আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা: ম-ম ঘ্রাণে সৌরভ ছড়ানো আমের মুকুলে আম ধরেছে। গুটি আমে নুয়ে পড়েছে জেলার ছোট বড় আম গাছ। জানান দিচ্ছে পরিপুষ্ট আমের বাম্পার ফলনের। ইত্যোমধ্যে বাজারে কাঁচা আম উঠতে শুরু করেছে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে বাণিজ্যিক ভাবে এ জেলার কাঁচা আম বেচা কেনা শুরু হচ্ছে। এরই মধ্যে করোনা ভাইরাস ও কালবৈশাখি ঝড়ে পূর্বাশে আমের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছে আম চাষিরা। যোগাযোগ ব্যবস্থার পাশাপাশি আম বাজারজাতের ব্যবস্থা করা না গেলে চাষিরা বিপুল লোকসানের মুখে পড়বেন সংশ্লিষ্টর। বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন, বিশেষত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের অভিশপ্ত প্রভাবে গ্রীষ্মকালে ৪০-৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রা এবং শীতকালে ৪-৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ৩৭% উর্বর জমি মরুভূমিতে পতিত হচ্ছে। গরমে আমের ছোট ছোট গুটি ঝরে যায়। তেমনি নতুন নতুন রোগ ব্যাধি দেখা দিয়েছে আমের ফলনে। ফলে বহুমুখী উপযোগিতা হারাচ্ছে তেমনি স্বাভাবিকভাবে আমের উৎপাদনও কমে আসছে। জেলার সবুজ প্রকৃৃতির মাঝে আমের সুনাম ধরে রাখতে প্রশাসন ও কৃষি খামার বাড়ির পক্ষ থেকে আম চাষীদের নিয়মিত তদারকি ও পরামর্শ দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। এর পরও করোনা কালিন সময়ে বিদেশে আম রপ্তানি বন্ধ থাকায় কোটি কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা করছে আম ব্যবসায়িরা।
জেলার প্রায় লক্ষাধীক পরিবার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে আম চাষের সাথে যুক্ত। পরিবারিক আম চাষের পাশা-পাশি বাণিজ্যিক ভাবে জেলাতে আম চাষ হয়ে আসছে ঐতিহ্যগত ভাবে। শুধুই তাই নয়, বর্তমান রাজধানীর বেশীরভাগ বাজার গুলিতে প্রধানত এই জেলার আম সরবরাহ হয়। ফলে এই জেলার অর্থনীতির অন্যতম উৎস হচ্ছে আম। হিমসাগর আম ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে রপ্তানি হয়ে আসছে গতকয়েক বছর ধরে।
এদিকে প্রতিবছর সুযোগ বুঝে বিদেশি ফল আমদানিতে হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। এক সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে যে, বিদেশ থেকে বৈধভাবে যে পরিমাণ ফল আমদানি করা হয়, রপ্তানি করা হয় তার ৬২ ভাগের ১ ভাগ। বাংলাদেশে প্রতি বছর ২৭,৪৬৬ হেক্টর জমি থেকে ৮,৮৯,১৭৬ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয় (বিবিএস, ২০১২)। বিশ্বের প্রধান দশটি আম উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সপ্তম এবং আগাম জাতের আম উৎপাদনে সাতক্ষীরা জেলা প্রথম।
বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অনেক আগে থেকেই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিভিন্ন জাতের আম চাষ হলেও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শুরু হয়েছে গত এক দশক ধরে। বৃটিশ ভারতের বাঙালা প্রেেদশে তথা বর্তমান বাংলাদেশে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আম উৎপাদন হতো। সে গৌরব বর্তমানে অতীত, আম আমাদের দেশে মৌসুমি অর্থকরী ফল হিসেবে গুরুত্ব পেলেও একে শিল্পজাত পণ্য হিসেবে প্রক্রিয়াজাতকরণের কার্যকর গবেষণা অদ্যাবধি না নেয়ায় হুমকীর মুখে পড়তে যাচ্ছে আম চাষ।
আমের মোরব্বা আর আচারে চাহিদার কথা মাথায় রেখে সাতক্ষীরার বাজারে কাঁচা টক আমের ঢল নামতে শুরু করেছে। ১০ এপ্রিল থেকে বাণিজ্যিক ভাবে কাঁচা আম কেনা-বেচা হবে। ব্যবসায়ীরা বলছে করোনা ভাইরাসের কারণে আমের দাম কম।
তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অধিক জনসংখ্যার ভারে আক্রান্ত। সাধারণ জনগণের অপুষ্টি দূরীকরণে, বেকারত্ব দূরীকরণ তথা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে আম শিল্পের বিকাশ পুরোপুরি ঘটিয়ে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে আমদানি ও রপ্তানির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নার্সারি পর্যায়ে আম চারা উৎপাদন একটি ব্যবসায়, কৃষক পর্যায়ে আম চাষ লাভজনক কৃষি পণ্য, ব্যবসায়ী পর্যায়ে মৌসুমি ব্যবসায় হিসেবে বিবেচিত হলেও আমকে শিল্পের পর্যায়ে ভাবা হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে যে পরিমাণ কোমল পানীয়, বিদেশি জুস, জ্যাম, জেলি ইত্যাদি আমদানি করা হয়; আমকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে তা পণ্যে রূপান্তর করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও সম্ভব।
বিশেজ্ঞরা বলছে যদি দেশে এ জাতীয় পণ্য রপ্তানি করতে না হয় তাহলেই তো দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা দেশেই থাকতো; তদুপরি বিদেশে রপ্তানি করতে পারলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ফলে দেশের আর্থসামাজিক পরিবর্তন ঘটতো। ফল বিশেজ্ঞরা বলছে, অর্থনৈতিক দিক থেকে আমের অবদান কোনো অংশে কম নয়, আন্তর্জাতিক মানের এই ফলটি শুধু পুষ্টি ও স্বাদের জন্যই বিখ্যাত নয়, এটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ি থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, জেলায় আমচাষীর সংখ্যা ১৩ হাজার ১০০ জন। জেলায় চলতি মৌসুমে পাঁচ হাজার ২৯৯টি বাগানে চার হাজারের কিছু ৩শ হেক্টর জমিতে আমের চাষ হবে। সাতক্ষীরা কৃষি খামার বাড়ি কৃৃষিবিদ হাফিজ জানান, এবছর জেলাতে ৫শ হেক্টর জমিতে ৫০ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (খামারবাড়ির) উপ পরিচালক নুরুল ইসলাম বলেন, জেলার আমের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। এ সুনাম ধরে রাখতে কাজ করে যাচ্ছে জেলা কৃষি বিভাগ। তারা চাষীদের প্রয়াজনীয় পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। কেউ আমের সুনাম ক্ষুন্ন করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে পুষ্টির অভাব মেটানো, কর্মসংস্থান তথা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাজারজাতকরণ এবং গুদামজাত করে দীর্ঘমেয়াদি বিপণন প্রক্রিয়া গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক, বেসরকারি ব্যাংক, অর্থলগ্নী প্রতিষ্ঠানসহ শিল্পোউদ্যোক্তারা এগিয়ে এলে দেশে আম শিল্পের বিকাশ ঘটবে দাবী সংশ্লিষ্টদের।