করতে পারছি না। হাজার হাজার বিঘা জমি আটকা পড়ে আছে পানিতে। স্থানীয়রা জানান, ‘সাতক্ষীরা সদর উপজেলার পশ্চিমে জেলার সর্ববৃহৎ বিল দাঁতভাঙ্গা, মালিনি ও পদ্মবিলসহ ১৩ টি বিল এখনও ফসল শূন্য। এসব বিল ও গ্রামের পানি নিষ্কাশনের একমাত্র পথ সীমান্তের ইছামতি নদীর শাখরা স্লুইস গেট। ওই গেট দিয়ে পানি তো সরছেই না বরং স্লুইস গেটের তল দিয়ে নদীর জোয়ারের পানি উল্টো এলাকায় ঢুকছে। এই গেটটির সংস্কার হলে এলাকা বোরো চাষের উপযোগী হবার সম্ভাবনা ছিলো। তালার কপোতাক্ষ নদ সংলগ্ন বিল এখনো পানির তলে। ফলে পাটকেলঘাটা,শাকদহা,ইসলামকাটিসহ জেলার প্রত্যন্ত নিতু এলাকা গুলোতে এখনো বোরো আবা নিশ্চিত করতে পারছে না চাষিরা।
সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরার সাত উপজেলায় ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ২৪ হাজার ৫০০ হেক্টর, কলারোয়ায় ১৪ হাজার হেক্টর, তালায় ২০ হাজার হেক্টর, দেবহাটায় ৬ হাজার হেক্টর, কালীগঞ্জ উপজেলায় ৫ হাজার ৫০০ হেক্টর, আশাশুনিতে ৮ হাজার হেক্টর ও শ্যামনগরে ২ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। যে খানে গত বছর আবাদ হয়ে ছিল ৭৬ হাজার হেক্টর জমিতে। জেলাতে বোরো উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লক্ষ ৫১ হাজার ২শ মেট্রিক টন।
কৃষি বিভাগের হিসাব মতে জেলাতে ৩ লক্ষ ৮১ হাজার ৭৩০ হেক্টর ফসলি জমি আছে। এসব জমিতে ৩ লক্ষ ৫৮ হাজার ৫৫০টি পরিবার কৃষি কাজ করে থাকে। এর মধ্যে ভুমিহীন চাষী রয়েছে ৬৭ হাজার ২৩০টি,প্রান্তিক চাষী রয়েছে এক লক্ষ ৩১ হাজার ৩৭টি,ক্ষুদ্র চাষীর সংখ্যা এক লক্ষ ৯৫৭টি, মাঝারি চাষী রয়েছে ৪৪ হাজার ৮৪২টি এবং বড় চাষী রয়েছে ১৪ হাজার ৪৮৪টি। মোট ১৪ লক্ষ ৩৪ হাজার ২শ ব্যক্তি সরাসরি কৃষির সাথে জড়িত। এসব কৃষকের মধ্যে বর্তমান বোরো চাষের সাথে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ জড়িত।
কৃষি বিশেজ্ঞরা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। তবে পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানোর কৌশল অবলম্বন করা হবে। যেমন- বৈরী জলবায়ুর (লবণাক্ততা, বন্যা, খরা, জলাবদ্ধতা ও অধিক তাপ সহিষ্ণু) সাথে খাপখাওয়ানোর মতো উচ্চফলনশীল ফসলের নতুন নতুন জাতের উদ্ভাবন ও ব্যবহার এবং এগুলোর চাষাবাদ বাড়াতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে সরকার। নতুন শস্যপর্যায় ও অভিযোজন কৌশলের ওপর ব্যাপক গবেষণা জোরদার করা হয়েছে। কৃষিতে তথ্য প্রযুক্তি, স্যাটেলাইট, মলিকুলার ও বায়োটেকনোলজি প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে। শস্যবীমা চালু করার কথা ভাবছে সরকার।
সাতক্ষীরা কৃষি বিভাগের উপপরিচালক নূরুল ইসলাম জেলাতে লক্ষ্য মাত্রাা চেয়ে বেশি জমিতে বোরোর আবাদ হতে চলেছে। প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও জেলার চাষিরা ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ করে রের্কড সৃষ্টি করবে। জলাবদ্ধতা না থাকলে বোরোর আবাদ আরো বৃদ্ধি পেত বলে তিনি মনে করেন। তিনি আরো জানান
জেলা খামার বাড়ি কৃষকদের পাশে আছেন। সার্বিক খোজ খরব নেয়া হচ্ছে। পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
দেশের প্রতিটি উপজেলায় জলবায়ুর ঝুঁকি মানচিত্র তৈরি করে কৃষি, খাদ্য ও অবকাঠামোসহ সবগুলো বিষয় নিয়ে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা, গবেষণার মাধ্যমে বৈরী জলবায়ুর সাথে অভিযোজন ক্ষমতাসম্পন্ন কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও তার স্বতঃস্ফূর্ত বাস্তবায়নের দাবী জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।