ড. বদিউল আলম মজুমদার : ‘জাতীয় ভোটার দিবস’ উপলক্ষ্যে ২ মার্চ ২০২১ আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠান সম্পর্কে পরদিনের কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত শিরোনামগুলো ছিল : ‘মাহবুব তালুকদারকে একহাত নিলেন সিইসি’ (যুগান্তর), ‘কমিশনারের বক্তব্য পছন্দ না হওয়ায় সিইসির ক্ষোভ’ (প্রথম আলো), ‘ইসিকে অপদস্থ করতে সবকিছু করছেন মাহবুব : সিইসি’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন), ‘সিস্টেমের সমালোচনায় মাহবুব, পালটা ক্ষোভ ঝাড়লেন সিইসি’ (দৈনিক ইত্তেফাক), ‘মঞ্চেই ক্ষোভে ফেটে পড়লেন সিইসি’ (সমকাল), ‘মুখোমুখি’ (মানবজমিন), ‘সিইসি নূরুল হুদা বললেন : ইসিকে অপদস্থ করেছেন মাহবুব তালুকদার; মাহবুব তালুকদার বললেন : এখন অনিয়মের মডেল স্থানীয় নির্বাচন’ (কালের কণ্ঠ), এবং ‘Mahbub out to disgrace EC’ (The Daily Star). প্রতিটি সংবাদপত্রই-কালের কণ্ঠ ছাড়া- অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি প্রথম পৃষ্ঠায় ছেপেছে। কালের কণ্ঠ এটি শেষ পৃষ্ঠায় ছেপেছে।
উপরোক্ত সংবাদ শিরোনাম থেকে এটি সুস্পষ্ট যে, জাতীয় ভোটার দিবস পালন একটি রুটিন সাধারণ বিষয় হলেও এবারকার অনুষ্ঠানে একটি অসাধারণ বিষয় ঘটেছে। এতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার তার অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন, যার প্রতিক্রিয়ায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদা তার ওপর চড়াও হয়েছেন।
তিনি মাহবুব তালুকদারের বিরুদ্ধে স্বার্থপ্রণোদিত হয়ে নির্বাচন কমিশনের মর্যাদাহানির অভিযোগ তুলেছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পক্ষ থেকে একজন নির্বাচন কমিশনারকে এভাবে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ ছিল একটি অভূতপূর্ব ঘটনা।
তবে নূরুল হুদার নেতৃত্বে গঠিত আমাদের বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে কেন্দ্র করে গত চার বছরে অনেক ঘটনাই ঘটেছে, যেগুলো ছিল অভূতপূর্ব। এ নির্বাচন কমিশনের অধীনেই প্রথমবারের মতো মধ্যরাতে ভোট অনুষ্ঠিত হয়, যার মাধ্যমে অসংখ্য সরকারি কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য জেল-জরিমানার মতো শাস্তিযোগ্য বিভিন্ন নির্বাচনী অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন।
এ কমিশনের আমলেই জনগণের অর্থ অভিনব কায়দায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার, অন্যান্য কমিশনার ও কমিশনের কর্মকর্তারা ভাগবাঁটোয়ারা করে পকেটস্থ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ নির্বাচন কমিশন সব বিরোধী দলের মতামত উপেক্ষা করে ২০১৮ সালে তড়িঘড়ি করে ৩ হাজার ৮২৯ কেটি টাকা ব্যয়ে ‘ভোটার ভেরিফাইয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল’ (ভিভিপিএটি)বিহীন ইভিএম ক্রয় করে, প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরীর মতো কমিশনের নিয়োজিত বিশেষজ্ঞ যার বিরোধিতা করেন।
প্রসঙ্গত, ভিভিপিএটি না থাকলে ইভিএম ব্যবহার করে ডিজিটাল জালিয়াতি করা যায়, যে অভিযোগ সম্প্রতি অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে উত্থাপিত হয়েছে। আর এ কমিশনের বিরুদ্ধেই ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক নির্বাচনে ভয়াবহ জালিয়াতি ও দুর্নীতির মতো গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ তুলে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের অধীনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তদন্ত করার জন্য মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেন। অর্থাৎ বহু অভিনব ঘটনা এ কমিশনের মেয়াদকালে ঘটেছে।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের এসব অভূতপূর্ব কার্যক্রমের অনেকগুলো নিয়ে কমিশনার মাহব্বু তালুকদার সোচ্চার ছিলেন। বিশেষত নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপির বিরুদ্ধে তিনি বিভিন্ন সময় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আমরাও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে একই রকম কথা বলে আসছি।
আমরা যতটুকু জানি, তিনি এসব বিষয়ে কমিশন সভায় কোনো কোনো সময় আলোচনা করেছেন কিংবা আলোচনা করার চেষ্টা করেছেন, যা তাকে অনেক সময় করতে দেওয়া হয়নি বলে আমরা শুনেছি। এসব বিষয়ে তিনি কমিশন সভায় কয়েকবার ‘নোট আব ডিসেন্ট’ও দিয়েছেন।
