করোনার প্রাদুর্ভাবে খুলনাসহ উপকূলীয় অঞ্চলে কাঁকড়া খামার বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। করোনায় কাঁকড়া রফতানি বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন এই অঞ্চলের খামারিরা। অব্যাহত লোকসানে ইতোমধ্যে ছোট-বড় বেশ কিছু খামার বন্ধ হয়ে গেছে। খামারগুলো এখন টিকিয়ে রাখাই দায়।
শুক্রবার (১২ ফেব্রুয়ারি) সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য জানা গেছে। করোনা অতিমারীর কারণে গত বছরের মার্চে চীনে কাঁকড়া রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। এতে দেশের বাজারেও কমে যায় দাম। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে চলতি বছর আরও অনেক খামারির কাঁকড়া চাষ বন্ধ করে দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে অনেক খামারি ব্যাংক ও এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে কোনও রকম খামার বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু দেশের বাজারে দাম না পাওয়ায় কাঁকড়া বিক্রি করতে পারছে না। ফলে দিনের পর দিন বাড়ছে ঋণের বোঝা। তবে মৎস্য বিভাগের পক্ষ থেকে উপকূলীয় এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত এক হাজার ৬৩ জন কাঁকড়া চাষিকে সহায়তা দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। আর খামারিরা বলছেন, ক্ষতিগ্রস্ত খামারির তুলনায় সরকারের এই সহায়তা অপ্রতুল।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটের বিভিন্ন উপজেলায় সরকারি হিসাবে প্রায় দুই হাজারের বেশি কাঁকড়া খামার রয়েছে। এসব খামারের সঙ্গে যুক্ত চাষির সংখ্যা অন্তত পাঁচ হাজার। রফতানি বন্ধ থাকায় খামারে চাষ করা অধিকাংশ কাঁকড়া মরে যাচ্ছে।
কাঁকড়া ব্যবসায়ী শেখ আনারুল ইসলাম বলেন, ‘কয়েক বছর ধরেই নানা প্রকার রোগের কারণে চিংড়ি চাষে তেমন লাভ হয়নি। তাই অনেক খামারি কাঁকড়া চাষে ঝুঁকে পড়েন, লাভও ভালোই হচ্ছিল। তবে করোনা অতিমারীর কারণে কাঁকড়া রফতানি বন্ধ ও দাম কমে যাওয়ায় সব খামারের কাঁকড়া সময়মতো বিক্রি হয়নি। এক পর্যায়ে পুকুরেই কাঁকড়া মরে যায়। তবে করোনার প্রকোপ সামান্য কমতে থাকলে গত অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে ধার দেনা করে আবারও অনেক খামারি চাষ শুরু করে। কিন্তু উৎপাদিত কাঁকড়া সরাসরি চীনে না যাওয়ায় অর্ধেক দামে বিক্রি করতে হয়। ফলে কাঁকড়া বিক্রি করে খামারিদের উৎপাদন খরচও উঠছে না।’
কাঁকড়া ব্যবসায়ী কামরুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে কাঁকড়া চাষ বন্ধ করেও খামারিরা ঋণের দায়ে ঘরে থাকতে পারছে না। আর যারা লোকসান টেনেও কাঁকড়া চাষ চালিয়ে যাচ্ছেন, তাদের অবস্থাও খারাপ। এই অবস্থায় চীনে সরাসরি কাঁকড়া রফতানি চালু করতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং বিনা সুদে ঋণ দিয়ে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার দাবি জানাচ্ছি।’
কাঁকড়া ব্যবসায়ী দেবু ঘরামী বলেন,‘রফতানিযোগ্য কাঁকড়া সাধারণত পাঁচটি গ্রেডে বিক্রয় হয়। বর্তমানে প্রত্যেক গ্রেডের দাম ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজিতে কমেছে। করোনা প্রাদুর্ভাবের আগে ২০০ গ্রাম (ফিমেল) ওজনের কাঁকড়ার কেজি ছিল ১৫০০ থেকে ১৭০০ টাকা, ওই কাঁকড়া বর্তমানে ৮০০ টাকা। ১৮০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়া ছিল ১ হাজার টাকা, তা বর্তমানে ৬০০ টাকা। ১৫০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়া ছিল ৮০০ টাকা, এখন তা ৪০০ টাকা। ১০০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়া ছিল ৬০০ টাকা, কিন্তু বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়। এমন দামে কাঁকড়া বিক্রি করে চাষিদের যেমন খরচ ওঠে না, তেমনি ব্যবসায়ীদেরও লোকসানে পড়তে হয়।’
পাইকগাছা উপজেলা কাঁকড়া সরবরাহ সমিতির সদস্য শেখ ইমাদুল জানান, সারা দেশে দুই লাখের বেশি মানুষ কাঁকড়া চাষ ও ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত। কাঁকড়ার দাম কম হওয়ায় ইতোমধ্যে কাঁকড়ার হ্যাচারিতে খাদ্য দেওয়া বন্ধ করেছে অনেকেই।
পাইকগাছা প্রাণী সম্পদ অধিদফতর বিভাগের কর্মকর্তা জয়নুল আবেদীন পিন্টু বলেন, ‘কাঁকড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় হয়েছে। দেনার দায়ে শতাধিক ব্যবসায়ী এলাকা ছেড়েছে। আশাকরি তারা বিনা সুদে অর্থ পেলে পুনরায় কাঁকড়া চাষ করতে আগ্রহী হবে।’
পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম খালিদ হোসেন সিদ্দিকী বলেন, ‘বর্তমান সময়ে করোনার প্রভাবে প্রতিদিন কাঁকড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সাক্ষত হয়, তাদের কষ্টের কথা শুনেছি। চেষ্টা করছি তাদের বিষয়টি উপরমহলে জানানোর জন্য।’