রমজান ও তারাবিহ সালাত : প্রস্তুতি পর্ব -বিলাল মাহিনী*

শাবান মাস হলো সিয়াম বা রমজানের প্রস্তুতির মাস। এ মাসে আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ স. অধিক পরিমাণে সালাত আদায় করতেন এবং সিয়াম পালন করতেন; পবিত্র রমজান মাসের প্রস্তুতি হিসেবে। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের সওগাত নিয়ে প্রতি বছর হাজির হয় পবিত্র মাহে রমজান। তাইতো বিশ্ব মানবতার মাঝে এ মাসে আত্মশুদ্ধির চেতনা জাগ্রত হয়। শুধু আত্মশুদ্ধিই নয়; বরং এ মাসে সিয়াম সাধনার ফলে রোজাদারের দৈহিক সুস্থতাও ফিরে আসে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান ও হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং ফার্মেসি সূত্রে জানা যায়, এ মাসে প্রায় সব ধরণের রোগ প্রশমিত থাকে। দেহ ও মনের প্রশান্তির মাস তাই রমজান।

রমজান বা রমাদান আরবি শব্দ। হিজরি বর্ষের নবম মাসের আরবি নাম রমাদান। উর্দু, ফারসি, হিন্দি ও বাংলা উচ্চারণে এটি হয় রমজান। রমাদান বা রমজান শব্দের অভিধানগত অর্থ হলো প্রচ- গরম, উত্তপ্ত বালু বা মরুভূমি, মাটির তাপে পায়ে ফোসকা পড়ে যাওয়া, পুড়ে যাওয়া, ঝলসে যাওয়া, কাবাব বানানো, ঘাম ঝরানো, চর্বি গলানো, জ্বর, তাপ ইত্যাদি। রমজানে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় রোজাদারের পেটে আগুন জ্বলে; পাপতাপ পুড়ে ছাই হয়ে রোজাদার নিষ্পাপ হয়ে যায়; তাই এ মাসের নাম রমজান। (লিসানুল আরব)।

রমজানের পূর্ব প্রস্তুতি : হজরত উম্মে সালমা র. বর্ণনা করেন, নবী করিম স. বলেন, ‘রজব আল্লাহর মাস, শাবান আমার মাস, রমজান আমার উম্মতের মাস।’ হজরত আয়িশা সিদ্দিকা র. বর্ণনা করেন, ‘রাসুল স. বলেছেন, যারা রজব মাসে ভূমি কর্ষণ করল না, শাবান মাসে বীজ বপন করল না, তারা রমজান মাসে (ইবাদত ও পুণ্যের) ফসল তুলতে পারবে না।’ নবীজি স. সাধারণত রজব মাসে ১০টি নফল রোজা রাখতেন, শাবান মাসে ২০টি নফল রোজা রাখতেন; যাতে রমজানে ৩০টি রোজা অনায়াসে রাখা যায়। রজব ও শাবান মাসে নবী করিম স. বেশি বেশি নফল সালাত আদায় করতেন। নবী-পতœী উম্মুল মুমিনীনগণ বলেন, রজব মাস এলে আমরা বুঝতে পারতাম নবীজি স. ইবাদত-বন্দেগির আধিক্য দেখে।

রমজান মাস কুরআন নাজিলের মাস। শবে কদরে কোরআন নাজিলের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়েছে। রাসুল স. রমজান মাসে পুরো কুরআন শরিফ হজরত জিবরাইল আ.-কে একবার শোনাতেন এবং জিবরাইল আ.-ও নবী করিম স.-কে পূর্ণ কুরআন একবার শোনাতেন। বড় বড় সাহাবিরাও রমজানে প্রতি সপ্তাহে সমগ্র কুরআন একবার তিলাওয়াত করতেন।
বিশ্ব স্রষ্টা আল্লাহর ওপর ইমান আনায়নের পরই ইসলামের প্রথম ও দ্বিতীয় আমল হলো যথাক্রমে সালাত ও সাওম। কুরআনের সঙ্গে সাওম ও সালাতের সম্পর্ক সুগভীর। রাসুল স. বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তোমাদের প্রতি সাওম ফরজ করেছেন আর আমি তোমাদের জন্য তারাবির সালাত সুন্নত করেছি; অতএব যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় রমজানে দিনে সাওম পালন করবে ও রাতে তারাবির সালাত আদায় করবে, সে গুনাহ থেকে এমন পবিত্র হবে; যেমন নবজাতক মাতৃগর্ভ থেকে (নিষ্পাপ অবস্থায়) ভূমিষ্ঠ হয়। (নাসায়ি, প্রথম খ-, ২৩৯ পৃষ্ঠা)।