কমিশনের সভায় তার মতামত প্রদান করতে না পেরে তিনি অনেক সময় গণমাধ্যমের সামনে কথা বলেছেন।
নির্বাচন কমিশনের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে মতপার্থক্য হওয়াই স্বাভাবিক। মতান্তর থাকা দোষের কিছু নয়। তবে এগুলো কমিশন সভায় আলাপ-আলোচনা করে সমাধান করাই সঙ্গত ছিল। আমাদের জানা মতে যেসব বিষয়ে মতপার্থক্য হয়েছে যেমন-কারচুপির নির্বাচন ঠেকানোর ব্যাপারে কমিশনের ক্ষমতা প্রয়োগে অনীহা-সেগুলো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এ বিষয়গুলো প্রকাশের মাধ্যমে কমিশনের স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কারণ নির্বাচন কমিশনের মতো সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা ও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই।
বস্তুত কমিশনের জবাবদিহিতা এ দেশের জনগণের কাছে এবং দায়িত্ব জনগণের পক্ষে ও স্বার্থে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান। তাই কমিশনার মাহবুব তালুকদার কর্তৃক নির্বাচনে অনিয়ম নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশের মাধ্যমে জনস্বার্থই সমুন্নত হয়েছে।
কমিশনার মাহবুব তালুকদার নির্বাচনে কারচুপি ও অন্যান্য অনিয়ম নিয়ে নানা সময়ে প্রকাশ্যভাবে কথা বললেও তিনি সিইসি নূরুল হুদাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেছেন বলে আমরা শুনিনি।
সিভিল প্রশাসনে এক সময় সিইসি নূরুল হুদা তার অধীনে কাজ করলেও তিনি কোনো সময়ই সিইসির প্রতি ব্যক্তিগতভাবে অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেননি। বরং ২৬ নভেম্বর ২০১৭ একটি জাতীয় দৈনিকে লেখা ‘সিইসি, ইসি ও প্রসঙ্গ কথা’ শিরোনামের একটি উপ-সম্পাদকীয়তে তিনি বলেছেন : ‘নূরুল হুদা একজন সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধা।
ভারতে গেরিলা যুদ্ধের বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং অসম সাহসের পরিচয় দেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি তাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করি … সে জন্য কেএম নূরুল হুদাকে নির্বাচন কমিশনে সহকর্মী হিসেবে পেয়ে আমি গৌরব বোধ করি।’
তবে সিইসি কমিশনার মাহবুব তালুকদারকে এবারই প্রথম প্রকাশ্যে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেননি, এর আগেও অন্তত একবার তিনি তা করেছেন, যদিও সে আক্রমণ ছিল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ও অনেক কম তির্যক।
বর্তমান কমিশনের দায়িত্ব গ্রহণের পর সচিবের যোগসাজশে সিইসির অন্য কমিশনারদের পাশ কাটিয়ে এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিরুদ্ধে কমিশনের অন্য সদস্যরা অসন্তুষ্ট হন এবং কমিশনার মাহবুব তালুকদার এ ব্যাপারে প্রতিবাদ করেন, যা নিয়ে সিইসি নূরুল হুদা এক সংবাদ সম্মেলনে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন (প্রথম আলো, ১৬ জুলাই ২০১৭)।
তিনি বলেন, ‘এটা তো তালুকদার সাহেব জানেন। এটা তালুকদার সাহেবের প্রোডাক্ট।’ বিষয়টি এখানেই শেষ হয়। প্রসঙ্গত, অন্য নির্বাচন কমিশনারদের বাদ দিয়ে সিইসির এককভাবে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ যে অসাংবিধানিক সে বিষয়ে আমি নিজে প্রথম আলোতে একটি উপসম্পাদকীয় লিখেছি (২০ জুলাই ২০১৭)।
তাই এটি সুস্পষ্ট যে, জাতীয় ভোটার দিবসের অনুষ্ঠানে সিইসি নূরুল হুদা কর্তৃক কমিশনার মাহবুব তালুকদারকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ ছিল একটি অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। নির্বাচন কমিশনের মতো একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে সিইসির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগপ্রাপ্ত একজন ব্যক্তির পক্ষে এমন আচরণ সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত।
এ অবস্থা চলতে থাকলে আমরা এক ভয়াবহ বিপদের দিকে ধাবিত হতে পারি বলে আমাদের আশঙ্কা। তাই আমরা এ কমিশনের কাছ থেকে মুক্তি চাই। আমরা মনে করি, যত শিগ্গির এ কমিশন তাদের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াবে, ততই জাতির জন্য তা মঙ্গলকর হবে এবং তাদের জন্যও হবে সম্মানের।
ড. বদিউল আলম মজুমদার : সম্পাদক, সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক