এই বাংলার আকাশ বাতাস সাগর গিরি ও নদী, ডাকিছে তোমারে বঙ্গবন্ধু ফিরিয়া আসিতে যদি’। এভাবে আজ কোটি বাঙালির হৃদয় খুঁজে ফিরবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। আজ ইতিহাসের বরপুত্রের শততম জন্মবার্ষিকী। বিপুল আনন্দ মহা উৎসবের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ বাঙালির দুয়ারে। আজ ১৭ মার্চ বুধবার সংগ্রামে সিদ্ধপুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মের প্রথম শুভক্ষণ। দু’হাজার বছরের একাগ্র সাধনার ফলে বাঙালি লাভ করেছিল মুজিব নামের অমূল্য কণ্ঠহার। বাঙালিত্বের মহান সাধক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, রাজনীতির কবি, লোকনায়ক, গ্রীক পুরানের বীর, বাংলার প্রমিথিউস-অভিবাদন আপনাকে। শুভ জন্মদিন, প্রিয় পিতা!
পর্ণমোচী বৃক্ষের ঝরাপাতা, ধানমন্ডি লেকের শান্ত জলরাশি, ছায়া সুশীতল টুঙ্গিপাড়ার গ্রাম, জল হাওয়া আজ জয় ঘোষণা করছে তোমার। চেতনার অনুর্বর ভূমিতে জন্ম নেয়া ফলবান বৃক্ষ তুমি। মহাকালের সোনার তরী তোমার দেয়া ফলে ফসলে ভরা। গোটা জাতি মুখরিত ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ সেøাগানে।
বসন্তে রমনায় ফোটা সব রঙিন সুগন্ধি ফুল আজ তোমার অর্ঘ্য। গাঁয়ের ঝিলে ফোটা শাপলা যেন তোমার মুখের হাসি। দোয়েলের উড়ে বেড়ানোতে তুমি। তুমি বাউলের একতারায়। মিছিলে, প্রতিবাদী সেøাগানে, সংগ্রামে তুমি। ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে উঠে রণি…বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।’ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ আজ আবারও মিলেমিশে একাকার।
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের আজকের দিনে ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দিনটি মহা পুণ্যের, পূর্ণতার। বেঁচে থাকলে আজ ১০০ বছর পূর্ণ করতেন পিতা। দৃশ্যপটে তিনি নেই। বাঙালির অস্তিত্বের সবটুকুজুড়ে আছেন। এই ইতিহাস ভুলে যাব আজ, আমি কি তেমন সন্তান?/যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান…। নিজের জন্মদিন নিয়ে তিনি বলেছিলেন, আমার আবার জন্মদিন কি? আমার জীবন নিবেদিত আমার জনগণের জন্যে। আমি যে তাদেরই লোক। আর মুজিবের হয়ে কবি বলছেন, কে আছেন?/দয়া করে আকাশকে একটু বলেন,-/সে সামান্য উপরে উঠুক,/আমি দাঁড়াতে পারছি না।’
৫৬ হাজার বর্গমাইলের শ্যামল প্রান্তরে মুজিবের দীর্ঘ ছায়া। পবিত্র পদচিহ্ন। আজ তাই হাসিমুখে জন্মোৎসবে যোগ দেয়ার দিন। গত বছর এই দিনে শুরু হয়েছিল মুজিবর্ষ উদযাপন। বছরব্যাপী আয়োজনে ক্ষণজন্মা নেতা দাতা ত্রাতার প্রতি শ্রদ্ধা ভালবাসা জানায় কৃতজ্ঞ জাতি। আজ থেকে শুরু হচ্ছে শেষ দশদিনের সরকারি অনুষ্ঠানমালা। দেশী বিদেশী বিশিষ্ট অতিথি ও রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের উপস্থিতিতে উদযাপন করা হবে এবারের জন্মোৎসব।
আশার কথা যে, এমন এক সময়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপিত হচ্ছে যখন তাঁরই উদার অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দর্শনে চমৎকার ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশ। ইতিহাস বিকৃতকারীরা আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপিত হয়েছে। প্রায় নিশ্চিহ্ন স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কাজে নতুন গতি এসেছে। তার মাঝে ছিল বিরল সম্মোহনী ক্ষমতা। অদ্ভুত এক আকর্ষণ ছিল। সব মিলিয়ে বাঙালির প্রাণের স্পন্দন হয়ে ওঠেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জর্জ ওয়াশিংটনের, ভারতের সঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর, চীনের সঙ্গে মাও সেতুংয়ের, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে লেনিনের নাম যেভাবে জড়িয়ে আছে, বাংলাদেশের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামও সেভাবে অবিচ্ছেদ্য সত্তা হয়ে মিলে মিশে আছে।
এ দেশের রাজনীতিকে মধ্যযুগীয় ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক আবর্ত থেকে উদ্ধার করে উদারনৈতিক ধর্মনিরপেক্ষ ধারায় প্রবাহিত করার ক্ষেত্রে একক ও অবিস্মরণীয় ভূমিকা ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের। ১৯৫৫ সালে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেন তিনি। তার সচেতন প্রচেষ্টায় ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দর্শনের উন্মেষ ঘটে। আজকের বাংলাদেশ রাষ্ট্র সেই মহাদর্শন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ধারণ করে আছে।
একেবারে শৈশব থেকেই নেতৃত্বের গুণাবলী নিয়ে বিকশিত হতে থাকেন তিনি। অবিভক্ত ভারতবর্ষে ছাত্র রাজনীতি দিয়ে শুরু। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনে বড় ভূমিকা রাখেন তিনি। পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালে নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে হন সাধারণ সম্পাদক। ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ অলংকৃত করেন। শত নির্যাতন সহ্য করেও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থ রক্ষার আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। পশ্চিম পাকিস্তানীদের শাসন শোষণের বিরুদ্ধে গণজোয়ার সৃষ্টি করে পেশ করেন ঐতিহাসিক ছয় দফা। ১৯৬৬ সালে তার উত্থাপিত ছয় দফা দাবি ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। এর পর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানসহ নানা ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে বাঙালির একক ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হয়ে ওঠেন তিনি। মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সমস্ত জনগণের রাজনৈতিক প¬্যাটফর্মে পরিণত হয়।
কিন্তু ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পরও সরকার গঠন করতে দেয়া হয় না আওয়ামী লীগকে। এ অবস্থায় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে চূড়ান্ত ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু। জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বজ্রকণ্ঠে উচ্চারণ করেন: এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এর প্রতিক্রিয়ায় আসে ২৫ মার্চের কালরাত। পাকিস্তান বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন শেখ মুজিব। তাঁর আহ্বানে প্রশিক্ষিত পাকিস্তান আর্মির বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নয় মাস লড়াই করে বাঙালি। পাকিস্তান কারাগারে বন্দী মুজিবের নামেই চলে বাঙালির সশস্ত্র সংগ্রাম। ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বমানচিত্রে জায়গা করে নেয় বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বিজয়ী বীরের বেশে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। পরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে জাতিকে একটি সংবিধান উপহার দেন তিনি। যুদ্ধবিধস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজে, সমাজে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কাজে মনোনিবেশ করেন। দিন রাত কাজ করে যান। নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে সামনের দিকে দেশকে এগিয়ে নেয়ার জোর প্রচেষ্টা চালান।
এরই মাঝপথে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালির অবিসংবাদিত নেতাকে চিরতরে থামিয়ে দেয়া হয়। এ দেশেরই একদল বিশ্বাসঘাতক দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের সহায়তায় নির্মম নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে তাকে। সপরিবারে নিহত হন জাতির জনক। এই রক্তাক্ত বেদনাবিধুর ইতিহাস, এই কারবালা বাঙালির বুকে চির ক্ষত এঁকে দিয়েছে।
Check Also
আশাশুনিতে টঙ্গী ইজতেমায় হত্যার বিচারের দাবিতে মানববন্ধন
এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।ঢাকার টঙ্গীত ইজতেমা-মাঠে নিরীহ মুসল্লিদের উপর উগ্রবাদী সন্ত্রাসী সাদ পন্থীদের বর্বরোচিত হামলা ও পরিকল্পিত …