আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা: ফারাক্কা বাঁধ, অপরিকল্পিত ব্রিজ স্লুইসগেট-বাঁধ নির্মাণসহ চর দখল করে নদী শোষনের ফলে উপকূলীয়া জেলা সাতক্ষীরার ছোট-বড় ২৭টি নদী এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। এসব নদীতে জোয়ার ভাটা বন্ধ হয়ে গেছে। ৫৭ বছরে শুকিয়ে গেছে দেশের ১৫৮ নদী। উত্তর অঞ্চলের পাশাপাশি দেশের দক্ষিণাঞ্চলেও বড় বড় নদী শুকিয়ে যাওয়ার কারণে পানি সংকট দেখা দিয়েছে। চলতি বোরো মৌসুমে পানির অভাবে কৃষি জমির সেচ কাজ চরম ভাবে ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি দেশী মৎস্য সম্পদ ও জীব-বৈচিত্র পড়েছে হুমকির মুখে। নদীকে জীবিকা করে খাওয়া মানুষগুলো বেকার হয়ে পড়েছে। প্রভাব পড়েছে ব্যবসা বাণিজ্যেও। স্থবির হয়ে গেছে হাটবাজারগুলো। এরই মধ্যে সাতক্ষীরায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফর ঘিরে পানি বন্টনের বিষয়টি আবারো আলোচনায় উঠে এসেছে।
নদ নদী খনন ও রক্ষায় বছরজুড়েই নানা উদ্যোগের কথা শোনা গেলেও ক্ষমতার আশীর্বাদে দখল ও দূষণ শেষ পর্যন্ত প্রায় অপ্রতিরোধ্যই থেকে যায়। ফলে নদী রক্ষার কাজটি প্রতিশ্রুতিতেই থেকে যায়। এতে ধীরে ধীরে নদী শুকিয়ে যায়।
নদীর বুকে বসত ঘর, বেড়িবাঁধ দিয়ে মৎস্যচাষ সহ নানা কারণে সাতক্ষীরা ছাড়াও ভৌগোলিক অবস্থানগত ভাবে সংলগ্ন খুলনা ও যশোর এলাকার কয়েক নদী এরই মধ্যে মারা গেছে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে প্রথম এক দশক পর্যন্ত নদীগুলো প্রবহমান থাকলেও আশির দশক থেকে এর মরণদশা শুরু হয়। ফলে পানি নিষ্কাশনের অভাবে বর্ষা মৌসুমে সৃষ্ট হচ্ছে । দুটি গবেষণার রির্পোটে বলছে দেশে গত ৫৭ বছরে ১৫৮টি নদী শুকিয়ে গেছে।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন উত্তরণের সমীক্ষা অনুযায়ী, গত ২০ বছরে (২০০০ থেকে ২০২০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত) দেশে ৪৩টি নদী শুকিয়ে গেছে। উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ও নদীতে নানা অবকাঠামো নির্মাণ ও দখলের কারণে নদীর মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না।
উত্তরণের পরিচালক শহিদুল ইসলাম বলেন, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বেতনা, শালিখা, শালিতা, হামকুড়া, চুনা ও হাতিটানার মতো তীব্র স্রোতের নদী এখন শুকিয়ে বসতি এলাকায় পরিণত হয়েছে। মূলত অপরিকল্পিতভাবে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ নির্মাণের কারণে নদী শুকিয়ে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ক্রমাগত নদ-নদী ও জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ায়, তা বাংলাদেশের কৃষি, অর্থনীতি ও পরিবেশের ওপর সরাসরি বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে৷ এর ফলে খাদ্য ঘাটতিও বেড়ে যাবে বহুল পরিমাণে এবং হুমকির মধ্যে পড়বে বিশ্বের জীববৈচিত্র্য৷
পলি জমা, উজানের সময় নদী তীরে জলের প্রত্যাহার, নির্বিচার দখল ইত্যাদির কারণে, আজ দেশের অসংখ্য নদীর অস্তিত্বই আশংকাজনক ৷
