‘ওয়ান-ইলেভেন’র সংস্কারপন্থি হিসাবে পরিচিত নেতাদের জেলা-থানাসহ তৃণমূলের কোনো কমিটিতে না রাখার নির্দেশ দিয়েছে বিএনপি হাইকমান্ড। সম্প্রতি ওইসব নেতাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে দলের একটি ফোরামে পর্যালোচনা শেষে কমিটি গঠনে দায়িত্বপ্রাপ্তদের এ নির্দেশনা দেয়া হয়।
বেশ কিছু নেতার বিরুদ্ধে তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ পেয়েছে দলটি। দলকে না জানিয়ে হঠাৎ করে ওই পক্ষের নানা কর্মসূচিতে তাদের অংশগ্রহণ ভাবিয়ে তুলছে নীতিনির্ধারকদের। তাই কোনো পর্যায়ের কমিটিতে না রাখার পাশাপাশি তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক জানিয়েছেন এসব তথ্য।
স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, বিএনপির কাছে তথ্য রয়েছে ২০ দলীয় জোটের কয়েকটি শরিক দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বিশেষ একটি গোষ্ঠীর পক্ষ হয়ে নানা কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির কয়েকটি বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে বিএনপির কিছু নেতাও রয়েছেন। যার মধ্যে বেশিরভাগই সংস্কারপন্থি হিসাবে পরিচিত। কেউ কেউ প্রকাশ্যেই নানা কর্মসূচি পালন করছেন। আবার প্রকাশ্যে না এসেও অনেকে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন। বিষয়টি নিয়ে দলের মধ্যে সন্দেহ বাড়ছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে – বিএনপির ভেতরে থেকে দলের ক্ষতির চেষ্টা করছেন। ‘সরকার পতন’র পাশাপাশি জিয়া পরিবারকে ‘মাইনাস’ করারও চেষ্টা চালাচ্ছেন।
তৃণমূল পুনর্গঠনে দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক নেতা জানান, সংস্কারপন্থি হিসাবে পরিচিত নেতারা তৃণমূলের কমিটিতে পদ পেতে তৎপর হয়ে উঠেছে। অথচ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে দু-চারজন ছাড়া সংস্কারপন্থিদের বেশির ভাগ নেতাকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। কোনো সভা কিংবা দলের কোনো কর্মসূচিতেও তাদের দেখা যায় না। এমনকি তাদের সঙ্গে এলাকার নেতাকর্মীদেরও যোগাযোগ নেই। অথচ তারা জেলা ও থানা কমিটিতে থাকার জন্য সিনিয়র নেতাদের কাছে তদবির করছেন। তাদের এমন তৎপরতার বিষয়টি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে জানানো হয়েছে। কয়েকটি সভায় বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা করেছেন দলের নীতিনির্ধারকরা। পরে তাদের দলীয় পদ না দেয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, দলের চেয়ারপারসন দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে নিজ গৃহে রাখা হলেও কার্যত তিনি গৃহবন্দি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি এখন ঐক্যবদ্ধ আছে এবং যে কোনো সময়ের চেয়ে আরও বেশি শক্তিশালী। জিয়া পরিবারের বাইরে আমাদের কোনো ঠিকানা নেই। এ পরিবারের বিরুদ্ধে অতীতেও ষড়যন্ত্র হয়েছে, এখনও চলছে। কোনো ষড়যন্ত্রই সফল হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না।
তিনি বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দলের সব পর্যায়ের নেতাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবশ্যই জানেন। সবার নিয়মিত খোঁজ-খবর নেন। যারা ত্যাগী ও পরীক্ষিত তাদের দিয়েই জেলা-থানা পর্যায়ের কমিটি হচ্ছে বলেও জানান বিএনপির এই নেতা।
