মুজিবনগর সরকার দিবস ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র

সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার এই তিন মূলনীতিকে সামনে রেখে আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা সূচনা হয়েছিল আজ থেকে ৫০ বছর পূর্বে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশের এগিয়ে চলায় নিরন্তন প্রেরণা যোগায় ১৯৭১ সালের প্রবাসী সরকার তথা মুজিবনগর সরকার। সেই প্রেরণার বাতিঘর স্বাধীনতার মহান তিন মূলনীতিকে সামনে রেখে বাংলাদেশ আজ স্বাধীনতা ও প্রবাসী সরকারের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে। দীর্ঘ অর্ধ শতাব্দি পেরিয়ে আজও বাঙালি জাতি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সেই তিন মূলনীতি সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুশাসন খুঁজে ফেরে বারে বার।

ইংরেজ কবি ও প্রাবন্ধিক টিএস এলিয়ট (১৮৮৮-১৯৬৫)বলেছেন, ‘প্রত্যেক জাতিকে মুক্তির দীর্ঘ প্রহর গুনতে হয়, একটি জাতির শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলা পুরনো প্রথা ভেঙে অবিস্মরণীয় দীপ্ত বলিষ্ঠ নেতৃত্ব বেরিয়ে আসে এবং সে নেতৃত্ব একটা জাতিকে শৃঙ্খলমুক্ত করে।’

প্রবাসী সরকার গঠন : মহান মুক্তিযুদ্ধের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল গঠিত হয় বাংলাদেশের প্রথম প্রবাসী সরকার, যা মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত। ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা (বর্তমান উপজেলা মুজিবনগর) গ্রামের আমবাগানে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করেছিলো। শেখ মুজিবুর রহমান এই সরকারের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। কিন্তু তিনি তখন পাকিস্তানে কারাগারে বন্দী। তাঁর অনুপস্থিতিতে উপ-রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা এবং দেশে ও বিদেশে এই যুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলা ও সমর্থন আদায় করার ক্ষেত্রে এই সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সরকার গঠনের পর থেকে অগণিত মানুষ দেশকে মুক্ত করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। (উইকিপিডিয়া)

প্রবাসী সরকারের ৫০ বর্ষ পূর্তিতে রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেছেন, ‘মুজিবনগর সরকার গঠনের ফলে বিশ্ববাসী স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামরত বাঙালিদের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে। জনমত সৃষ্টি, শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনা ও যুদ্ধের রণকৌশল নির্ধারণে মুজিবনগর সরকার যে ভূমিকা পালন করছে তা বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অনন্য গৌরবগাথার স্বাক্ষর হয়ে থাকবে।’

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে বলেছেন, ৩০ লাখ শহিদ ও দু’লাখ নির্যাতিত মা-বোনের সম্ভমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখতে হবে। জাতির পিতা যে অসাম্প্রদায়িক, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও উন্নত-সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন। ঐক্যবদ্ধভাবে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমরা কার্যকর ভূমিকা রাখব, ইনশাআল্লাহ।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর বর্বরোচিত হামলা চালানোর পর একই বছরের ১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হয়। ঘোষণাপত্রে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করা হয়। সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়া তাজউদ্দীন আহমদ অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন মুহাম্মদ মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী এবং এএইচএম কামরুজ্জামান স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী নিযুক্ত হন। জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী অস্থায়ী সরকারের মুক্তিবাহিনীর প্রধান কমান্ডার এবং মেজর জেনারেল আবদুর রব চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত হন। মুজিবনগর সরকারের শপথের দিন ১২ জন আনসার সদস্য ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন; ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের সাধারণ নির্বাচন; ১৯৬২ সালে শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন; ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন; ১৯৬৮ সালের আগরতলা মামলা; ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুথান; ১৯৭০ সালের নির্বাচন; ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ; ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা; ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ সবই বাঙালির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফসল। অধ্যাপক গার্নারের মতে, ‘রাষ্ট যদি হয় জীবদেহ তবে সরকর হলো এর মস্তিস্কস্বরূপ’। ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন এবং ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ ছিল একটা বাস্তবসম্মত ও সময় উপযোগী সাংবিধানিক পদক্ষেপ। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠিত হল। বাংলাদেশের মাটিতেই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকার কাজ করছে তা বিশ্ববাসীকে দেখানোর জন্য শপথ গ্রহণ প্রয়োজন। শপথ গ্রহণের স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হলো পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী পূর্ববাংলার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননকে। এলাকাটির তিন দিকেই ভারত। তাই পাকিস্তানি বিমান হামলার শঙ্কা ছিল না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণ এক ঐতিহাসিক ঘটনা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে আরেকটি ঐতিহাসিক দিন।