এছাড়া সুন্দরবন ও সাগর বিধৌত সুজলা-শ্যামলা সাতক্ষীরা জেলায় ২৭টি নদ-নদীর তীরে গড়ে উঠা শহর বন্দর ও জনপদে স্বেচ্ছাচারীভাবে নদীর তীরে এমনকি চর দখল করে নদীর মধ্যেও গড়ে তোলা হয়েছে বসতবাড়ি, দোকানপাট, ইটভাটা, কৃষিখামার। পানি প্রবাহ হারিয়ে মুমূর্ষ দশায় নদীগুলোর এ দখলদারিত্ব নদীর অস্তিত্বকে আরেক দফা হারিয়ে দিয়েছে। ফলে জেলার ২/১ নদী বাদে অধিকাংশ নদীতে বন্ধ হয়ে গেছে জোয়ার-ভাটা। কপোতাক্ষ, বেতনা, কাকশিয়ালী, খোলপেটুয়া, কালিন্দি, মরিচ্চাপ, যমুনা, সোনাই, বলুয়া, গলঘেষিয়া, গুতিয়াখালি, সাপমারা নদীসহ ছোট-বড় ২৭ নদ-নদীর অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। এসব নদীতে এক সময় বড় বড় লঞ্চ, ষ্টিমার, গহনার নৌকা চলতো। সে সময় নদীগুলোতে প্রবল জোয়ার ও ¯্রােত থাকলেও এখন তা মরা খালের মতো নিশ্চল হয়ে আছে।
সূত্র মতে, সাতক্ষীরার নদ-নদীগুলোর মৃত্যুর প্রধান কারণ প্রশাসন ও প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় দখল দারিত্ব ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত স্লুইসগেট। এছাড়াও উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্প, অপরিকল্পিত স্লুইসগেট ছাড়াও এ অঞ্চলের নদীর ওপর ৪৮টি সেতু- নদী মৃত্যুর অন্যতম কারণ।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুটি বিভাগে ২১৬টি স্লুইস গেট রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এর মধ্যে ২৮টি সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে গেছে। এ ছাড়া ৫০টির তলদেশ পলি জমে উঁচু হয়ে যাওয়ায় ও অবৈধ দখল দারিত্বের কারণে পানি নিষ্কাশন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।
কাকশিয়ালী নদীরও নাব্যতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। বেতনা নদী তার নাব্য হারিয়ে পুরোপুরি একটি মৃত খালের রূপ নিয়েছে। অনেক আগেই মৃত্যু হয়েছে মরিচ্চাপের।এরই মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ২৬১ কোটি ৫৪ লাখ ৮৩ হাজার টাকা ব্যয়ে কপোতাক্ষ খনন করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে আর আগের মতো জোয়ার-ভাটা হয় না। কোনোভাবে নদীটি মরা খালের মতো বেঁচে আছে। বেতনা নদীসহ মরিচ্চাপ ও যমুনা খনন করা হলেও দখল দারিত্বের কারণে তা র্পূর্বের অবস্থায় ফেরেনি।
বেতনা নদী বা বেতনা-কোদালিয়া নদী বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। এই নদী ঝিনাইদহ, যশোর ও সাতক্ষীরা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। নদীটির দৈর্ঘ্য ১৯১ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৫৫ মিটার হলেও এখন নদীটি শুধুই স্মৃতি হতে চলেছে। নদীটিতে এখন পানি প্রবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ।
সাতক্ষীরা পাউবোর নির্বাহী প্রকৗশলী আবুল খায়ের বলেন, প্রাণসায়ের খাল খনন ২০২০ সালের ৩০ জুনের মধ্যে শেষ করার কথা থাকলেও নানা জটিলতায় তা হয়নি। এ জন্য চলতি ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে। খালপাড়ের মানুষ মামলা করায় ও এক্সকাভেটর মেশিন চলাচলের জন্য জায়গা বের করতে দেরি হওয়ায় কাজ করতে দেরি হচ্ছে। বিশেষ করে শহর অংশে নকশা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না স্বীকার করে নিয়ে বলেন, পরে আবার খাল আরও খনন করতে হবে। না হলে বিল দেওয়া হবে না। এছাড়া নদ নদী খনন ও ড্রেজিং এর জন্য সরকারের কাছে বরাদ্ধ চাওয়া হয়েছে। বরাদধ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।