সরোয়ার আলম, আঙ্কারা, তুরস্ক থেকে তুরস্কের ইতিহাসের সর্বশেষ সফল সামরিক অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি ২৮ ফেব্রুয়ারি। ১৯৯৭ সালের আজকের এই দিনটিতে তখনকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে স্মারকলিপি দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। ট্যাঙ্ক গোলাবারুদ আর সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার না করেই অর্থাৎ প্রত্যক্ষ সামরিক শক্তি ব্যবহার না করেই প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন এরবাকানকে বন্দুকের নলের মাথায় ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা হয়।
উত্তর আধুনিক সামরিক অভ্যুত্থান নামে পরিচিত এই অবৈধ ক্ষমতা দখলে প্রত্যক্ষ সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করছিল তখনকার গণমাধ্যম, এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলো।
পাঁচজন সামরিক কর্মকর্তা এবং পাঁচজন উচ্চ পর্যায়ের রাজনীতিবিদদের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় সুরক্ষা কাউন্সিলের সদস্যরা ২৮ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা দিল যে রাষ্ট্র “ইসলামপন্থী হুমকির” সম্মুখীন। ক্ষমতাসীনরা রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতার উপর বড় হুমকি স্বরূপ। একটি স্মারকলিপি জারি করে সমস্ত ধর্মীয় স্কুল বন্ধ করার, সব বেসরকারি ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তরের এবং বহু ধর্মীয় সংস্থা এবং এনজিওর কার্যক্রম নিষিদ্ধ কারার দাবি জানায় ।
এরা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে নামিয়ে দেওয়ার জন্য সামরিক শক্তি প্রয়োগের হুমকি দেয়, তুরস্কের সাংবিধানিক ভিত্তি ধর্মনিরপেক্ষতাকে রক্ষার জন্য ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে ব্যাপক মিডিয়া প্রচারনা চালায় এবং সেক্যুলারদের সাথে আঁতাত করে। এ ক্যাম্পেইন চলতে থাকে একই বছরের ১৮ জুন এরবাকানের পদত্যাগ করার দিন পর্যন্ত।
যেভাবে নাজিমুদ্দিন এরবাকানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়
কীভাবে এবং কেন এটি ঘটেছে তা বোঝার জন্য আসুন আরেকটু পিছনে ফিরে যাই। ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বর মাসের সংসদ নির্বাচন। সংবিধান অনুযায়ী কট্টর সেক্যুলার এই দেশটির সংসদে জনগণের ভোটে সবচেয়ে বেশি আসন পেয়ে বিজয়ী হয় কল্যাণ পার্টি নামে একটি ইসলামিক রাজনৈতিক দল।
ব্যাপক জনপ্রিয় একটি ইসলামী সংগঠন “মিল্লি গোরুশ” এর রাজনৈতিক শাখা ছিল এ দলটি। ৩৬ বছর ধরে তুরস্কে সোচ্চারভাবে ধর্মীয় রাজনীতি করার কারণে “মিল্লি গোরুশ” আন্দোলনের নেতা এরবাকানকে এবং তার পার্টিকে নিষিদ্ধ করার হয় বারবার । তবুও আধুনিক তুরস্কের ইতিহাসে সেবারই প্রথম ধর্মীয় সংস্থার সাথে যুক্ত কোনও ইসলামিক রাজনৈতিক দল জাতীয় নির্বাচন বিজয়ী।
তবে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়া অন্য দলের সাথে জোট বেঁধে সরকার গঠন করতে হত এরবাকানকে। কিন্তু সেনাবাহিনী অন্য রাজনৈতিক দলগুলিকে এরবাকানের দলের সাথে ঐক্যজোটের সরকার গঠন না করার জন্য চাপ দেয়। এবং সবচেয়ে বড় বিজয়ী দলকে পাশ কাটিয়ে সরকার গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয় অন্যসব দলগুলোকে। তবে দেড় বছর পরে বিরোধী দলগুলো টেকসই সরকার গঠনে ব্যর্থ হওয়ার পরে রাষ্ট্রপতি কল্যাণ দলকে জোট গঠনের অনুমতি দেয়।
ধর্মনিরপেক্ষ সম্প্রদায়, সামরিক ও গণমাধ্যম দেশটির মুসলিম পরিচয়কে আরও শক্তিশালী করতে চায় বলে নতুন প্রধানমন্ত্রী এরবাকানকে সমালোচনা করেছিল।
এরবাকান একটি সামাজিক রক্ষণশীল গোষ্ঠির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, মুসলিম দেশগুলিতে সফর করেছিলেন এবং মুসলিম দেশগুলির মধ্যে জি-7 এর আদলে একটি আন্তর্জাতিক সঙ্ঘ গঠনের চেষ্টা চালিয়েছিলেন।
এরবাকানের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী ও গণমাধ্যমের প্রচার এই দাবি জোড়ালো করে তুলেছিল যে তার দল তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তি ধ্বংস করতে চায়। তখন গণমাধ্যমে একটি জনপ্রিয় স্লোগান ছিল “ধর্মনিরপেক্ষতা বিলীন যাচ্ছে, দেশে শরীয়ত আসছে”।
এমনকি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তখন ধর্মীয় সংস্থাগুলোকে রাষ্ট্রের জন্য পিকেকে সন্ত্রাসী সংগঠনের চেয়ও বড় হুমকি হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
উত্তর-আধুনিক এই সামরিক অভ্যুত্থানের পরে কী ঘটল?