রমজানে তারাবিহ সালাত : রমজান মাসের সুন্নতগুলোর অন্যতম হলো কুরআন তিলাওয়াত ও তারাবির সালাত আদায়। হজরত আবু হুরায়রা র. বর্ণনা করেন, রাসুল স. বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের উদ্দেশ্যে রমজান মাসে তারাবির সালাত পড়বে, তার অতীতের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি, প্রথম খ-, ৩০ পৃষ্ঠা, হাদিস: ৩৬; ই. ফা.)। তারাবি শব্দটি বহুবচন। এর একবচন হলো তারবিহা; যার আভিধানিক অর্থ হলো বিশ্রাম, স্বস্তি, শান্তি ও প্রশান্তি। রমজান মাসে এশার নামাজের পর যে সুন্নতে মুয়াক্কাদা ২০ রাকাত নামাজ আদায় করা হয়, তাকে তারাবির সালাত বলে। (আল কামুসুল ফিকহ)। হজরত ইবনে রুমান রহ. বলেন, হজরত উমর র.-এর খিলাফতের সময় মানুষ ২৩ রাকাতের (৩ রাকাত বিতরসহ তারাবি সালাত) মাধ্যমে রাত্রি জাগরণ করতেন। (মুআত্তা ইমাম মালিক, প্রথম খ-, ১১০ পৃষ্ঠা, হাদিস: ২৮১; আবু দাউদ, প্রথম খ-, ৬৯৯ পৃষ্ঠা, হাদিস: ৪২৮৯)।
হজরত আবুজার গিফারী র. বর্ণনা করেন, রাসুলে করিম স. বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইমামের সঙ্গে তারাবি নামাজ পড়ল, ইমাম প্রস্থান করা পর্যন্ত (জামাতে নামাজ সমাপ্ত করে গেল) তার কিয়ামে লাইল (রাত জাগরণের সওয়াব পূর্ণরূপে) লিখিত হবে।’ (তিরমিজি, তৃতীয় খ-, ১৬১-১৬৯ পৃষ্ঠা, হাদিস: ৮০৬)। শাঈখ উসাইমিন রহ. বলেন, ‘সুন্নত হলো ইমামের অনুসরণ করবে; যদি ইমাম (তারাবি) পরিপূর্ণ করার আগে (মুক্তাদি) চলে যায়, তাহলে সে (মুক্তাদি) কিয়ামে লাইল বা রাত্রি জাগরণের সওয়াব থেকে বঞ্চিত হয়।’ (মাজমুউল ফাতাওয়া, চতুর্দশ খ-, ২০০-২০১ পৃষ্ঠা)। শাঈখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন: মক্কা ও মদিনা শরিফে সাহাবায়ে কেরামের সময় থেকে আজ পর্যন্ত সব সময় ২০ রাকাত তারাবি খতমে কুরআনসহ জামাতের সঙ্গে পড়া হয়। কেউ যদি জামাতে ২০ রাকাত তারাবি পূর্ণ না করে চলে যায়, তার খতমও পূর্ণ হয় না।

তারাবির ২০ রাকাত সালাত সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। পুরুষের তারাবির সালাত মসজিদে জামাতের সঙ্গে আদায় করা সুন্নত। আর মাহিলাদের জন্য বাড়িতে আদায় সুন্নাত।

