সাতক্ষীরার টালি ইউরোপের বাজারে

সাতক্ষীরার মাটির তৈরি টালি শুধু বিদেশিদের নজর কাড়েনি, ঘুরিয়েছে দেশের অর্থনীতির চাকাকেও। টালি এখন সাতক্ষীরার এক নম্বর অর্থনৈতিক খাত। টালি শিল্পকে কেন্দ্র করে জেলার কলারোয়া উপজেলায় গড়ে উঠেছে শিল্প পল্লী। কোন মেশিন বা যন্ত্র ছাড়াই সম্পূর্ণ হাতের তৈরি টালি দখল করে নিয়েছে ইউরোপের বাজার। মুরারীকাটি-শ্রীপতিপুরে মাটির কারিগররা গড়ে তুলেছে বাহারি টালির এক সাম্রাজ্য। সেখানকার মাটির টালি এক প্রকার রাজকীয় ভাবেই দেশের ভূখন্ড পেরিয়ে চলে যাচ্ছে সুদূর ইউরোপের ইতালিসহ কয়েকটি দেশে। এখানকার ডজন দুয়েক টালি কারখানা থেকে যাচ্ছে টালি আর আসছে ডলার-ইউরো। মাটি কারিগরদের মেধা ও শ্রমে গড়ে ওঠা টালির আজ তাই ঠাঁই মিলেছে দেশের রফতানিযোগ্য পণ্য তালিকায়। আর এলাকাটিও পরিচিতি পেয়েছে ‘ইতালি নগর’ নামে।পোড়া মাটির টালি প্রশংসা পাচ্ছে বিদেশিদেরও। কংক্রিট বা টাইলসকে পিছনে রেখে সাতক্ষীরার মাটির তৈরি টালি বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে রয়েছে। সমৃদ্ধ করেছে দেশের অর্থনীতিকে। দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য ও শিল্পকে তুলে ধরেছে বিশ্ব দরবারে।কলারোয়া উপজেলার মুরারীকাটি, শ্রীপতিপুর ও মির্জাপুর এ তিনটি গ্রামে টালি কারখানা রয়েছে প্রায় ৩২টি। পাল বংশের ঊষালগ্ন থেকেই এখানে মাটির শিল্প গড়ে উঠেছে। যুগ যুগান্তর ধরে শিল্পী আপন হাতের সুনিপুণ স্পর্শে গড়েছেন মাটির তৈরি নানা জিনিস।এসব জিনিসের মধ্যে রয়েছে মাটির তৈরি হাড়ি, কড়াই, কলস, ভাঁড়, টালি, খেলনা, পুতুল, ফুলদানি, ছাঁইদানি আরো কত কী? তার মধ্যে সব চেয়ে বেশি আকর্ষনীয় হয়ে বিদেশিদের নজর কেড়েছে মাটির তৈরি টালি। ২০০০ সালের আগ পর্যস্ত এ টালি দেশের মানুষ ঘরের চালের ছাউনি হিসেবে ব্যবহার করে আসছিল। ২০০০ সালের পর থেকে মাটির তৈরি টালি বিদেশে রফতানি হতে থাকে। প্রথমে টালি ইটালির বাজার দখল করে। পরে তা বিস্তৃত হয়ে নেদারল্যন্ড, দুবাই, স্পেন, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের বাজারে ক্রেতা সৃষ্টি করেছে। গত বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা টালি কারখানা পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে তিনি পাল পাড়ার বিভিন্ন ডিজাইনের টালি দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন। কাররা এক্সপোর্ট-ইম্পোর্ট প্রাইভেট লিমিটেডের সত্ত্বাধিকারি রুহুল আমিন জানান, কলারোয়া থেকে ২০০৩ সালে ইতালিতে টালি রফতানি করেন । তিনি ইতালিতে টালি রফতানির জন্য ভালো মাটি খুঁজতে থাকেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। অবশেষে তার সেই কাঙ্খিত মাটির সন্ধান পান এই মুরারীকাটি এলাকাতেই। রুহুল আমিনই সর্ব প্রথম এ এলাকায় রফতানিযোগ্য টালি ব্যবসার পথ দেখান। এই পথ ধরেই গত ৬ বছরে এ এলাকায় স্থাপিত হয়েছে ২৫-৩০টির মত টালি কারখানা। ‘ইতালি নগর’ ঘুরে দেখা যায়, প্রত্যেকটি টালি কারখানায় রফতানির জন্য মজুদ করা আছে বিপুল পরিমাণ বাহারি ডিজাইনের টালি। রয়েছে পোড়ানোর অপেক্ষায় রোদে শুকানো টালি। শত শত পুরুষ-মহিলা শ্রমিক ব্যস্ত মাটির কাজে। এ সব মাটির কারিগররা কাজের দক্ষতার স্তর ভেদে ১শ’-দেড় শ’ থেকে আড়াই শ’ টাকা পর্যন্ত দৈনিক পারিশ্রমিক পেয়ে থাকে। কলারোয়া ক্লে টাইলস, কটো ইনোভেটর, আরনো এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট, জে.এস ট্রেডার্স, ডি.চন্দ্র পাল, নিকিতা ইনটারন্যাশনাল, কটো ইনোভেটর লিমিটেড -এমন নামের রফতানিযোগ্য প্রতিষ্ঠান এখানে ছড়িয়ে রয়েছে। ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এদেশের মাটি দিয়ে গড়া এই টালি মেঝেতে, ছাদে, দেয়ালে টাইলস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। রফতানি করা এই টালি ইতালিয়ানদের চাহিদা অনুযায়ি বিভিন্ন কেমিক্যাল সংমিশ্রণে এর রূপ বদলে করা হয় টাইলস ও শোপিস। যা সৌন্দর্য প্রিয় ইউরোপীয়দের বিভিন্ন ভবন ও স্থাপনার কারুকার্যের জৌলুস বাড়ায় । আর আমাদের দেশের কারিগরদের উজ্জীবিত করে বেশি বেশি টালি উৎপাদন ও রফতানিতে।কলারোয়া উপজেলা টালি মালিক সমিতির সভাপতি ও ক্লে টাইলস ফ্যাক্টরির স্বত্বাধিকারি গোস্ট চন্দ্র পাল জানান, ১৯৪৭ সাল থেকে তারা টালি তৈরি করছেন। তাদের পূর্ব পুরুষরাও এ শিল্পের সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি বলেন, চলতি বছর বিদেশে টালি রফতানি করে কলারোয়া টালি শিল্প পল্লীর কারখানা মালিকরা আয় করেছেন প্রায় ১২ কোটি টাকা। তিনি বলেন, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দিন দিন আমাদের তৈরি করা টালির চাহিদা বাড়ছে। তবে টালি কারখানার সংখ্যা বেশি হয়ে যাওয়ায় স্টক থেকে যাচ্ছে বেশি। গোষ্ঠ গোপাল আরও বলেন, প্রতি বছর এখান থেকে ৩-৪শ’ কন্টেইনার টালি মংলা সমুদ্র বন্দর দিয়ে ইতালি যায়। টালি কারখানাগুলোতে অন্তত দুই হাজার শ্রমিক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। বছরে ৬ থেকে ৭ মাস টালি তৈরি ও বিক্রয় হয়। সাধারণত বছরের অক্টোবর মাস থেকে শুরু হয় টালি তৈরি মৌসুম। চলে মে-জুন পর্যন্ত। বাকি সময় বর্ষাকাল থাকায় টালি তৈরি করা যায় না। ১৫ থেকে ২০ প্রকার টালি রয়েছে তার কারখানায়। টালির নাম ও দামএকেকটি টালির একেক রকম নাম। রেক্ট্যাঙ্গগুলার, স্টেপ টাইলস, হেক্সা গোনার, স্কাটিং প্রভেন সালেহ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। প্রতি পিস টালির দাম ৫টাকা থেকে ৭৫ টাকা পর্যন্ত। ৩০ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য ২০ সেন্টিমিটার প্রস্থ ও ৩ সেন্টিমিটার পুরু একটি স্কয়ার টালির দাম ১০ টাকা। ৫০ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য ২৫ সেন্টিমিটার প্রস্থ ও ৩ সেন্টিমিটার পুরু রেকট্যাংগুলার টালির দাম ৩৫ টাকা, বহুল প্রচলিত ৩০ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য ১৫ সেন্টিমিটার প্রস্থ ও আড়াই সেন্টিমিটার পুরু একটি রেকট্যাংগুলার টালির দাম ৬ টাকা। আবার ৪০ সেন্টিমিটার প্রস্থ ও ৩ সেন্টিমিটার পুরু একটি স্কয়ার টালির দাম ৪০টাকা। স্কয়ার টালি সাধারণত দেয়ালের শোভা বর্ধনে ঘরের চালের ছাউনিতে ব্যবহার করে থাকে বিদেশীরা। ঘরের মেঝে সাজানোর জন্য রয়েছে ফুলের আকারে প্রভেন সালেহ। প্রতি পিস প্রভেন সালেহর দাম ২৫ টাকা। এভাবে একেকটি টালির নকশা, গঠন ও আকার অনুযায়ি দামের হেরফের রয়েছে। ঘর সাজানোর জন্য সার্কেল টাইলস। ৪টি সার্কেল টাইলস নিয়ে একটি সেট। এক সেট সার্কেল টাইলস’র দাম ৪০ টাকা।

Check Also

গাড়িচাপায় বুয়েট শিক্ষার্থী মাসুদের মৃত্যু ‘হত্যাকাণ্ড’

প্রাইভেটকার চাপায় বুয়েট শিক্ষার্থী মুহতাসিম মাসুদের মৃত্যুকে ‘হত্যাকাণ্ড’ বর্ণনা করে দায়ীদের সর্বোচ্চ শাস্তিসহ ৬ দফা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।