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র : স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র  প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এ ঘোষণা প্রবাসী মুজিবনগর সরকার পরিচালনার অন্তর্বতীকালীন সংবিধান হিসাবে কার্যকর। এমনকি ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন সংবিধান প্রণীত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ ঘোষণা দেশের সংবিধান হিসাবে কার্যকর থাকে। একটি অতীব সংকটময় অবস্থার মোকাবেলায় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে সামরিক বাহিনীর আক্রমণের অব্যবহিত পূর্বে এবং পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতারের প্রাক্কালে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা ছিল নিম্নরূপ:
এটিই সম্ভবত আমার শেষ বার্তা: আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণের নিকট আমার আহবান, আপনারা যে যেখানেই থাকুন এবং আপনাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করুন। যতদিন পাক হানাদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটি বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত না হয় এবং যতদিন আমাদের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হয় ততদিন সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাটি পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারা বাংলাদেশে প্রচারের জন্য মধ্যরাতের কিছুক্ষণ পরে চট্টগ্রামে প্রেরণ করা হয়। মার্চ মাসের ২৬ ও ২৭ তারিখে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র (পরের নামকরণ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র) থেকে বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার আরও দুটি ঘোষণা প্রচার করা হয়। এর একটি প্রচারিত হয় চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম.এ হান্নান কর্তৃক এবং অন্যটি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান কর্তৃক।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কর্তৃক ঢাকা ও দেশের অন্যান্য অংশে জনগণের উপর আক্রমণ চালানোর প্রাক্কালে ঊর্ধ্বতন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, গণপরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যগণ নিরাপত্তার জন্য সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নেন। ৩০ মার্চের মধ্যেই তাদের অনেকে কলকাতায় সমবেত হন। গণপরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের যেসকল সদস্য ১০ এপ্রিলের মধ্যে কলকাতায় মিলিত হন তারা একটি প্রবাসী আইন পরিষদ গঠন করে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের খসড়া প্রণয়ন করেন। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী বৈদ্যনাথতলায় (পরবর্তী নাম মুজিবনগর) এক অনাঢ়ম্বর অনুষ্ঠানে গণপরিষদ সদস্য অধ্যাপক এম ইউসুফ আলী আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এ ঘোষণার মাধ্যমে নবগঠিত আইন পরিষদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করে।

সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি। (বাংলাপিডিয়া)

বাংলাদেশ স্বাধীনতা ও প্রবাসী সরকারের ৫০ বছর উদ্যাপন করছে। দেশ ডিজিটাল হয়েছে, অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি এসেছে। উন্নয়ন হয়েছে ঢের। কিন্তু সাম্য তথা সাধারণ মানুষের অধিকার এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কী? স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বর্ণিত মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ নির্মানে কতদূর এগিয়েছি? মানবতা মানবিকতা কোথায় আজ? সামাজিক ন্যায়বিচার সমাজে বিরাজ করছে কী? তাই আসুন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে ঘোষিত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের বাংলাদেশ গড়তে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেষ্ট হই।

  লেখক : বিলাল মাহিনী, প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, অভয়নগর, যশোর।
প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী সম্পাদক : সিংগাড়ী আঞ্চলিক গণগ্রন্থাগার ও ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, অভয়নগর, যশোর।
আজীবন সদস্য : নওয়াপাড়া ইনস্টিটিউট।

Check Also

কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে বিভাগ করার সুপারিশ দেবে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন

কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে বিভাগ করার সুপারিশ করতে যাচ্ছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) সচিবালয় …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।