অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, দেশে অবশেষে রাজনৈতিক বন্ধ্যত্ব ঘুচতে চলেছে। সরকারের কঠোর দমননীতি সত্ত্বেও বড়-ছোট নির্বিশেষে বিরোধী দলসমূহ মাঠে নামার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান সব ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজপথে নামার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, শুধুমাত্র একটিমাত্র অধিকার অর্থাৎ ভাষার অধিকার কেড়ে নেওয়ার কারণে বাংলাদেশের মানুষ লড়াই করে বিজয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু আজ এদেশের মানুষ সব অধিকারহারা। মানুষের জীবন, সম্মান, মেধা, ভোটাধিকার, বাকস্বাধীনতা প্রভৃতি সকল অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ডা. শফিকুর রহমান জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দিতে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে বলেন, সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজপথে নামুন। দাবি আদায় হবে, ইনশাআল্লাহ। তিনি বলেন, সব অপশাসনের অবসান হবে। রাতের অন্ধকার দূর হবে। সকালের আলো আসবে। মুক্তির সূর্য উদিত হবে। তিনি বলেন, সর্বজনীন অধিকার হরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করে জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। এজন্য মজলুম জনগণকে পাশে চাই। তিনি বলেন, অধিকার কেউ কাউকে দেয় না। লড়াই করে অধিকার আদায় করতে হয়। এজন্য বুকে সাহস থাকতে হয়।
কয়েকদিন আগে বরিশালে বিএনপির উদ্যোগে একটি বিরাট জনসভা হয়। এই জনসভা বানচালের জন্য কর্তৃপক্ষ সবরকম অপচেষ্টা চালায়। ঢাকা থেকে ৩০টি গাড়িযোগে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও কর্মীবৃন্দ বরিশালের উদ্দেশে রওনা হন। এই খবর পেয়ে ফেরিঘাটের কর্মকর্তা এবং কর্মীবৃন্দ রহস্যময় কারণে ফেরি বন্ধ করেন এবং অফিস বন্ধ করে অফিস ছুটির আগেই চলে যান। বাধ্য হয়ে কয়েকজন নেতা ও কর্মী নৌকাযোগে ভিন্ন পথে বরিশালে পৌঁছেন। যারা বরিশাল পৌঁছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মরহুম সাদেক হোসেন খোকার পুত্র ইশরাক হোসেন। সভায় তিনি বলেন, তাদের ৩০টি গাড়ি ফেরিঘাটের ওপারে পড়ে আছে। অনুরূপভাবে বরিশালের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা শত শত মানুষকে পুলিশ ফিরিয়ে দেয়। তরপরও সমাবেশের আকার বিশাল রূপ ধারণ করে। এই সমাবেশে বিএনপি নেতৃবৃন্দ তাদের বক্তব্যে অত্যন্ত কঠোর ভাষা প্রয়োগ করেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্ট মোতাবেক, এই সভার প্রধান বক্তা ছয়বারের এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। প্রতিবাদে দেড় লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। বর্তমান সরকার সামরিক সরকারের চেয়েও নিকৃষ্ট। কিন্তু আমরা কয়জন তার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে এসেছি? তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছি। আমরা ভোটাধিকারের জন্য যুদ্ধ করেছি। তিনি বলেন, এখন আর স্লোগান নয়। রাজপথে গিয়ে সরকারের সন্ত্রাসী বাহিনীকে প্রতিরোধ করুন। মেজর হাফিজ তার জ্বালাময়ী বক্তৃতায় বলেন, “আমরা কি এই দেশ দেখার জন্য যুদ্ধ করেছিলাম, যে দেশে সাধারণ মানুষকে গুম, খুন, হত্যা, অন্যায়-অবিচার করা হয়?” তিনি নেতাকর্মীদের মধ্যে সরকারবিরোধী প্রতিবাদের আগুন, প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ দেখতে চান। শুধুমাত্র মেজর হাফিজ নন, সভার প্রায় সব বক্তা অবিলম্বে সরকার পতন আন্দোলন শুরু করার জন্য জনতাকে রাজপখে নেমে আসার আহ্বান জানান।
