ক্রাইমবাতা রিপোটঃ সাতক্ষীরা পৌরসভা নির্বাচনে ফ্যাক্টর হয়ে দাড়িয়েছে জামায়াত। বিএনপির সাথে জোটবদ্ধ ভাবে নিবাচন না করায় এ নিবাচনে জামায়াত ভোটের হিসাব পাল্টে দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ মনে করছে জামায়াত মাঠে থাকলে তাদের জয় অনেটা সুনিশ্চত।
বিগত নির্বাচনে জামায়াত-বিএনপি ও তাদের শরীকরা মিলে একক প্রার্থী দিয়েছিলেন। এবার নির্বাচনে সেই সম্পর্ক ভেঙে গেছে। জামায়াত ও বিএনপির সেই সম্পর্কে ফাটল ধরেই ক্ষ্যান্ত হয়নি। বরং তারা আলাদা হয়ে গেছে এবং স্ব স্ব দলের প্রার্থীও মনোনয়ন দিয়েছে। অপরদিকে গত নির্বাচনে জাতীয় পার্টি অংশ নিলেও এবার নেয়নি। জাতীয় পার্টি সরকারের শরীক দল। সেকারণে এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাথে জাতীয় পার্টি ভোটের মাঠে আছে-এটা সাধারণ মানুষের মন্তব্য।
সাতক্ষীরা পৌরসভা নির্বাচনের তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, সাতক্ষীরা পৌরসভায় আওয়ামী লীগের প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন শেখ আশরাফুল হক। মেয়রও তিনি প্রথম। পরপর দুইবার তিনি নির্বাচিত হন নিরপেক্ষ ভোটে। এর আগে বা পরে আওয়ামী লীগ ঘরাণার কেউ নির্বাচিত হতে পারেন নি সাতক্ষীরা পৌরসভায়। এবারে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী শেখ আশরাফুল হকের ছেলে শেখ নাসেরুল হক। আওয়ামী লীগসহ মহাজোটভুক্ত দলের আর কোন প্রার্থী নেই সাতক্ষীরা পৌরসভায়। অপরদিকে সরকার বিরোধী পক্ষের প্রার্থী রয়েছেন ৪জন। প্রার্থীরা হলেন বিএনপি মনোনীত বর্তমান মেয়র তাসকিন আহমেদ চিশতি, জেলা জামায়াতের সেক্রেটারী মো. নুরুল হুদা, বিগত নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় বিএনপি থেকে বহিস্কৃত ও সাতক্ষীরা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি নাসিম ফারুক খান মিঠু এবং ইসলামী আন্দোলনের ডা. এসএম মুসতাফীজ উর রউফ। ফলে ভোটের হিসাব যেমন অনেকে জটিল বলছেন, আবার অনেকে বলছেন খুবই সহজ।
বিগত ২০১৫ সালের সাতক্ষীরা পৌরসভা নির্বাচনে মোট ৭৯ হাজার ৬ শত ৩৪ জন ভোটারের মধ্যে ৫১ হাজার ৬২০ জন তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী (ধানের শীষ প্রতীক) তাজকিন আহমেদ চিশতি ১৬ হাজার ৪৭০ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি জাতীয় পার্টির (লাঙ্গল প্রতীক) প্রার্থী শেখ আজহার হোসেন পেয়েছিলেন ১২ হাজার ৮৭৩ ভোট। এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী নাছিম ফারুক খান মিঠু ১২ হাজার ৫৩২ ভোট পেয়ে ৩য় অবস্থানে ছিলেন এবং আওয়ামী লীগের (নৌকা প্রতীক) নিয়ে মো. সাহাদাৎ হোসেন ৯ হাজার ৭২ ভোট পেয়েছিলেন।
এবার সাতক্ষীরা পৌরসভা নির্বাচনে মোট ভোটার ৮৯ হাজার ২২৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৪৩ হাজার ৪১৮ জন ও নারী ভোটার ৪৫ হাজার ৮০৬ জন। মেয়র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী শেখ নাসেরুল হক, বিএনপি’র মনোনীত প্রার্থী তাজকিন আহমেদ চিশতি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত প্রার্থী ডা. এসএম মুসতাফীজ উর রউফ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নাছিম ফারুক খান মিঠু ও মো. নুরুল হুদা। আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরা পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ইভিএম পদ্ধতিতে।
উল্লেখ্য, এবছর জাতীয় পার্টির পক্ষে কোন প্রার্থী নেই। ফলে জাতীয় পাটির একসময়ের শক্তিশালী ঘাটি সাতক্ষীরা পৌরসভার সেই ভোট কোন প্রার্থীর প্রতীকে পড়বে তার উপর নির্ভর করছে অনেক হিসাব নিকাশ।
