ইবরাহীম খলিল : আজ ২৬ মার্চ, মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। এইদিনে পূর্ণ হলো স্বাধীনতার ৫০তম বছর। ১৯৭১ সালের এই দিনে বিশ্বের মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল, যার নাম বাংলাদেশ। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর বছরও। তাই এবার দিবসটি উদযাপনে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে ব্যাপক কর্মসূচি। কর্মসূচি দেয়া হয়েছে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের উর্ধ্বগতির কারণে এবার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপিত হবে অন্যরকমভাবে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে জাতি মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাবে। সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু ভবনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হবে দিনের কর্মসূচি। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করবে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাণী দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ।
এর মধ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে দশদিনব্যাপী অনুষ্ঠান চলছে। গত ১৭ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে এ অনুষ্ঠান। স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে আয়োজিত এসব অনুষ্ঠানে দেশী-বিদেশী অতিথিরা অংশগ্রহণ করছেন। ১৭ মার্চ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ্, ১৯ মার্চ অনুষ্ঠানে শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে, ২২ মার্চ অনুষ্ঠানে নেপালের রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবী ভা-ারী, ২৪ মার্চ অনুষ্ঠানে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং উপস্থিত ছিলেন।
আমাদের সাভার সংবাদদাতা মো. শামীম হোসেন জানান, স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে জাতীর বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে। সুর্যোদয়ের সাথে বীর শহীদদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন, রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ও আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসময় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া হবে তিন বাহিনীর গার্ড অব অনার। এর পর সেখানে শ্রদ্ধা জানাবেন মন্ত্রী পরিষদের সদস্য আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, কূটনৈতিক কোরের ডিন। পরে সকাল সাত টা থেকে নয়টা পর্যন্ত বীর শহীদদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য সমাজের সর্বস্তরের লোকজনের জন্য স্বাস্থ্য বিধি মেনে স্মৃতিসৌধে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হবে। এর পর সকালে যেকোন সময় সেখানে ফুল দিয়ে বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। এরপর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জন্য সকাল নয়টা থেকে দুপুর ১২ টা পর্যন্ত সবার জন্য স্মৃতিসৌধে প্রবেশ নিষেধ করা হয়েছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বীর শহীদদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে চলে যাওয়ার পরে আবারও বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত স্মৃতিসৌধে জনসাধারণের জন্য উন্মক্ত করে দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে স্মৃতিসৌধে জনসাধারণের জন্য প্রবেশ নিষেধ করা হয়েছে। স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে স্মৃতিসৌধে ধোওয়া মোছা রংতুলীসহ সকল ধরণের কাজ সম্পন্ন করেছে সাভার গণপূর্ত বিভাগ। জাতীর বীর সন্তানদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য স্মৃতিসৌধ সাজানো হয়েছে নতুন রুপে বলে জানিয়েছেন সাভার গণপূর্ত বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান।
এদিকে স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে স্মৃতিসৌধ ও এর আশেপাশের এলাকায় ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সরদার তিনি বলেন, ইতিমধ্যে স্মৃতিসৌধসহ আশেপাশের এলাকায় সাদা পোশাকে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সফরে এসে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশে নেওয়া বীর শহীদদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সোলিহ, নেপালের প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভান্ডারী, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং, শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। এছাড়া ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে বীর শহীদদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। স্বাধীনতার পরে এবারেই প্রথম কোন স্বাধীনতার মাসে বাংলাদেশ সফরে এসে স্মৃতিসৌধে শহীদদের স্মরণ করলেন কয়েকটি দেশের রাষ্ট্র প্রধানরা।
ইতিহাস বলছে, স্বাধীনতার আন্দোলনের মুখরতায় টালমাটাল ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৬ তারিখ ছিলো পবিত্র জুমাবার। সেদিন সুউচ্চ মিনার থেকে ভেসে আসা মুয়াজ্জিনের আযানের ধ্বনি, মুক্ত বিহঙ্গের উড়াউড়ি-ডাকাডাকি, নদীর নিঃশব্দে কিংবা কলকল রবে বয়ে চলা, এমনকি শাশ্বত সূর্যোদয়ের মধ্যেও নিহিত ছিলো অন্যরকম দ্যোতনা। কারণ সেদিন এ দেশের নির্বিশেষে মানুষ স্বাধীনতা লাভের অদম্য বাসনা নিয়ে পাকিস্তানীদের সীমাহীন ও অব্যাহত শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের সূচনা করেছিলেন। তাইতো দিনটি আবেগমথিত, মহিমান্বিত ও স্বাতন্ত্র্যে ভাস্বর। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক দিন আজ।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানী বাহিনী বাঙালি জাতির কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে অপারেশন সার্চ লাইটের নামে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে হামলার মাধ্যমে বাঙালি জাতির জীবনে যে বিভীষিকাময় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল, দীর্ঘ ৯ মাসে মরণপণ লড়াইয়ের মাধ্যমে বাংলার দামাল সন্তানেরা এক সাগর রক্তের বিনিময়ে সে যুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনে। সাড়ে সাত কোটি মানুষ পেয়েছিলো নিজস্ব মানচিত্র, নিজের মতো করে একটি লাল-সবুজ পতাকা। অযুত জনতার আপোষহীন মনোভাব ও বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে আজ আমরা স্বতন্ত্র স্বাধীন জাতিসত্তায় বিশ্ববুকে অধিষ্ঠিত। কিন্তু আমাদের স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ছিল শুধু পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়া নয়; গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন, মৌলিক অধিকার ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। বিগত পাঁচ দশকেও এসবের কোনোটিই পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। আজ প্রত্যেকের উপলব্ধির সময় এসেছে ‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন’।
গোটা জাতি আজ সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করবে স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্য বীর সেনানী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানীসহ সকল বীর মুক্তিযোদ্ধার। জাতি সেসব অজ্ঞাতনামা বীর শহীদদেরও স্মরণ করবে, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে এতটুকু কুণ্ঠাবোধ