বরিশালের মাঠ থেকেও রাজপথে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করার আহ্বান জানানো হয়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একজন মৃদুভাষী ভদ্রলোক হিসেবে পরিচিত। কিন্তু ইদানীং তার মতো মানুষের বক্তৃতাতেও সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষার প্রয়োগ লক্ষ করা যাচ্ছে। তিনি এই সরকারকে স্বেচ্ছাচারী ও কর্তৃত্ববাদী বলছেন। চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে অবস্থান করা সত্ত্বেও তিনি সেখান থেকে প্রতিনিয়ত রাজপথে সরকারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টির আহ্বান জানাচ্ছেন। বরিশালে জনসভার আগে ঢাকায় বিএনপির একাধিক সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। সেই বিক্ষোভ মিছিলে অন্তত ৫ হাজার লোকের সমাবেশ হয়েছে। এই মিছিলে পুলিশ বেপরোয়া লাঠিচার্জ করেছে এবং ২৫ জনের অধিক কর্মীকে গ্রেফতার করেছে। এছাড়া ১২৫ জনের বেশি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা দায়ের করেছে। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি বুধবার বিএনপি সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেয়। এ সমাবেশ মনে করিয়ে দেয় ২০১৫ সালের কথা। তখন পুলিশ সবসময় টিয়ার গ্যাস, জলকামান ইত্যাদি নিয়ে রায়ট গিয়ারে থাকতো। বিএনপির নয়াপল্টন অফিস সবসময় ঘেরাও অবস্থায় থাকতো। ৫ বছর পর ঢাকায় আবার পুলিশের যুদ্ধংদেহী মনোভাবের আলামত পাওয়া যাচ্ছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০১৫ সালে বেগম খালেদা জিয়ার বাড়ি অবরোধ করার পর সেই অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে বেগম জিয়া আন্দোলনের ডাক দেন। এই আন্দোলন দমনের জন্য গ্রেফতার, পুলিশি রিমান্ডসহ নানারকম জুলুম-নির্যাতন নেমে আসে নেতা ও কর্মীদের ওপর। ঐ সময় বিএনপির পাশাপাশি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের ওপর নেমে আসে সাঁড়াশি আক্রমণ। বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের হাজার হাজার নেতাকর্মীর ওপর জুলুমের স্টিমরোলার নেমে আসে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চরম নির্যাতনের পরও সেই আন্দোলন প্রায় ৩ মাস চলে। আওয়ামী লীগ তাদের নেতা ও কর্মীর ওপর জেল-জুলুমের কথা সবসময় উচ্চকণ্ঠে বলে থাকে। কিন্তু আলোচ্য তিন মাসে যে প্রচ- জুলুম-নির্যাতন চলে তার নজির শুধু বাংলাদেশে কেন, উপমহাদেশের সমকালীন ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না। দলীয় সন্ত্রাস ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস সব মিলিয়ে যে শ্বেত সন্ত্রাস চালানো হয়, তার ফলে ৩ মাস শেষে আন্দোলন থেমে যেতে বাধ্য হয়।
২০১৫ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিক থেকে বিরোধী দলের আন্দোলনে যে স্থবিরতা আসে, তার জের এখনো চলছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে যেটুকু কর্মচাঞ্চল্য দেখা যায়, সেটি ছিল সম্পূর্ণ নির্বাচনকেন্দ্রিক। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে যা ঘটে গেছে, সেটি নেহাত ভোট ডাকাতি ছাড়া আর কিছু নয়। এই ভোট ডাকাতির বিরুদ্ধে প্রবল গণআন্দোলন হবে বলে দেশি ও বিদেশি মহল ধারণা করেছিলেন। কারণ গ্রামগঞ্জের মানুষও দেখেছেন যে, দিনের ভোট রাতে হয়ে গেছে। কিন্তু এ ব্যাপারে বিরোধী দলসমূহ; বিশেষ করে বিএনপির সম্পূর্ণ নীরবতার ফলে সমগ্র বিরোধী শিবিরেই চরম বিভ্রান্তি দেখা দেয়। আন্দোলন করা না করার ব্যাপারে একদিকে বিএনপি এবং অন্যদিকে ঐক্যফ্রন্টের সভাপতি ড. কামাল হোসেনের অর্থপূর্ণ নিষ্ক্রিয়তা এক দিকে ঐক্যফ্রন্ট এবং অন্যদিকে ২০ দলীয় জোটের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাস ও টানাপড়েন সৃষ্টি করে। শুধুমাত্র বিরোধী দলের নেতাকর্মীরাই নন, জনগণের মধ্যেও অনেক প্রশ্নের জন্ম হয়। রাস্তার সাধারণ মানুষও প্রশ্ন করতে থাকেন, বিএনপি আন্দোলনের কোনো কর্মসূচি দিচ্ছে না কেন? ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর থেকে এক অর্থে বলা যায়, বিএনপি হাইবারনেশনে গেছে। অবশ্য কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেনÑ কেন, বিএনপি তো এর মধ্যে কয়েকটি মানববন্ধন করেছে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, বিএনপির মতো একটা বিশাল সংগঠনের জন্য মানববন্ধন একটি হাস্যাস্পদ ব্যাপার। এই তো ৩-৪ বছর আগের কথা। যে দল কোনো মাইকিং, লিফলেটিং বা পোস্টারিং ছাড়া খবরের কাগজে যদি ছোট্ট নিউজ দিত যে অমুক দিন নয়াপল্টনে সমাবেশ হবে, তাহলে সেখানে ৫০ হাজার লোকের সমাবেশ হতো। আজ সেই বিএনপি মানববন্ধনের ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে গেল। জনগণের হতাশা এবং হাহাশ্বাস সম্ভবত গৃহবন্দী বেগম জিয়া এবং লন্ডনে পৌঁছায়। এছাড়া ডা. জাফরুল্লাহসহ নাগরিক সমাজের আরও কিছু ব্যক্তি আছেন, যারা সরাসরি বিএনপি করেন না, কিন্তু সরকারের কর্তৃত্ববাদী শাসন অপছন্দ করেন। তারা জনান্তিকে বলাবলি করেন যে, এভাবে যদি বিএনপি হাইবারনেশনে থাকে, তাহলে জনবিচ্ছিন্নতা দলটিকে গ্রাস করবে অথবা বিএনপির যুব ও তরুণ কর্মী-বাহিনীর ফাইটিং স্পিরিট নষ্ট হয়ে যাবে। আরও প্রশ্ন ওঠে, বিএনপির এই নিষ্ক্রিয়তা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে নাজিমউদ্দিন রোডে না থাকলেও গুলশানে ‘ফিরোজা ভবনের’ চার দেয়ালের মধ্যে বেগম জিয়াকে জীবনের অবশিষ্ট কয়টি দিন অতিবাহিত করতে হবে। আর তারেক রহমানের পলিটিক্যাল এ্যাসাইলাম নাগরিকত্বে পরিণত হবে এবং সেখানেই তিনি স্থায়ীভাবে থিতু হবেন।
রাজনৈতিক মহলে এই মর্মে গুঞ্জন রয়েছে যে, ২০২১ সাল আসার জন্য বিএনপি তার কড়ে আঙুলে দিন গুনছে। কিন্তু সেখানেও ৯ মণ ঘিও জুটবে না, রাধাও নাচবে না। হাড় ক্ষয় রোধের অপর নাম নেক্রোসিস। নিষ্ক্রিয়তা বিএনপির শরীরে নেক্রোসিস হয়ে ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ করবে। হাওয়া থেকে পাওয়া খবরে জানা যায় যে, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে যদি নির্বাচন না হয়, তাহলে আগামী নির্বাচনে ২০ দলীয় জোটের অনেক দল এবং ঐক্যফ্রন্টের দুটি দল নির্বাচন বর্জন করবে। তখন এসব মিত্রকে ছাড়া নির্বাচনে গেলে বিএনপিবান্ধব জনগণের প্রচুর সমালোচনার মুখে পড়বে বিএনপি।
এসব বিষয় বিবেচনা করে বিএনপি নাকি সিদ্ধান্তে এসেছে যে, রাজপথে নামা ছাড়া বিএনপি নিজের অস্তিত্ব তো দূরের কথা, গণতন্ত্রের অস্তিত্বও রক্ষা করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তাই দেশের বৃহত্তম কিন্তু নিষ্ক্রিয় দলটি সরকার পতন আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই লক্ষ্যে তারা বিভাগীয় শহরগুলোয় জনসভা করার কর্মসূচি নিয়েছে। বরিশালের এই জনসভা দিয়ে কর্মসূচি শুরু হয়েছে। এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে খুলনায় জনসভা হবে ২৭ ফেব্রুয়ারি, রাজশাহীতে ১ মার্চ, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে ৩ মার্চ এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে ৪ মার্চ। ১৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে জনসভা হওয়ার কথা ছিলো। অনিবার্য কারণে সেটি পেছানো হয়েছে। সব শেষে নাকি চট্টগ্রামে জনসভা হবে।
এসব জনসভা এবং অন্যান্য ছোট-খাটো কর্মসূচি পালন করতে করতে এসে যাবে পবিত্র মাহে রমজান। তাই পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর বৃহত্তর আন্দোলনের পরিকল্পনা সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ও সিপিবি ছাড়া বৃহত্তর ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হবে। তবে ঘরপোড়া গরুর মতো সিঁদুরে মেঘ দেখার ভয়ে এবার আর নেতা আমদানি করা হবে না। ড. কামাল হোসেন সম্পর্কে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ অংশটির মোহ কেটে গেছে। ড. কামাল হোসেনকে আনার পর বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট একের পর এক যেসব ভুল করে গেছে, সেসবের পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, সেদিকে আগামী দিনের ঐক্য অভিসারিরা নজর রাখবেন বলে জানা গেছে।
Check Also
সাতক্ষীরায় পুত্রবধূর হাতে নির্যাতিত সেই স্কুলশিক্ষক মারা গেছেন
ক্রাইমবাতা রিপোট, সাতক্ষীরা: ছেলে ও পুত্রবধূর হাতে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতনের শিকার সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বাঁশতলা …