অনেকেই মনে করেন পুরাতন ভোটাররা যে পক্ষেই থাক না কেন নতুন ভোটারদের অধিকাংশই ঝুকবে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে। কারণ গত ১২ বছর দেশে যেমন ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে, আবার মাঠে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের একচেটিয়া সুযোগটাও পেয়েছে সরকার দলীয় পক্ষের লোকজন। এরফলে প্রথমবাবের মত যে ১০ হাজার নতুন ভোটার এবার ভোট কেন্দ্রে যাবেন তাদের অধিকাংশের ঝোকটা থাকবে নৌকার পক্ষেই। সাবেক মেয়র শেখ আশরাফুল হক দলমতের উর্দ্ধে উঠে পৌর এলাকার আমজনতার কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি প্রতিদিনই ভোর থেকে পৌর এলাকার সাধারণ জনগনের বাড়ি বাড়ি যেয়ে তাদের হাড়ির খবর নিতেই। কারো নানা, কারো চাচা, আর কারো ভাই ছিলেন তিনি। বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়ে শেষ নির্বাচনে তিনি পরাজিত হলেও তাকে নতুন করে স্মরণ করার প্রবণতা দেখা দিয়েছে তার ছেলেকে ঘিরে। তাছাড়া শেখ নাসেরুল হক ব্যক্তিগতভাবে ক্লিন ইমেজের মানুষ। কোন বদনাম নেই তার। তার প্লাস পয়েন্ট গত নির্বাচনে পরাজিত আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী সাহাদাৎ হোসেন। পাঁচ বছর বসে থাকেননি সাহাদাৎ। ভোটে হেরেও মানুষের দ্বারে দ্বারে গেছেন এবারের ভোটেকে টার্গেট করে। তিনি মনোনয়ন না পেলেও দলের পক্ষে তার এই কর্মকান্ডের ফল শেখ নাসেরের ঘরে উঠবে বলে মনে করেন অনেকে। সরকারের শরিক জাতীয় পাটির ভোটের বড় অংশটাই নৌকায় যেতে পারে বলে মনে করেন অনেকে। তবে যেগুলো নৌকায় যাবে না সেগুলো বাকি চার প্রার্থীর প্রতীকে ভাগ হতে পারে। সবমিলিয়ে নৌকার অবস্থান এবার অনেক শক্তই হবে মনে করেন অনেকে।
বিগত ২০১৫ সালের নির্বাচনে বিএনপি’র মনোনীত প্রার্থী তাসকিন আহমেদ চিশতি বিজয়ী হন। এবার তার সম্বল মানুষের সাথে সদালাপ। পৌরসভায় গেলেই মিষ্টিমুখের কথা ভোলেননি কেউ। যদিও আশানুরূপ উন্নয়ন করতে পারেন নি সরকার বিরোধী মেয়র হওয়ায় বলে মনে করেন অনেকে। তাছাড়া সরকারি দলের যাদের ঘিরে তিনি নির্বিঘœ থেকেছিলেন গত ৫ বছর তাদের কর্মকান্ডের দায়ভার তাকে বহন করতে হচ্ছে। এরপরও বেশ সুবিধাজনক স্থানে থেকেও জামায়াত পৃথক প্রার্থী দেওয়ায় হিসাবটা গোলমেলে হয়ে গেছে। অপরদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী নাসিম ফারুক খান মিঠু এবং ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী ডা. এসএম মুসতাফীজ উর রউফ তারই ভোটে ভাগ বসাতে পারেন বলে মনে করছেন অনেকে।
স্বতন্ত্র প্রার্থী নাসিম ফারুক খান মিঠু গত নির্বাচনে বিজয়ী মেয়র প্রার্থী তাজকিন আহমেদ চিশতির থেকে ৩ হাজার ৯শ ৩৮ ভোটের ব্যবধানে ৩য় অবস্থানে ছিলেন। ভোটের পর থেকে বসে ছিলেন না। এলাকায় এলাকায় গেছেন সবসময়। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক সাহায্য সহায়তা করেছেন। যুব সমাজের মধ্যে তার নিজস্ব একটা বলয় রয়েছে। ব্যবসায়ী নেতা হিসেবেও তিনি অনেকেরই আস্তাভাজন। তাছাড়া রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক অপশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তিনি চেম্বার অব কমার্সের সভাপতির চেয়ারে বসে আছেন। ফলে তাকে কেউ ছোট করে দেখছেন না।
স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন জেলা জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক মো. নুরুল হুদা। ২০১৩ সালে সাতক্ষীরা জেলায় নজিরবিহীন সহিংসতার পর অনেকে জামায়াতের মেরুদন্ড ভেঙে গেছে বলে মনে করলেও এবারের পৌর নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে তাদের অবস্থান জানান দিচ্ছেন। তাদের ভোট ব্যাঙ্ক অক্ষত রয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। এমনকি নারীদের মধ্যে তাদের ভোট বেড়েছে বলেও অনেকের ধারণা। তাদের অবস্থান দুর্বল হয়েছে, নাকি ভালো হয়েছে সে প্রমান পাওয়া যাবে এই নির্বাচনে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত প্রার্থী ডা. এসএম মুসতাফীজ উর রউফ। দলীয় প্রতীক হাতপাখা নিয়ে তিনি লড়ছেন সাতক্ষীরা পৌরসভা নির্বাচনে। ধীর কদমে এগিয়ে যাচ্ছে দলটি। ভোটও বাড়ছে বলে মনে করেন অনেকে। কতটা বেড়েছে সেই পরীক্ষার ফলের জন্য অপেক্ষা করতে হবে ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের ভোট শেষে ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত।