আবু সাইদ বিশ্বাস : ক্রাইমবাতা রিপোট: মহামারি করোনার অর্থনৈতিক প্রতিঘাতে সারা দেশের ন্যায় সাতক্ষীরায় দারিদ্র্যের হার বাড়ছে হু হু করে। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। লকডাউনে দোকান পাট বন্ধ থাকা, কাজের পরিধি হ্রাস পাওয়া, আন্তজার্তিক শ্রম বাজারে মান্দা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারায় জেলায় অসংখ্য মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। কাজ না থাকায় তারা দারুণ কষ্টে দিনাপতিত করছে। চাউলসহ বেশিরভাগ দ্রব্যমূল্যের চড়া দামে রমজানে দু’বেলার পরিবর্তে এক বেলে খেয়ে রোজা রাখছে অসহায় ছিন্নমূল মানুষেরা। সাতক্ষীরা শহরের পাকাপুলের মোড়ে শ্রুম বিক্রি করতে আসা, মিজানুর,আকরম,মোশারফসহ অনেকেই জানালেন তাদের সিমাহীন দুর্ভোগের কথা।
দারিদ্র্রের সংখ্যা না কমার কারণ হিসাবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি অর্থবছরে (২০২০-২১) সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা, যা বাজেটের ১৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং জিডিপির ৩ দশমিক ০১ শতাংশ। গত অর্থবছরে (২০১৯-২০) সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৮১ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। তবে সমস্যা হলো বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে যেভাবে বরাদ্দ বেড়েছে, ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়ছে তার চেয়ে বেশি। চলতি অর্থবছরও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। এতে ভাতাভোগীদের অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে না এবং তারা ‘দারিদ্র্য চক্র’ থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। ফলে মন্থর হয়ে পড়ছে দারিদ্র্য কমার হার। করোনাকালে আয় হ্রাসের কারণে দারিদ্র্যসীমার সামান্য উপরে অবস্থানকারী অনেকে দারিদ্র্যের কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে, যারা এ কর্মসূচির আওতায় আসেনি। ফলে বেড়ে যাচ্ছে দারিদ্র্যের হার।
আয় কমে যাওয়া ও কর্মচ্যুতির ফলে ৪৮ দশমিক ৭২ শতাংশ ক্ষেত্রে ঋণ করে আর ৩২ দশমিক ৪১ শতাংশ মানুষ সঞ্চয় ভেঙে জীবন নির্বাহ করছেন। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) জরিপ বলছে, দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে হয়েছে ৪২ শতাংশ। একাধিক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত জরিপে দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে যাওয়ার তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪ দশামিক ৩০ শতাংশ। ২০১৮ সালে জিইডি সানেমের গবেষণায় দেখা গেছে, দারিদ্র্যের হার ২১ দশমিক ৬০ শতাংশে নেমেছিল। কিন্তু সানেমের ২০২০ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরের গবেষণা বলছে, দারিদ্র্রের হার বেড়ে ৪২ শতাংশ হয়েছে। বর্তমানে যার অবস্থা আরো ভয়াবহ।
‘দারিদ্র্য ও জীবিকার ওপর কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে দেশজুড়ে খানা পর্যায়ে পরিচালিত জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়। জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, করোনার প্রভাবে দারিদ্র্যের হার ও মাত্রা দুটোই বেড়েছে। এতে মানুষ খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খেয়েছেন, ঋণ নিয়েছেন এবং খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনেছেন। দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৩৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
সানেমের ২০২০ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরের গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের গ্রামে দারিদ্র্যের হার বেড়ে হয়েছে ৪৫ দশমিক ৩০ শতাংশ। একইভাবে শহরে দারিদ্র্যের হার ২০১৬ সালে ১৮ দশমিক ১৯ শতাংশ থেকে বেড়ে যথাক্রমে ২০১৮ সালে ১৬ দশমিক ৩০ শতাংশ ও ২০২০ সালে তা বেড়ে ৩৫ দশমিক ৪০ শতাংশ হয়েছে বলে জানান তিনি। বাংলাদেশের অতি দারিদ্রের হার ২০১৮ সালের ৯ দশমিক ৪০ শতাংশ থেকে ২০২০ সালে বেড়ে হয়েছে ২৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। ফলে গরিব হয়েছে আরো গরিব, ধনী হয়েছে আরো ধনী।
সাড়ে ২৩ লক্ষ মানুষের বসবাস সাতক্ষীরা জেলাতে। রাজনৈতিক জটিলতাসহ নানা করণে জেলার উন্নয়ন কার্যক্রম বরাবরই পিছিয়ে রয়েছে। ফলে কিছু সংখ্যক মানুষের জীবন যাত্রার মান পরিবর্তন হলেও সাধারণ মানুষ জীবন যাত্রার তেমন উন্নয় হয়নি বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
আকরাম হোসেন। শহরের কুকরালি এলাকায় বাস করেন। বয়স ভারে নুয়ে পড়েছে। ৬০ উদ্ধো এ মানুষটি শ্রম বিক্রি করে সংসার চালাতে সকাল থেকে সাতক্ষীরা শহরের পাকা পুলের মোড়ে ঝুড়ি কোদাল নিয়ে দাড়িয়ে থাকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাড়িয়ে থাকার পর কোন দিন কাজ হয় আবার কোন দিন কাজ হয় না। বর্তমানে লকডাউনের কারণে তার কাজ হচ্ছে না। কাজ না পেয়ে অসহায় ভাবে খালি। হাতে তাকে বাড়ি ফিরে যেতে হচ্ছে। তিনি জানান, দু:খের কথা কি বললো। শুনার কেউ নেই। জানিনা আগামি দিন গুলি কি ভাবে চালাবো।
আবদুল মতলেব। ৪০ বছর ধরে তিনি শ্রম বিক্রি করে সংসার চালান। বর্তমানে তার বয়স ৭০ বছর। বয়সভারে ও তিনি স্বাচ্ছন্দে শ্রমের মাধ্যমে প্রতি দিন ২ থেকে ৩ শ টাকা উপার্জন করে সংসার চালান। কিন্তু লকডাউনের কারণে শ্রমিকের চাহিদা কম থাকায় তাদেও হাতে কাজ নেই। একই অবস্থা এ জেলার হাজারো মানুষের।
শ্যামনগর কৈখালি এলাকা থেকে কাজের সন্ধানে সাতক্ষীরা শহরে এসেছেন আবু সাইদ (৫০)। বর্তমানে তিনি শহরের কামাল নগরে থাকেন। সদরের ধুলিহর গ্রামের পরিতোষ (৫০),আশাশুনির সোভানালি এলাকার কামরুল ইসলাম,শ্যামনগরের পরানপুর গ্রামের হাবিবুর থাকে শহরের পলাশপুল এলাকায়,এরা সকলেই শহরের পাকাপুলের মোড়ে প্রতিদিন সকালে ঝুড়ি কোদাল নিয়ে শ্রম বিক্রি করতে আসেন। কথা হয় তাদের সাথে। একটাই অভিযোগ তাদের কাজ চাই। কাজ না পেলে সংসার চালাবো কি করে। তাদেও পাশে বৃত্তবানদের এগিয়ে আসা দরকার জানালেন সংশ্লিষ্টরা।
মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকাপের কারণে গরীব এবং নিম্ন আয়ের নারীদের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। নারীরা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। বাল্যবিবাহ বেড়েছে ৫৮ শতাংশ এবং অকালে গর্ভধারণ বেড়েছে ৩০ শতাংশ। সাতক্ষীরা সদর জমিয়াতুল মোদারেসিনের সভাপতি সাতক্ষীরা আয়েনউদ্দীন মহিলা আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মো: রুহুল আমিন জানান, চলতি বর্ষে ১০ম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত ৩৫ জন ছাত্রীর মধ্যে ২৮ জন ছাত্রী বাল্য বিবাহের শিকার হয়েছে। ফলে ২০২১ শিক্ষা বর্ষে দাখিল ফরম পুরুনে ছাত্রী সংকটে হিমশিম খেতে হয়েছে। শ^শুর বাড়ি থেকে বাঁধা আসার কারণে বেশির ভাগ ছাত্রী ফরম পুরণ করতে পারিনি।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, বেকারত্ব কমাতে সরকার নানা মুখি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে,যুবউন্নয়ন,সমাজসেবা,ন্যাশনালসার্ভিস সহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এছাড়া আরো বেকার জনবল স্বালম্বী করতে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর কাজ করে যাচ্ছে।