সাতক্ষীরায় ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পে ধ্বস: হাজার কোটি টাকার ক্ষতি: মুখথুবড়ে পড়েছে রপ্তানি যোগ্য টালি শিল্প

আবু সাইদ বিশ্বাস: করোনায় সাতক্ষীরায় ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প চরম ক্ষতি গ্রস্থ হয়েছে। সরকারী পৃষ্টপোষকতার অভাবে এখাতটি ধ্বংসের মুখে। বিশেষ করে ইউরোপের বাজারে টালি রপ্তানি বন্ধ থাকায় জেলায় রপ্তানিযোগ্য অর্ধশত টালি কারখানা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সহজশর্তে ব্যাংক ঋণ না পাওয়াসহ নানা কারনে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনাময় এই টালি শিল্প মুখথুবড়ে পড়েছে। অধিকাংশ কারখানায় উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। ফলে টালি শিল্পের সাথে জড়িত প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক মানবেতর জীবনযাপন করছে। সরকারি সহযোগীতা না পেলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সম্ভাবনাময় এই শিল্প অচিরেই ধবংস হয়ে যাবে বলে মনে করেন এখানকার টালি শিল্পে কর্মরতরা ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৯ সালের জরিপ অনুযায়ী দেশে বর্তমানে ৪৬ হাজার ২৯১টি উৎপাদন ইউনিটের মধ্যে ৮৭ শতাংশই ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প। বর্তমানে দেশের উৎপাদন খাতের ৩৩ শতাংশ উৎপাদন করে থাকে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প এবং এ শিল্পের সঙ্গে ১৩ লাখ ৯১ হাজার শ্রমিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত রয়েছেন। শিল্প মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানায়, করোনা মহামারীতে বিপর্যস্থ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে সহায়তার জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা সুবিধা দেয়া হয়েছে। যাদের ব্যাক লেনদেন নেই তারা এসব সুবিধা পাবে না বলে জানানো হয়। যেসব ক্ষতিগ্রস্থ উদ্যোক্তা সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণসুবিধা প্রাপ্তির জন্য যোগ্য নয়, সেসব ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের উদ্যোক্তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য ১১০০ কোটি টাকার বরাদ্দ দেয়া হয়। দুটি সংস্থার মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত শিল্পের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের এই ঋণ সুবিধা দেওয়ার কথা। এর মধ্যে এসএমই ফাউন্ডেশনের জন্য ৫০০ কোটি টাকা ও বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন (বিসিক)-এর জন্য ৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সাতক্ষীরা জেলার বেশির ভাগই ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে নিয়োজিতার সরকারের কোন আর্থিক সহযোগীতা পায়নি বলে জানা যায়।
বিশ্বব্যাংকের বলছে করোনায় কাজ হারিয়েছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ৭৪ লাখ মানুষ
দুই কোটির বেশি মানুষের কর্মসংস্থান, বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের ৩৭ ভাগ কর্মী করোনা মহামরির কারণে সাময়িক অথবা স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংকের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি)। এক জরিপে বলা হয়, করোনার কারণে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশেই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পখাতে (এসএমই) সবচেয়ে বেশি মাত্রায় ক্ষতির শিকার হয়েছে। বাংলাদেশের মোট কর্মসংস্থানের শতকরা ৩৫ ভাগ রয়েছে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২০ ভাগ যোগান দেয়া এই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পখাতে। করোনাভাইরাসের কারণে এসএমই খাতের ৯৪ ভাগ প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলে জানানো হয় এই জরিপে।
সূত্র জানায়, বিগত ২০০০ সালে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার মূরালিকাটি পালপাড়া এলাকায় প্রথম শুরু হয় বিদেশে রপ্তানিযোগ্য বিভিন্ন প্রকারের টালি উৎপাদন। শুরুতেই ৫টি কারখানায় উৎপাদিত টালি ইটালিতে রপ্তানি শুরু করে এখানকার টালি কারখানা মালিকেরা। সে কারনে এই এলাকাটি ‘ইটালী নগর’ হিসিবে পরিচিতি লাভ করে। ২ বছর যেতে না যেতেই এখানকার উৎপাদিত টালি নজর কাড়ে বেশ কয়েকটি দেশে। একে একে দুবাই, ইউরোপ, মালেশিয়া, দক্ষিণ আফরিকা, নেদারল্যান্ড ও আমেরিকায় জাহাজে করে রপ্তানি শুরু। চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে কারখানার সংখ্যাও বাড়ে ৫০টিতে । যা কারখানা গুলো কলারোয়ার মূরারিকাটি, শ্রীপতিপুর ও মির্জাপুর,ঝাওডাঙ্গার তুজুলপুর এলাকায়। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এই কারখানা গুলোতে।
প্রতিবছর প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয় হত এই শিল্প থেকে। কিন্তু ২০১০ সালের পর থেকে এই শিল্পে ধ্বস নামতে শুরু করে। সর্বশেষ ২০২০ সালে করোনা মহামারী এই শিল্পকে ধ্বসের দ্বার প্রাণে নিয়ে আসে।
স্থানীয় টালি কারখানা মালিকদের মধ্যে অনৈক, নিজেদের মধ্যে রেসারেসি, বেঁচা-বিক্রির অসমপ্রতিযোগিতা শুরু হয়। এই সুযোগ লুফেনেয় বিদেশি বায়াররা। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে টালির দাম কমতে শুররুকরে, অথচ দিন দিন উৎপাদন খরচ বাড়তে থাকে। যে টালি আগে ৬০ টাকায় বিক্রি হতো, বর্তমানে তার দাম কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮ থেকে ১০ টাকায়। বর্তমানে যে দামে বিক্রি হচ্ছে তার চেয়ে উৎপাদন খরচ বেশি হচ্ছে। লোকশানের কারনে অর্ধেকেরও বেশি টালি কারখানা বর্তমানে বন্ধ হয়ে গেছে।
টালি খারখানা মালিক ব্যবসায়ি সমবয় সমিতির সমিতির সাধারণ সম্পাদক জানান, শহজশর্তে ব্যাংক ঋণ না পাওয়া, আন্তর্জাতিক বাজার সৃষ্টিতে সরকারি সহযোগিতা না পাওয়া, আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার না হওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। উৎপাদন বিক্রি মূল্যের চেয়ে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় তাদের লোকশান হচ্ছে। এসব কারনে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনাময় এই টালি শিল্প আজ মুখথুবড়ে পড়ছে। এসব টালি শিল্পে বেশিরভাগই কর্মরত নারী গ্রমিকরা।
তুজুলপুর বাজারের টালি ব্যবসায়ী প্রো: সুকুমার পাল জানান, আমাদের ব্যাথা কাকে জানাবো। এমপি,মন্ত্রী সবার জানিয়েছি। এ শিল্পকে বাঁচাতে এখানো পর্যন্ত কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়নি। সরকারী সহযোগীতা তো দূরের কথা করোনা কালিন সময়ে কেউ খোজ সখবরও নিতে আসেনি।

 

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।