এক দশক ধরেই দেশের যোগাযোগ অবকাঠামোয় বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এজন্য একের পর এক নেওয়া হচ্ছে বড় বড় প্রকল্প; কিন্তু অনেক সময় এসব কর্মযজ্ঞের ভিড়ে খোদ উন্নয়নই পথ হারাচ্ছে। কারণ এক প্রকল্পের সঙ্গে আরেক প্রকল্পের সমন্বয়হীনতায় অ্যালাইনমেন্ট নির্ধারণ করা যাচ্ছে না। এরকম সাংঘর্ষিক অবস্থা প্রায়ই ঘটছে। ক্ষেত্রবিশেষে রুট পরিবর্তনের উদাহরণও আছে। মগবাজার ফ্লাইওভার এবং শান্তিনগর ফ্লাইওভারে রুট পরিবর্তন সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত। আবার ঢাকার চারপাশে নৌযান চলাচলের স্বার্থে অন্তত ১৩টি সেতু ভাঙতে হবে। অথচ এই পরিস্থিতির মধ্যেই আরও দুটি নতুন সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। মেট্রোরেলের রুট ও স্টেশনের স্থান নির্বাচন, আশুলিয়া উড়ালসড়ক ও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের রুট নিয়ে দেখা দিয়েছে জটিলতা। অবস্থা এতটাই বেগতিক যে, প্রকল্পের ভিড়ে দেশের প্রধান বিমানবন্দরের জন্য আন্ডারপাস নির্মাণের জায়গা নেই। কমলাপুর স্টেশন ও বিমানবন্দর রেলস্টেশন এলাকায় প্রকল্পে প্রকল্পে সংঘর্ষ তৈরি হয়েছে। স্টেশন দুটিকে ‘মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট হাব’-এ রূপান্তরের পরিকল্পনা রয়েছে। কমলাপুর রেলস্টেশন এলাকায় নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে মাল্টিমোডাল হাবের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। একসময় সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল পর্যন্ত মেট্রোরেল করার পরিকল্পনা ছিল কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (এসটিপি)। নিচতলায় বাস টার্মিনাল ও ওপরের তলায় মেট্রোরেল করার চিন্তা ছিল। ঢাকার বাইরে থেকে আসা যাত্রীরা মেট্রোতে করে অনায়াসে শহরের অন্যপ্রান্তে যেতে পারতেন; কিন্তু গুলিস্তানে ফ্লাইওভার করে মেট্রোরেল নির্মাণের সম্ভাবনা শেষ করে দেওয়া হয়েছে। মগবাজারে ফ্লাইওভার করে গাজীপুর থেকে কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল পর্যন্ত বিআরটি নেওয়ার রাস্তা সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। একইভাবে প্রকল্পের সংঘর্ষে শান্তিনগর ফ্লাইওভার নিয়ে চলে নানা কাণ্ড। এ বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল হক আমাদের সময়কে বলেন, উন্নয়ন দরকার তবে সড়ক, রেল ও নৌপথের উন্নয়ন করতে হবে সমন্বিতভাবে। জট লাগানো উন্নয়ন নয়; কিন্তু প্রকল্পে প্রকল্পে ওভারল্যাপিং বা সাংঘর্ষিক অবস্থা হচ্ছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় যখন অনুমোদন দেয়, তখন সমন্বিত উন্নয়নের বিষয়টি খেয়াল করে না। রেলওয়ে থার্ড লাইন-ফোর্থ লাইন করবে; কিন্তু এতে লেভেল ক্রসিংয়ে গাড়িজট লেগে যাবে। রেলপথ সম্প্রসারণ করতে গিয়ে সড়ক সংকুচিত করা আধুনিক ও সমন্বিত উন্নয়ন নয়। এখানে কো-অর্ডিনেশনের অভাব। কারণ, সত্যিকারের অভিভাবক অরগানাইজেশন নেই। ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) আছে; কিন্তু তাদের সক্ষমতা নেই। ঢাকার চারপাশে ১৩টি সেতু ভাঙতে হবে। নির্মাণের আগে উচ্চতা নির্ধারণের বিষয় নিয়ে সমন্বয় হয়নি। প্রকল্পে স্বতন্ত্র কনসালটেন্ট নিয়োগ করে স্বতন্ত্র ভাবনা চলে; কিন্তু ঢাকার বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় বসবাসযোগ্য নগরীটা এখনো তলানিতে আছে। এখানে বিনিয়োগ হচ্ছে; কিন্তু এই বিনিয়োগের সুফল সবাই পাবে না। যারা কাজটি করছে তারা হয়ত আর্থিকভাবে লাভবান হবে; কিন্তু সত্যিকার অর্থে নগরবাসীর লাভ হচ্ছে কি? স্থানীয় সরকার বিভাগের তথ্যমতে, ঢাকার চারপাশে নদ-নদী, খালের ওপর ১৩টি সেতু চিহ্নিত করা হয়েছে, যেগুলো স্বল্প উচ্চতার। তাই নৌযান চলাচল ব্যবস্থা অক্ষুণœ রাখতে এসব সেতু ভেঙে ফেলে নতুন করে নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে; কিন্তু বৃত্তাকার নৌপথ এলাকার মধ্যেই এখন কম উচ্চতার আরও দুটি সেতু নির্মাণ করছে সরকারেরই দুই সংস্থা। একটি টঙ্গীতে তুরাগ নদের ওপর কামারপাড়া সেতু। এটি নির্মাণ করছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। দ্বিতীয়টি