সুন্দরবনে বাঘে মানুষে লড়াই চলতে থাকে। বনে যেন বাঘে মানুষে লুকোচুরি খেলা। একটু অসাবধান হলেই বাঘের হামলার শিকার হন বনজীবী ও মৎস্যজীবীরা। এই ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে বাঘের কথা ভেবে কাজকর্ম ও চলাচল করতে হয়।
জীবন জীবিকার তাগিদে বেশির ভাগ মানুষজন সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভরশীল। দরিদ্র মানুষের বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় প্রাণের মায়া ত্যাগ করে জলে কুমির, ডাঙ্গায় বাঘ আর বনদস্যু ও জলদস্যুদের অত্যাচারের ভয় উপেক্ষা করে সুন্দরবনে যায়। নদীতে মাছ, কাঁকড়া, বনে কাঠ, মধু সংগ্রহ করে মুলত এইসব পরিবারগুলি জীবন জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। প্রতিনিয়ত সুন্দরবনের বাঘের আক্রমনে মৃত্যু হচ্ছে অনেক বনজীবী, মৎস্যজীবী, মাওয়ালী ও বাওয়ালীর।
ভয়ঙ্কর সুন্দর সুন্দরবন। প্রতিটা মুহূর্ত মৃত্যুর হাতছানি। বনে বাঘসহ বন্যপ্রাণী, জলে কুমির আর জলদস্যুদের নজর এড়িয়ে জীবন বাঁচিয়ে রাখা। প্রতি বছর কিছু মানুষ বাঘের শিকার হচ্ছে আবার কিছু মানুষ লড়াই করে বাঘের মুখ থেকে জীবন বাঁচিয়ে ফিরছে। সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামগুলোতে এমন বাঘে ধরা মানুষ দেখা যায়। এদের মধ্যে কেউ কেউ দুইবার বাঘের মুখে পড়েও বেঁচে ফিরেছে। এমন বাঘে আক্রান্ত মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, বাঘের হামলায় ক্ষত-বিক্ষত শরীর, বিকৃত চেহারা, মানসিক ভারসাম্যহীন ভাবে তাদের বেঁচে থাকা। এ যেন এক অভিশপ্ত জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা।
বাঘ মানুষের চোখের সামনে থেকে আক্রমন করে না। চুপি চুপি এসে চোখের আড়ালে থেকে মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঝোপের পিছন থেকে আচমকাই বাঘ বেরিয়ে আসে। তার ভয়ঙ্কর প্রবল গর্জন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই চোখের নিমিষে ঝাঁপ দেয় বাঘ। বাঘ প্রথমে থাবা মেরে মানুষকে মাটিতে ফেলার চেষ্টা করে। বাঘের সামনের দুই পায়ের থাবায় পাঁচটি করে প্রখর ধারালো লম্বা নখ আছে। থাবা মেরে মাংস ছিড়ে ফেলে। শিকার ধরার সময় বাঘ প্রচন্ড শক্তি দিয়ে সামনের পাদুটি ব্যবহার করে। প্রথমে বাঘ মাখায় আক্রমন করে। কামড়ে কামড়ে দাঁত বসাতে চেষ্টা করে। এ সময়ে বাঘের মুখ থেকে প্রচুর পরিমান লালা ঝড়তে থাকে। দাঁত বসানোর আগ পর্যন্ত মানুষ বাঘের সাথে লড়াই করতে পারে। মাথা, গলা কামড়ে ধরলে আর কিছু করার থাকে না। এ যেন নিশ্চিত মৃত্যু। বাঁচার আর পথ থাকে না।
বাঘের আক্রমন থেকে উদ্ধারকৃত ব্যক্তি চিকিৎসায় শরীরের অন্যান্য ক্ষত থেকে সেরে ওঠে। তবে মনের ক্ষত থেকে আর সেরে ওঠে না। সেটা সারা জীবন তাড়া করে চলে। মাথায় আক্রমনে যে ¯œায়ুবিক ক্ষতি হয়। সেটা তাকে বাকী জীবন বয়ে বেড়াতে হয়। তার ওপর আছে মানসিক ট্রমা। মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফেরার ভয়ঙ্কর স্মৃতি কখনোই তার পিছু ছাড়ে না। যে কোন কিছুতে ভয় ভয় সামান্য শব্দ হলে মন কেঁপে উঠে। মাঝ রাতে আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে অনেকে। বাড়ির পোষা গরু, ছাগল, বলদ যদি পিঠন থেকে গায়ে ঘষাদেয় বা আপনজন ও সন্তান জড়িয়ে ধরে তাতেই কেউ কেউ আর্তনাদ করে ওঠে। বাঘে আক্রান্ত প্রায় ব্যক্তি স্বাভাবিক ভাবে থাকে বিকারগ্রস্থ। ভুলে যাওয়া হিসাব মেলাতে না পারা। সময় জ্ঞান নষ্ট হয়ে হয়ে যাওয়াসহ শারীরিক দুর্বলতা। দৈনন্দিক কাজকর্মে মন না বসা। এ এক দুর্বিসহ জীবন তার সারা জীবন বয়ে চলতে হয়।
বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত পর্যালোচনা করলে দেখা যায় গত এক দশক আগে প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে ৩০-৫০জন মানুষ বাঘের আক্রমনে মারা যেত। এদের অধিকাংশ বাওয়ালী, জেলে, মৌয়ালী ও জ্বালানী কাঠ আহরনকারী। সরকার বন্যপ্রাণী দ্বারা নিহত বা আহত মানুষকে ক্ষতি পূরন নীতিমালা প্রণয়ন করেছে এবং এর আলোকে ২০১১ সাল থেকে নিয়মিত ভাবে ক্ষতি পূরন প্রদান করা হচ্ছে।
বাঘ বাঁচলে সুন্দরবন বাঁচবে। সুন্দরবন বাঁচলে উপকুলবাসী বাঁচবে এ বিষয়ে জনগণ অনেকটাই সজাগ। কিন্তু বাঘে আক্রান্ত মানুষ সম্পর্কে উদাসীন ভাব, এদেরকে এড়িয়ে যাওয়া। তাদের অপয়া, অবহেলার পৃথিতে দেখা হয়। বাঘের আক্রমনে বেঁচে যাওয়া অথবা বাঘের হাতে মারা যাওয়া ব্যক্তির পরিবারের পূর্ণবাসন করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপুরণ দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
বিশেষজ্ঞাদের ধারনা, সুন্দরবনের প্রতিবেশ চক্রের পরিবর্তন, জলবায়ুর বিরুপ প্রভাব, লবনাক্ততা বৃদ্ধি, হরিণ পাচার ও শিকার এবং খাদ্য সংকটসহ বিবিধ কারনে বাঘ মানুষ দ্বন্ধ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারনে বাঘ মানুষের দ্বন্ধ ও সংঘাত নিরসনের জন্য গনসচেতনতা সৃষ্টি, প্রশিক্ষণ প্রদান ও সময় উপযোগী বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। লেখক: সাংবাদিক