সূত্রমতে, দলের নির্দেশনা অমান্য করে ১৪ ডিসেম্বর রাজধানীর পুরানা পল্টনে একটি কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার কারনে দুই ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ ও শওকত মাহমুদকে শোকজ করে বিএনপি। পরে এ দুই নেতা শোকজের উত্তরও দেন। শওকত মাহমুদকে চিঠি দিয়ে ক্ষমা করলেও হাফিজ উদ্দিনকে তা দেয়নি দলটি। পরে দলের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের খেতাব বাতিলের চেষ্টা প্রসঙ্গে গুলশান কার্যালয়ে দলের এক সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তব্য দেন হাফিজ উদ্দিন। এ সময় জিয়াউর রহমানকে নিয়ে তার বক্তব্যে সন্তুষ্ট হন বিএনপি হাইকমান্ড। পরে ১৮ ফেব্র“য়ারি বরিশাল বিভাগীয় সমাবেশে তাকে প্রধান অতিথিও করা হয়।
ওয়ান-ইলেভেনে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ২০০৭ সালের ২৫ জুন বিএনপির মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া দলের অভ্যন্তরে ১৫ দফা সংস্কার প্রস্তাব দেন। তার ওই প্রস্তাবকে দলের ১২৭ জন সাবেক মন্ত্রী-এমপি সমর্থন দেন। এসব নেতাদের নিজ এলাকার কিছু অনুসারীও সংস্কারের পক্ষে ছিলেন। যারা সংস্কারপন্থি হিসাবে পরিচিতি পান।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গ্রেফতারের আগে সংস্কার প্রস্তাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত দলের মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, যুগ্ম মহাসচিব আশরাফ হোসেন, দফতর সম্পাদক মফিকুল হাসান তৃপ্তিকে বহিষ্কার করেন। তবে দলের পঞ্চম ও সর্বশেষ ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে সংস্কারপন্থি নেতাদের অনেককে পদ-পদবি দেয়া হলেও একটি অংশকে দলের বাইরে রাখা হয়।
অন্য কোনো দলে যোগ না দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি হাইকমান্ডের ওপর আস্থা রেখেছেন – এমন ১৪ জন সংস্কারপন্থি নেতাকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গুলশান কার্যালয়ে ডেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দলে কাজ করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। যাদের মধ্যে আবু ইউসুফ খলিলুর রহমান (জয়পুরহাট-২), আলমগীর কবীর (নওগাঁ-৬), সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুল (নরসিংদী-৪), জিএম সিরাজ (বগুড়া-৫), নজির হোসেন (সুনামগঞ্জ-১), আবু হেনা (রাজশাহী-৪), শহীদুল আলম তালুকদারের স্ত্রী সালমা আলম (পটুয়াখালী-২), জহিরউদ্দিন স্বপন (বরিশাল-১), মফিকুল হাসান তৃপ্তিকে (যশোর-১) দলীয় মনোনয়নও দেয়া হয়। নুরুল ইসলাম মনিকে দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য করা হয়।
সূত্র জানায়, নির্বাচনের পর থেকে দলে ফিরিয়ে আনা সংস্কারপন্থিদের বেশিরভাগ নেতা বিএনপির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় নেই। মনোনয়ন পাওয়া নেতাদের মধ্যে জহিরউদ্দিন স্বপনকে দলের কর্মসূচিতে দেখা যায়। তাকে বিএনপি কমিউনিকেশন সেলের দায়িত্বও দেয়া হয়। একইভাবে কেন্দ্রের ও নিজের নির্বাচনী এলাকায় দলীয় কার্যক্রমে সম্পৃক্ত থাকছেন সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুল। এর বাইরে জিএম সিরাজ বগুড়া-৬ আসনের উপনির্বাচনে বিএনপির টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনিসহ মফিকুল হাসান তৃপ্তিও নির্বাচনী এলাকার নেতাকর্মীদের নিয়মিত খোঁজখবর রাখার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় কর্মসূচিতেও অংশ নিচ্ছেন।
বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা জানান, সাবেক মন্ত্রী-এমপিসহ স্থানীয় পর্যায়ের নেতা যারা সে সময় সংস্কারপন্থি হিসাবে পরিচিত ছিলেন, তারা অনেকে নিজ এলাকায় দলীয় পদ চাইছেন। যাদের বয়স হয়েছে তারা তাদের সন্তানদের পদ দিতে তদবির করছেন। অথচ বিগত দিনের আন্দোলনে তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি, একটি মামলা পর্যন্ত নেই। সংস্কারপন্থিদের এমন মনোভাব দলীয় নেতাকর্মীর মাঝে সন্দেহ তৈরি করাটাই স্বাভাবিক। যুগান্তর