হরতালে বাধা দিলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি হেফাজতের

রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে ভাসানী অনুসারী পরিষদের সমাবেশ থেকে ১১ জনকে হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ। শনিবার (২৭ মার্চ) দুপুরে ওই সমাবেশে বক্তব্য দেন ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর। বক্তব্য শেষে চলে যাওয়ার সময় পুলিশের গ্রেপ্তারের মুখোমুখি হলে সমাবেশে লুকান নুর ও তার নেতাকর্মীরা। প্রায় ৪৫ মিনিট সমাবেশে লুকিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। সমাবেশ শেষে ১১ জনকে পুলিশ হেফাজতে নিয়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। তবে পুলিশ বলছে, দুই থেকে তিনজনকে হেফাজতে নেয়া হয়েছে।

শনিবার সকাল থেকে প্রেস ক্লাব এলাকায় প্রতিবাদ সমাবেশ ছিল ভাসানী অনুসারী পরিষদের। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ চলাকালে পাঁচজনকে হত্যার প্রতিবাদে এ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। প্রতিবাদ সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী, গণসংহতি আন্দোলনের নেতা জোনায়েদ সাকি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর।

ডা. জাফরউল্লাহর বক্তব্য শেষ হওয়ার পরপরই সমাবেশস্থলের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ডা. জাফরউল্লাহ প্রেস ক্লাবে ঢোকার পর পুলিশ বেশ কয়েকজনকে হেফাজতে নেয়। এর আগে বিক্ষোভকারীরা সমাবেশ স্থলে বালু, ছোট ছোট ইট, মরিচের ‍গুঁড়ো জমা করে। পুলিশ বিষয়টি আঁচ করতে পেরে তাদের অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করে।

এর আগে ডা. জাফরউল্লাহ বলেন, ‘হেফাজত ইসলাম রোববার হরতালের ডাক দিয়েছে। এই হরতালে সমর্থন করা উচিৎ।’

তিনি বলেন, ‘যখন সারা পৃথিবীর রাষ্ট্রপ্রধানরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সেখানে আমি একটু অশনি সংকেত দেখতে পাই। যেমন ১৯৭৫ সালের ১ জানুয়ারি সিরাজ শিকদার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। ওইদিন সিরাজ শিকদার বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, আপনি যে কার্যক্রম করছেন তাতে আপনি আগামী ১৬ ডিসেম্বর উদযাপন করতে পারবেন না। এরপর সিরাজ শিকদার নিহত হন।’

শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে ডা. জাফরউল্লাহ বলেন, ‘আপনার বাবাও ১৫ আগস্ট নিহত হন। ওইদিন আমাদের অশ্রু ঝরেছিল। আমরা আবার সেদিনের মতো আর অশ্রু ঝরাতে চাই না।’

জাফরউল্লাহ বলেন, ‘শাল্লায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করা হয়েছে। তা আপনার লোকেরা করেছে। আপনি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন, আপনার ছোট বোন শেখ রেহানার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। রেহানাকে আপনি ভারতের সিল লাগিয়ে দিয়েছেন।’

তিনি বলেন, ‘হেফাজতের কর্মসূচিতে যে হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে তা পরিকল্পিত। এরা শহীদের মর্যাদা পাবেন। সেদিন হাশরের মাঠে আপনি কী জবাব দেবেন?’

এই সমাবেশে নেতাকর্মীদের নিয়ে দুপুর পৌনে ১২টার দিকে হাজির হন ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর। ১২টা ২০ মিনিটের দিকে ৪ মিনিটের বক্তব্য দেন নুর। নুরের বক্তব্যের সময়ই সমাবেশ ঘিরে ফেলে পুলিশ। বক্তব্য শেষে নূর ও তার নেতাকর্মীরা দক্ষিণ দিক দিয়ে বেরিয়ে যেতে শুরু করলে তাদেরকে আটকের চেষ্টা করে পুলিশ। তখন তারা আটক এড়াতে ফের সমাবেশে ফিরে যান। নুর ও তার নেতাকর্মীরা জুনায়েদ সাকী ও ডা. জাফরুল্লাহর পাশে অবস্থান নেন।

সমাবেশের মাইক নিয়ে গণসংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক জুনায়েদ সাকী পুলিশকে বারবার আটক না করার অনুরোধ জানান। এ সময় জুনায়েদ সাকী বলেন, ‘আমি আপনাদেরকে (উপস্থিত পুলিশ) অনুরোধ করছি, এই সমাবেশ থেকে কাউকে গ্রেফতার করবেন না। প্লিজ। শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করছি, আমরা আর কিচ্ছু করবো না।’

এরপর জুনায়েদ সাকী কথা বলা শেষ করলে একজন স্লোগান দেয়ার চেষ্টা করেন। তখন ফের পুলিশ উত্তপ্ত হয়ে যায়। এরপর ভিপি নুর মাইক নিয়ে সবাইকে শান্ত হতে বলেন।

সমাবেশ থেকে ৩ দফা দাবি উপস্থাপন করেন জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেন, ‘যারা নিহত হয়েছে তাদের বিষয়ে তদন্ত করতে হবে, নিহতদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের ওপর হামলার তদন্ত করতে হবে, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।’

এ সময় নুর বলেন, ‘আপনারা এখানে কোনো প্রকার উস্কানি বা বিক্ষোভ করবেন না। শান্তিপূর্ণভাবে এই প্রতিবাদ সম্পন্ন করতে দেন। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ করা উচিত হবে না। সুতরাং কোনো ধরনের উশৃঙ্খল বক্তব্য বা উত্তেজনা ছড়িয়েন না। পুলিশের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই।’

তখন সেখানে এক পুলিশ সদস্য বলেন, ‘পুলিশ নিয়ে এখানে কোনো কথা হবে না। পুলিশ নিয়ে কথা বললে শুয়ায় (শুইয়ে) ফেলবো।’