সাংবিধানিক আদালত কল্যাণ পার্টিকে যথেষ্ট সেক্যুলার না হওয়ার অভিযোগে সরকার থেকে নিষিদ্ধ করে। এবং এরবাকান সহ এ পার্টির অন্যান্য নেতৃস্থানীয় বাক্তিদেরকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। পরে সেনা সমর্থিত নতুন সরকার ধর্মীয় মত প্রকাশের বিরুদ্ধে আইনী লড়াই শুরু করে। তারা সরকারি সকল প্রতিষ্ঠান থেকে ধর্মীয় রক্ষণশীল লোকদের বের করে দেয়। একটি ড্রেস কোড আইন কার্যকর করার মাধ্যমে হিজাব পরিধানকারী ছাত্রীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এই নিষেধাজ্ঞাটি অন্যান্য সরকারী প্রতিষ্ঠানে আগে থেকেই কার্যকর ছিল। এবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও এর আওতায় আনা হয়।
হাজার হাজার শিক্ষার্থীর ছাত্রত্ব বাতিল করা হয়। সাড়ে তিন হাজার মহিলা শিক্ষককে তাদের চুল ঢেকে রাখার জন্য বরখাস্ত করা হয়েছে, এগারো হাজার শিক্ষককে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় এবং পদত্যাগে অস্বীকৃতি জানালে আর তিনহাজার পাঁচশ সাতাশ জোন শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা হয়।
এছাড়াও সশস্ত্রবাহিনীর ধর্মীয় ভাবাপন্ন কর্মকর্তাদের ব্যাপকহারে ছাটাই করা হয়। ওই সময় ১ হাজার ৬২৫ জন বাহিনীর সদস্যকে বরখাস্ত করা হয়ে এবং আরও ২ হাজার ৫০০ জন অবসর নিতে বাধ্য করা হয়। সামরিক বাহিনীতে কর্মরত সব সদস্যদের স্ত্রীদেরকে হিজাব খুলতে বাধ্য করা হয়।
প্রায় এক হাজার মানুষকে ভুয়া অভিযোগে জেলে পুরে রাখা হয়েছিল। প্রায় ১ কোটিরও বেশি লোক এবং অনেক সিভিল সোসাইটিকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। মোট কথা, ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসীদের উপরে একটা স্টিম রোলার চালিয়ে দেওয়া হয়।
তখনকার একজন সেনা কমান্ডার তো বলেই দিলেন, ‘২৮ শে ফেব্রুয়ারি (পরবর্তী এই স্টিম রোলার) এক হাজার বছর ধরে চলবে’।
তবে পাঁচ বছর যেতে না যেতেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় আসে রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগানের নেতৃত্বে এরবাকানেরই দল থেকে বেরিয়ে আসা একদল লোক। আর তখন থেকেই শুরু বর্তমান ক্ষমতাসীন একে পার্টির অধ্যায়। ক্ষমতায় আসার পরই ধর্মীয় মতপ্রকাশের বিরোধিতা করে করা আইনগুলো শিথিল করতে কাজ শুরু করে এরদগানের একে পার্টি এবং ২০১৩ সালে এসে হিজাবের ওপরে নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি উঠিয়ে নিতে সক্ষম হয়। কিন্তু ১৯৯৭ সালের উত্তর-আধুনিক সামরিক অভ্যুত্থানের বিভীষিকাময় দিনগুলো তুর্কিদের মন থেকে কখনই উঠে যাবে না।
লেখক: সরোয়ার আলম
চিফ রিপোর্টার, আনাদলু নিউজ, তুরস্ক