রেলসেতু। টঙ্গীতেই তুরাগের ওপর এই সেতু নির্মাণ করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। সেতু দুটি নির্মাণে প্রায় ১১০ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। যে উচ্চতায় সেতু দুটি হচ্ছে, তাতে এর নিচ দিয়ে বর্ষায় নৌযান চলাচল করতে পারবে না। ফলে বৃত্তাকার নৌপথ চালু করতে হলে দুটি সেতুই ভাঙতে হবে। অন্যদিকে বিআইডব্লিউটিএ বলছে ১৩টি নয়, ১৬টি সেতু ভাঙতে হবে নৌপথ সচল করতে চাইলে। তাদের হিসাবে বৃত্তাকার নৌপথ চালু করতে আমিনবাজার বেইলি সেতু, আশুলিয়া সেতু, প্রত্যাশা সেতু, কামারপাড়া সেতু-১, কামারপাড়া সেতু-২, টঙ্গী সড়ক সেতু-২, টঙ্গী সড়ক সেতু-৩, টঙ্গী রেল সেতু-১, টঙ্গী রেল সেতু-৩, তেরমুখ সেতু, পূর্বাচল সেতু, ইছাপুরা সেতু, চনপাড়া সেতু, কাউন্দিয়া সিন্নিরটেক সেতু, রুস্তমপুর সেতু এবং উত্তরা ১৬ নম্বর সেক্টরসংলগ্ন দেওয়ান বেড়িবাঁধ সেতু ভেঙে ফেলতে হবে। এদিকে বিমানবন্দর মোড় থেকে গাজীপুরের জয়দেবপুর পর্যন্ত বাসের জন্য বিশেষায়িত লেন বিআরটির নির্মাণকাজ চলছে। আবার বিমানবন্দর মোড় থেকে চিটাগং রোডের কুতুবখালী পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণেরও কাজ চলছে। এখান থেকেই শুরু হবে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। বিমানবন্দর স্টেশন থেকে কমলাপুর পর্যন্ত পাতাল মেট্রোরেল (এমআরটি-১) নির্মাণ করা হবে। ফলে সাংঘর্ষিক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বিমানবন্দর মোড়ে। সেখানে বিআরটির সব পিলার উঠে গেছে। এ প্রকল্পের আওতায় বিমানবন্দর থেকে বিমানবন্দর রেলস্টেশন পর্যন্ত পথচারী আন্ডারপাস নির্মাণের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু তা নির্মাণে সেখানে আর জায়গা নেই। সমস্যা সমাধানে রেলের জমি চেয়ে চিঠি দিয়েও সাড়া পায়নি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। অথচ আন্ডারপাস নির্মাণে অর্থ সংস্থান আছে। ফলে বিষয়টি ঝুলে আছে। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক এএইচএমএস আকতার বলেন, কমলাপুর স্টেশন এলাকা দিয়ে উড়ালসড়কের অ্যালাইনমেন্টের সমস্যার সমাধান হয়নি। মাল্টিমোডাল হাবের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থা কাটানোর চেষ্টা চলছে। ঢাকা-টঙ্গী রেলপথে তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন রেলপথ নির্মাণ চলছে। এই দুই লাইন নির্মাণের পর বিমানবন্দরে জায়গা সামান্যই থাকবে। তাই জমি ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া কঠিন; কিন্তু এর মধ্যেই আন্ডারপাস নির্মাণে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। সংশি−ষ্টরা জানান, কমলাপুর স্টেশনের সামনে গিয়ে শেষ হবে চলমান মেট্রোরেলের (এমআরটি-৬) লাইন। আরও তিনটি মেট্রোরেল এমআরটি-১, এমআরটি-২ এবং এমআরটি-৪ নির্মাণ করা হবে কমলাপুরের আশপাশে। রাজারবাগ দিয়ে যাবে এমআরটি-১, মতিঝিল দিয়ে যাচ্ছে এমআরটি-৬। বর্তমান অ্যালাইনমেন্ট অনুযায়ী স্টেশনের আগে খিলগাঁও ফ্লাইওভারের কাছ থেকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে অতিক্রম করবে কমলাপুরকে। প্রতি প্রকল্পের আলাদা আলাদা সমীক্ষা হয়েছে; কিন্তু একই এলাকায় অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে কী ফল হবে, তার সমন্বিত সমীক্ষা হয়নি। তাই বাস্তবায়নের সময় বিপত্তি দেখা দিয়েছে। এমআরটি লাইন-১, ২, ৪-এর রেলপথ ও স্টেশন কমলাপুরকে ঘিরে। এর সঙ্গে যুক্ত হবে সেতু বিভাগের প্রকল্প সাবওয়ে। আর ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কমলাপুর স্টেশন অংশের অ্যালাইনমেন্ট নতুন করে নির্ধারণ করে কমলাপুর মাল্টিমোডাল হাবের পরিকল্পনার নির্দেশ রয়েছে পিপিপি কর্তৃপক্ষের; কিন্তু আজও নির্ধারণ করা যায়নি।
Check Also
বিএনপি নেতাকর্মীদের জড়িয়ে হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে দেবহাটায় মানববন্ধন
দেবহাটা প্রতিনিধি: স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দোসর এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও ভূমিদস্যুদের গ্রেফতার এবং বিএনপির …