সাতক্ষীরায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, বিপাকে কৃষকরা:অকেজো হচ্ছে গভীর নলকূপ

আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে। এ কারণে বোরো চাষিরা ১০ থেকে ১২ ফুট পর্যন্ত মাটি গর্ত করে শ্যালো মেশিন বসিয়ে পানি তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এতে বিপাকে পড়েছেন হাজার হাজার বোরো চাষিরা। তীব্র্র্র গরমে বাড়ির আশপাশের পুকুরের পানি তলানিতে ঠেকেছে, পানি দিয়ে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। ফলে যেসব জায়গায় পুকুর ফিল্টার রয়েছে, তা অকেজো হয়ে পড়ে আছে। বৃহৎ এলাকার জনগোষ্ঠীকে খাবার পানির সংস্থানে একেক ঋতুতে একেক ধরনের উৎসের ওপর নির্ভর করতে হয়। বৃষ্টির সময় বাড়িতে বাড়িতে রিজার্ভ ট্যাংকে সংগৃহীত পানি (যা দিয়ে তিন চার মাস চলে), বাকি সময়ে কখনো পুকুর ফিল্টার (যদিও লবণাক্ততার কারণে এ উৎসটি হুমকির মুখে) বা সরাসরি পুকুরের পানি অথবা ব্যক্তি উদ্যোগে স্থাপিত লবণ বিমুক্তকরণ প্ল্যান্টই (আর ও প্ল্যান্ট) হচ্ছে এখানকার মানুষের খাবার পানির উৎস। গরমের সময় প্রাকৃতিক উৎস বেশির ভাগ অচল হয়ে গেছে। ফলে বোরো ধানে উৎপানের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয়ে রয়েছে চাষিরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, বিগত এক দশকের ব্যবধানে খুলনাঞ্চলের জেলাগুলোতে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহারে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়েছে বলে পরিবেশবিদরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে চাষি অধিক মাত্রায় বোরো চাষে ঝুঁকছেন। গত বোরো মৌসুমে প্রায় ১০ হাজার কোটি ঘনফুট ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার হয়েছিল। কৃষি স¤প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, বোরো চাষে গড়ে একরে ৮০ ইঞ্চি পানির প্রয়াজন হয়। ওই হিসাব অনুযায়ী এক একরে দুই লাখ ৮৩ হাজার ১৪০ ঘনফুট পানির প্রয়োজন পড়ে। সূত্রে জানা যায়, চলতি রবি মৌসুমে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট জেলায় প্রায় পৌনে এক লাখ অগভীর (শ্যালো মেশিন) এবং ছয় শতাধিক নলকূপ সেচ কাজে ব্যবহারে হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সাতক্ষীরা সূত্রে জানা যায়, সরকারী হিসাব মতে জেলাতে সাড়ে ৩৬ হাজার নলকূপ রয়েছে। যার মধ্যে অকেজো রয়েছে সাজে ৫ হাজারটি এবং সচল রয়েছে ৩১ হাজারটি। তবে বাস্তবতা হলো অকেজোর সংখ্যা আরও বেশি।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের গবেষণার বরাত দিয়ে দেশের সেচ ব্যবস্থার এই চিত্র তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, অনেক দেশ ভূগর্ভস্থ পানি কৃষিকাজে ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। ভারত, চীন ও ভিয়েতনাম সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার সীমিত করেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ অনুযায়ী, প্রতিবছর ভূগর্ভস্থ পানি ৩ থেকে ৮ মিটার নিচে নেমে যাচ্ছে। পানি নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক হেলথের তথ্যমতে, ভ’গর্ঘের পানির অতিমাত্রায় ব্যবহারের কারণে সেচের পাশাপাশি সুপেয় পানির পরিমাণও কমতে শুরু করেছে। পানির স্তর যত নিচে নামবে, বোরোর উৎপাদন খরচ ততই বাড়বে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮০-৮১ সালে এক কেজি ধান উৎপাদনে সেচের পানির প্রয়োজন হতো ২ হাজার ৮০০ লিটার। ২০০৬-০৭ সালে তা বেড়ে ৩ হাজার ২০০ লিটারে গিয়ে দাঁড়ায়। সর্বশেষ ২০১৯-২০ সালে তা চার হাজার লিটারে উঠেছে। প্রতি বছরই ধান উৎপাদনে পানির ব্যয় বাড়ছে। বিশেষ করে হাইব্রিড ধানের ব্যবহার বাড়ায় পানির প্রয়োজন বাড়ছে।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) হিসাবে, বর্তমানে দেশে কৃষিকাজে ব্যবহার করা পাম্প আছে প্রায় ১৪ লাখ। এর মধ্যে ডিজেলচালিত ১১ লাখ ৯২ হাজার ৬৩০টি। বিদ্যুতে চলে মাত্র ১ লাখ ৮৬ হাজার ৪০০টি। অগভীর নলকূপ বিদ্যুতে চলে ১ লাখ ৫০ হাজার। ডিজেলে চলে ১০ লাখ ৭০ হাজার। গভীর নলকূপের মধ্যে ১২ হাজার ডিজেলে এবং ২৬ হাজার বিদ্যুতে চলে। বোরো মৌসুমে ১৭ লাখ শ্যালো টিউবওয়েল কার্যকর থাকে। আগে এসব টিউবওয়েলে ২০ থেকে ২২ ফুট মাটির নিচ থেকে পানি তোলা যেত। কিন্তু এখন মাটির ২৮ ফুট নিচে গিয়েও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। কৃষক পাঁচ ফুট মাটি গর্ত করে সেখানে শ্যালো টিউবওয়েল বসাচ্ছে। এর পরও অনেক জায়গায় পানি পাওয়া যাচ্ছে না।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ১৯৭০-৭১ সালে প্রকৃতনির্ভর আমন ও আউশ থেকে মোট উৎপাদনের সিংহভাগ আসত। মাত্র ২০ শতাংশ ফসল আসত বোরো থেকে। এখন দেশের ৬০ শতাংশ চাল আসে বোরো থেকে। ৩০ শতাংশ আমন এবং ১০ শতাংশ আসে আউশ থেকে। এ সময়ে বোরোর মোট উৎপাদন বেড়েছে প্রায় আট গুণ। এ সময়ে দেশে বর্ষার পানিনির্ভর আউশের চাষ কমেছে এক-তৃতীয়াংশ জমিতে। আর আমনের চাষ কমেছে ৪৪ শতাংশ।
সরেজমিনে তালার কয়েকটি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ মাঠে বোরো আবাদের জমিতে দেখা যায়, অনেক বোরো চাষি গভীর নলকূপ স্থাপনের পরও জমিতে সেচ কাজে আশানুরূপ পানি পাচ্ছে না। তারা গর্তের মধ্যে মেশিন বসিয়ে পানি তোলার চেষ্টা করছে। শুধু ফসলের মাঠে নয়,বেশিরভাগ গ্রামে নলকূপ দিয়ে পানি পেতে সমস্যা হচ্ছে। পুকুর শুকিয়ে গেছে। যেসব পুকুরে গভীরতা বেশি সেইসব পুকুরে কিছুটা পানি রয়েছে যা চাহিদার তুলনায় সিমীত। ভুক্তভোগী বোরো চাষি সোলাইমানসহ কয়েকজন বলেন, ‘৯০ থেকে ১২০ ফুট গভীরে পাইপ বসিয়েও সেচ কাজের জন্য ঠিকমতো পানি পাওয়া যাচ্ছেনা। শ্যালো মেশিনে পানি কম ওঠায় বোরো চাষাবাদে জ্বালানি খরচ বেড়ে গেছে। সেচ কাজে সময় বেশি লাগছে।

ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাওয়ার কারণে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে বলে উল্লেখ করেছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম।সাম্প্রতি রাজধানীর একটি হোটেলে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর আয়োজিত বিশ্ব পানি দিবস-২০২১ উপলক্ষে এক সেমিনারে তিনি এ কথা জানান।মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এছাড়া ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে প্রচুর শিল্প-কলকারখানা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এতে করে স্বাভাবিকভাবেই পানির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা যদি সামগ্রিকভাবে পানির ব্যবহারে সতর্ক না হই তাহলে পানির তীব্র সংকট দেখা দিতে পারে।
আবু সাইদ বিশ্বাসঃ সাতক্ষীর: ২/৪/২০২১

Check Also

আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি 

এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।