এরপর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক ছিল। তবে পুলিশ সমাবেশ ঘিরে রাখে। দুপুর ১টার দিকে সমাবেশ শেষ হয়। সমাবেশে সর্বশেষ বক্তব্য রাখেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনিও সমাবেশ থেকে কাউকে আটক না করার আহ্বান জানান।

এ সমাবেশে আরো বক্তব্য রাখেন ওয়াকার্স পার্টির সাইফুল হক, মুক্তিযোদ্ধা সাদেক খান ও দিলারা বেগম।

সমাবেশ শেষে ডা. জাফরুল্লাহসহ নেতাকর্মীদের সঙ্গে সাবেক ভিপি নুর ও তার নেতাকর্মীরা প্রেসক্লাবের ভেতরের দিকে রওনা দেন। তখন প্রেসক্লাবের গেট খুলতে বাধা দেয় পুলিশ। ফলে কেউ প্রেসক্লাবের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। সেখান থেকে প্রায় ১০ মিনিটের অভিযানে ১০-১২ জনকে পুলিশ আটক করে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।

আইনশৃংখলা এক সদস্য নাম না বলার শর্তে ব‌লেন, ১১ জনকে আটকক করা হ‌য়ে‌ছে।

এরপর রমনার ডিসি মো. সাজ্জাদুর বলেন, ‘আমরা তাদেরকে গ্রেপ্তার করি নাই। তাদেরকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে। শুক্রবার যে ঘটনা ঘটেছে, সেই মামলার সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে তাদেরকে ধরা হয়েছে। যাচাই-বাছাইয়ের পর তারা যদি আসামি না হয়, সাধারণ মানুষ হয়, তাদেরকে আমরা ছেড়ে দেব। দুই-তিনজনকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা জানেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হচ্ছে। সেখানে বিদেশি মেহমান আছেন। রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্লখা পরিস্থিতি রক্ষায় ডিএমপি কমিশনারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। একইসঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দদের অনুরোধ করা হয়েছে, অস্থিতিশীল বা আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয় এমন কোনো কার্যক্রম যেন তারা না নেন। আমরা মূলত তাদেরকে সেটাই বলেছি যে, আজকের দিনে কেউ যেনো কোনোরকম উশৃঙ্খল আচরণ বা নাশকতামূলক কার্যক্রম না করেন। তাদেরকে বলা হয়েছে যে, শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ শেষ করবেন। শেষ করে চলে যাবেন। যেহেতু আজকে তারা এসেছে, আপনারা দেখেছেন যে, আমরা অত্যন্ত ধৈর্য ধরে তাদের প্রোগ্রাম শেষ করতে দিয়েছি। প্রোগ্রাম শেষ করে তারা চলে গেছেন।’

————————-

প্রতি ফোটা রক্তের বদলা নেয়া হবে: বাবুনগরী

হাটহাজারী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি

নেতাকর্মী নিহতের প্রতিবাদে ডাকা বিক্ষোভ ও হরতাল সর্বাত্মক, শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে পালন করতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন হেফাজতের আমীর আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী।
আজ ২৭ই মার্চ শনিবার  সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে হেফাজত আমীর বলেন, মোদির আগমনের প্রতিবাদে গতকাল ঢাকার বায়তুল মোকাররম, যাত্রাবাড়ী, হাটহাজারী, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়  আন্দোলনরত তৌহিদি জনতার উপর গুলিবর্ষণ করে আনুমানিক ছয়জনকে শহীদ করা হয়েছে এবং গুলি ও টিয়ারস্যাল নিক্ষেপ করে প্রায় চারশত প্রতিবাদী তৌহিদি জনতাকে রক্তাক্ত করা হয়েছে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে এভাবে পুলিশের গুলিবর্ষণের ন্যাক্কারজনক ঘটনা কখনো মেনে নেওয়া যায় না। কার নির্দেশে নিরিহ-নিরস্ত্র ছাত্রদেরকে এভাবে শহীদ করা হলো, এর জবাব প্রশাসনকে অবশ্যই দিতে হবে এবং অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
হেফাজত আমীর বলেন, তৌহিদি জনতার এ আন্দোলন দেশ কিংবা সরকারের বিরুদ্ধে ছিলো না। এই আন্দোলন ছিলো বাবরি মসজিদ ধ্বংসকারী মোদির বাংলাদেশে আগমনের প্রতিবাদে। এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে তৌহিদি জনতার উপর পুলিশের এমন বর্বরোচিত হামলা বরদাশত করা যায় না। আমি এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
আল্লামা বাবুনগরী আরো বলেন, হাটহাজারীতে আমার কলিজার টুকরা চারজন ভাইকে শহীদ করেছে পুলিশ।

শহীদদের গা থেকে ঝরা এ রক্ত কভু বৃথা যেতে দেওয়া হবে না। পুলিশের গুলিতে নিহত তৌহিদি জনতার প্রতি ফোটা রক্তের বদলা নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, মোদি ইস্যুতে যদি আর একজন তৌহিদি জনতার রক্ত ঝরে বা ওলামায়ে কেরামকে হামলা মামলা ও হয়রানি করা হয় তাহলে এর প্রতিবাদে পুরো দেশে আন্দোলনের দাবানল জ্বলে উঠবে। প্রয়োজনে শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের সাথে পরামর্শ করে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করতে বাধ্য হবে।

Check Also

ঢাকা প্রসঙ্গে বদলাতে পারে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি

পাঁচ দশকের বিরতির পর গত মাসে বাংলাদেশের বন্দর নগরী চট্টগ্রামে একটি পাকিস্তানি পণ্যবাহী জাহাজ ডক …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।