যে কোনো নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেলেই জয়লাভ নিশ্চিত- আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মনে এমন ধারণা দিনে দিনে দৃঢ় হচ্ছে। টানা এক যুগেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা এই দলটির অনেক মনোনয়নপ্রত্যাশী তাই নির্বাচনী মাঠ গোছানোর চেয়ে দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করতেই বেশি মরিয়া। আর এর সুযোগ নিচ্ছে দলটির তৃণমূলের প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়ার রাস্তা করে দেওয়ার বিনিময়ে সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। এতে দলের যোগ্য প্রার্থীরা মনোনয়নবঞ্চিত হচ্ছেন। উপায় না পেয়ে কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হচ্ছেন। এতে দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলছেন, দলের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ড তৃণমূলের মতামত ও বিভিন্ন জরিপের ওপর ভিত্তি করে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করে। সেখানে মনোনয়ন বাণিজ্যের কোনো সুযোগ নেই।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য আবদুর রহমান শুক্রবার বলেন, দল হিসেবে আওয়ামী লীগে সবচেয়ে বেশি অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের চর্চা হয়। আমাদের দলের মনোনয়ন বোর্ড রয়েছে। সেখানে বৈঠক করে যারা যোগ্য ও দলের জন্য নিবেদিত- তাদের মনোনয়ন দেওয়া হয়। এখানে মনোনয়ন বাণিজ্যের কোনো সুযোগই নেই। যারা এ ধরনের অভিযোগ করেন তারা না জেনেই করেন। একই বিষয়ে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক নেতা বলেন, বিরোধী দলের দুর্বল সাংগঠনিক অবস্থা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারের চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে এখন সব নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাই বেশি বিজয়ী হচ্ছেন। ফলে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের অনেকেই মনে করেন দলের মনোনয়ন বা সমর্থন পেলেই বিজয়ী হতে পারবেন। তাই অনেকেই চান যে কোনোভাবে দলের মনোনয়ন বাগিয়ে নিতে। কেন্দ্রীয়ভাবে সেই সুযোগ না থাকায় স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কৌশল করে তারা সেটা করার চেষ্টা করেন। যেমন কোনো সময় হয়তো তৃণমূল থেকে যোগ্য প্রার্থীর নামই দেওয়া হয় না। আবার হয়তো তৃণমূলের ভোটের ফল পরিবর্তন করে দেওয়া হয়। কখনো প্রভাব বিস্তার করে তাদের পছন্দের প্রার্থীদের তৃণমূলের ভোট পাইয়ে দেন। এ ধরনের বেশ কিছু কৌশল তারা (প্রভাবশালী মহল বা সিন্ডিকেট) অবলম্বন করে থাকেন।
এদিকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিশাল জয়ের ধারা অব্যাহত রয়েছে। নির্বাচনে বিএনপি খুব বেশি সুবিধা করতে না পারলেও অনেক ক্ষেত্রেই বিদ্রোহীদের কাছে ধরাশায়ী হচ্ছেন দলের প্রার্থীরা। এ পর্যন্ত তিন ধাপে অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অন্তত ২১ জন বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। এছাড়া স্থানীয় সরকার পর্যায়ের অন্য নির্বাচনগুলোতেও দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
তৃণমূলের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রভাবশালীদের ‘সিন্ডিকেট’ বা মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণে ত্যাগীদের দলের মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার ঘটনা যেমন ঘটছে, তেমনি অনেক ক্ষেত্রেই বিদ্রোহীদের পক্ষে স্থানীয় প্রভাবশালীদের ইন্ধনের অভিযোগও রয়েছে।
আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন চূড়ান্ত করে দলের স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ড। দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বোর্ড সভায় সভাপতিত্ব করেন। দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান যুগান্তরকে জানান, দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে মূলত তিনটি বিষয় প্রাধান্য দেওয়া হয়- প্রার্থীর জনপ্রিয়তা ও জনসম্পৃক্ততা, প্রার্থী ‘ইউনেবল’ কিনা সেটা বিবেচনা করা এবং দলের প্রতি তার কমিটমেন্ট কেমন সেটা দেখা।
জানা যায়, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠকে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের আমলনামা ধরে ধরে আলোচনা হয়। সেখানে তৃণমূল থেকে পাঠানো রেজ্যুলেশন নিয়েও চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়। এছাড়া দলের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থার জরিপ মনোনয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সবকিছু যাচাই-বাছাই করেই ‘যোগ্য, ত্যাগী ও বিজয়ী হতে পারবে’ এমন নেতাদেরই দলের প্রার্থী করা হয়।
সূত্র জানায়, দলীয় মনোনয়নের জন্য স্থানীয়ভাবে এমপি-মন্ত্রী বা প্রভাবশালী নেতারা তাদের নিজেদের প্রার্থীর দলীয় মনোনয়ন পাইয়ে দিতে চান। কিন্তু কেন্দ্রীয়ভাবে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে প্রভাব বিস্তার করা বা বাণিজ্য করার কোনো সুযোগ না থাকায় তৃণমূল থেকেই বিভিন্নভাবে এটা করা হয়। দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন এমন এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রভাব বিস্তার ও মনোনয়ন বাণিজ্যের মাধ্যমে আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনে আমি জিতে যাই। এখন এটা প্রমাণিত যে, আমার জনপ্রিয়তা বেশি ছিল। আবার তৃণমূলের ভোটেও এগিয়ে ছিলাম। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালীদের সিন্ডিকেটের কাছে আমি হেরে গিয়েছিলাম।
সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে উপজেলা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক সাজ্জাদুল হক রেজা পৌরসভা নির্বাচনে জিতেছেন। অথচ তৃণমূলের ভোটে এগিয়ে থেকেও তিনি দলের মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছিলেন। তিনি জানান, স্থানীয়ভাবে প্রার্থীর রেজ্যুলেশন তৈরির জন্য যে ভোট হয়েছিলে, সেখানে তিনি সবার চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিলেন। স্থানীয়ভাবেও তার জনপ্রিয়তা বেশি ছিল। তারপরও তিনি মনোনয়ন বঞ্চিত হন। তিনি বলেন, আমার মনে হয় আমাদের নাম হয়তো দলের সভাপতি বা মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যদের কাছে পৌঁছায় না। এগুলো হয়তো মাঝপথে কেউ বা কোনো প্রভাবশালী মহল পালটে দেয়। সেখানে সঠিক চিত্র পৌঁছলে হয়তো এমন হতো না। দলের কেন্দ্র থেকে বিষয়টি তদন্ত করা উচিত।
এবারের পৌরসভা নির্বাচনের শুরুতে তৃণমূলের রেজ্যুলেশনের বাইরে কারও কাছে দলীয় মনোনয়ন বিক্রি করেনি আওয়ামী লীগ। এরপরই সারা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে যোগ্য প্রার্থীদের নাম তালিকায় না দেওয়ার অভিযোগ আসতে থাকে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে। তখনো প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল সিন্ডিকেট করে মনোনয়ন বাণিজ্যের। পরে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে মনোনয়ন বিক্রির শর্ত কিছুটা ‘শিথিল’ করে আওয়ামী লীগ। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক বলেন, মনোনয়নের ক্ষেত্রে কোনো এক পক্ষের জন্য অন্য পক্ষের ত্যাগী ও যোগ্যরা যেন বাদ না পড়েন, তাই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এদিকে মেয়র পদে মনোনয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগে তীব্র দলীয় কোন্দল ছড়িয়ে পড়েছে রাজশাহীসহ উত্তরের বেশ কয়েকটি পৌরসভায়। কোনো কোনো পৌরসভায় মনোনয়ন বাণিজ্যের গুরুতর অভিযোগও উঠেছে। উপজেলা ও জেলার নেতা, এমপি এমনকি দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের কথা বলছেন নেতাকর্মীরা। অন্যদিকে দুর্দিনে যারা নেতাকর্মীদের পাশে থেকেছেন, দলকে ধরে রেখেছেন তাদের মনোনয়ন বঞ্চনায় রাজশাহী অঞ্চলে তৃণমূলে ক্ষোভের মাত্রা আরও বেশি। এ কারণে দলের ভেতরে সংঘাত-সংঘর্ষের শঙ্কা বাড়ছে।
জানা যায়, নওহাটা পৌরসভায় মেয়র মনোনয়নে তৃণমূলের এক সভায় রাবি ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনু পান ৩৫ ভোট ও হাফিজুর রহমান পান মাত্র ১ ভোট। কিন্তু ১৩ জানুয়ারি কেন্দ্র হাফিজুর রহমানকেই মনোনয়ন দিয়েছে। স্থানীয় এমপি আয়েন উদ্দিনের ঘনিষ্ঠ হাফিজুরের প্রতি তৃণমূল নেতাকর্মীদের কোনো সমর্থন না থাকলেও কেন্দ্র কীভাবে তাকে মনোনয়ন দিল- এ নিয়ে প্রশ্নও উঠেছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ পৌরসভায় সৈয়দ মনিরুল ইসলামকে মেয়র পদে মনোনয়ন দেওয়ায় স্থানীয় নেতাকর্মীদের মাঝে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এছাড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও শিবিরের নৃশংস হামলায় একটি পা হারানো কারিবুল রাজিন মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন। মনোনয়ন ঘোষণার পর শুধু রাজিন সমর্থকরাই নয়, দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেও চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ) আসনের এমপি ডা. শিমুল ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এলাকার ভোটার বা মানুষের সঙ্গে সৈয়দ মনিরুলের কোনোদিন যোগাযোগ ছিল না। ঢাকায় থাকতেন। কিন্তু কেন্দ্র তাকেই মনোনয়ন দিল!
কালকিনি পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন এসএম হানিফ। এ নিয়ে দেখা দিয়েছে বিতর্ক। অভিযোগ উঠেছে মনোনয়ন বাণিজ্যের। দলীয় মনোনয়ন ঘোষণার পরই কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সোহেল রানা মিঠু নিজ বাসায় সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ‘টাকার বিনিময়ে উনি (এসএম হানিফ) নৌকা কিনে নিয়ে এসেছেন। আমরা এই মনোনয়ন মানি না।’ জানা যায়, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া এমএম হানিফের আপন ছোট ভাই মানিক সদর উপজেলা যুবদলে সক্রিয় নেতা। তার স্ত্রীর আপন বড় ভাই মিজানুর রহমান উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও পৌর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক। এ নিয়েও সেখানে বিতর্ক চলছে। স্থানীয় নির্বাচনের শুরুতে মনোনয়ন বাণিজ্য বরদাশত করা হবে না বলে কড়া বার্তা দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। গত বছরের ডিসেম্বরে মনোনয়ন নিয়ে বাণিজ্য করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, দিনের পর দিন ক্ষমতার অপব্যবহার করার জন্য দলের পদ-পদবি কাউকে ইজারা দেওয়া হয়নি।যুগান্তর