তারাবির সালাতে কুরআন শরিফ খতম করা সুন্নত। নারীদের জন্যও ২০ রাকাত সুন্নত। তারাবির সালাতের সময় হলো এশার নামাজের পর থেকে ফজরের নামাজের আগ পর্যন্ত। হজরত উসমান র. হজরত উবাই ইবনে কাআব র. প্রমুখ সাহাবিগণ প্রতিদিন যতটুকু তিলাওয়াত করতেন তা মঞ্জিল নামে পরিচিত। তাই কোরআন সাত মঞ্জিলে বিভাজিত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে এক মাসে সম্পূর্ণ কুরআন খতম করার জন্য কুরআন মজিদকে সমান ৩০ ভাগে বিভক্ত করা হয়, যা পারা নামে পরিচিত।   এরপর আরও সহজ করার জন্য প্রতিটি পারাকে সমান দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এর প্রতিটি অংশকে ‘নিসফ’ বলা হয়। এর অর্থ হলো অর্ধেক বা অর্ধাংশ। প্রতিদিন এতটুকু পরিমাণ তিলাওয়াত করলেও প্রতি দুই মাসে এক খতম হয়। পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত ও এর পাঠ শ্রবণে একই রকম সওয়াব। খতমে তারাবিহ আদায় করলে পবিত্র কুরআন খতমের এ মহান ও সুবর্ণ সুযোগ লাভ করা যায়।
পবিত্র কুরআন কদরের রাত্রিতে নাজিল হয়েছে। কদরের রাত্রি রমজান মাসের শেষ দশ রজনীর একটি। রমজান মাসের রোজা পালন ফরজ আখ্যায়িত করে আল্লাহ্ তাআলা সুরা বাকারা’র ১৮৫ নম্বর আয়াতে ঘোষণা করেন, রমজান মাস যাতে কুরআন নাজিল করা হয়েছে আর এ কুরআন মানবজাতির জন্য পথের দিশা, সৎপথের সুস্পষ্ট নিদর্শন, হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী। অতএব, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাসটি পাবে সে এতে রোজা রাখবে..।
শাবান মাসের চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গে সাহাবিগণ অধিক পরিমাণে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত শুরু করতেন। ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত ব্যক্তিরা হিসাব-নিকাশ চূড়ান্ত করে জাকাত প্রদানের প্রস্তুতি নিতেন। প্রশাসকেরা কারাবন্দী লোকদের মুক্তির উদ্যোগ গ্রহণ করতেন। রাসুলুল্লাহ স. যখন শাবান মাসে উপনীত হতেন, তখন মাহে রমজানকে স্বাগত জানানোর উদ্দেশ্যে আবেগভরে আল্লাহর দরবারে এ প্রার্থনা করতেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাদের রজব ও শাবান মাসের বিশেষ বরকত দান করুন এবং আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিন।’ (মুসনাদে আহমাদ)

তাই রাসুলুল্লাহ স. একদা শাবান মাসের শেষ দিনে সাহাবায়ে কিরামকে লক্ষ্য করে মাহে রমজানের রোজার ফজিলত সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘তোমাদের প্রতি একটি মহান মোবারক মাস ছায়া ফেলেছে। এ মাসে সহ¯্র মাস অপেক্ষা উত্তম একটি রজনী আছে। যে ব্যক্তি এ মাসে কোনো নেক আমল দ্বারা আল্লাহর সান্নিধ্য কামনা করে, সে যেন অন্য সময়ে কোনো ফরজ আদায় করার মতো কাজ করল। আর এ মাসে যে ব্যক্তি কোনো ফরজ আদায় করে, সে যেন অন্য সময়ের ৭০টি ফরজ আদায়ের নেকি লাভ করার সমতুল্য কাজ করল। এটি সংযমের মাস আর সংযমের ফল হচ্ছে জান্নাত।’ (মিশকাত)

আসুন আমরা নবী স. এর দেখানো এবং মহান আল্লাহ’র নির্দেশিত সিয়াম পালনের পূর্ব প্রস্তুতি যথাযথভাবে গ্রহণ করি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সেই তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : বিলাল মাহিনী, প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, অভয়নগর, যশোর।
প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী সম্পাদক : সিংগাড়ী আঞ্চলিক গণগ্রন্থাগার ও ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, অভয়নগর, যশোর।
আজীবন সদস্য : নওয়াপাড়া ইনস্টিটিউট।
bhmahini@gmail.com
০১৭৩৫-১৭৬২৮৬

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।