মধ্যস্বত্বভোগীর কারণে ভোক্তাদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা# ধানে ব্লাস্ট রোগে সর্বশান্ত চাষি# সরকারি ভান্ডারে চালের মজুদ খুবই কম থাকায় চিন্তিত ভোক্তারা
আবু সাইদ বিশ্বাস:সাতক্ষীরা: চলতি মৌসুমে বোরো ধানের আবাদ ও উৎপানে কৃষকদের ১৪৫ কোটি টাকার প্রণোদনাসহ বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে না পড়ায় বোরো ধানের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে। একই সঙ্গে সারাদেশে বোরো ধানের আবাদ ও হয়েছিল অন্য যে কোন বছরের তুলনায় বেশি । ভালো ফলন হলেও বৃষ্টির অভাবে ধানের গুণগত মান খারাপ। ধানে চিটির পরিমান বেশি। এর পরও ভাল দাম পাওয়ায় চাষীরা বেশ খুশি। তবে মধ্যস্বত্বভোগীর কারণে চাষিরা বোরো ধানের প্রকৃত দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে। সরকারি ভান্ডারে চালের মজুদ খুবই কম থাকায় ভোক্তাদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। চলতি বোরো মৌসুমে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে মোট ১৭ লাখ টন ধান ও চাল কিনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে মিলারদের কাছ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে ১০ লাখ টন সিদ্ধ চাল, ৩৯ টাকা কেজি দরে দেড় লাখ টন আতপ চাল এবং কৃষকদের কাছ থেকে ২৭ টাকা কেজি দরে সাড়ে ৬ লাখ টন ধান কেনা হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, এ বছর বোরোতে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪৮ লাখ ৫ হাজার ২০০ হেক্টর, আবাদ হয়েছে ৪৮ লাখ ৮৩ হাজার ৭৬০ হেক্টর জমিতে। গত বছরের তুলনায় এ বছর মোট আবাদ বেড়েছে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার হেক্টর ও হাইব্রিডের আবাদ বেড়েছে প্রায় ৩ লাখ ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল ১৪টি উপকূলীয় জেলার মধ্যে ৭.৯ মিলিয়ন হেক্টর নিট ফসলি জমির মধ্যে ১.৬৭ মিলিয়ন হেক্টরই দক্ষিণাঞ্চলে। এ এলাকার জীবন যাত্রা প্রধানত কৃষি ও মৎস্য নির্ভর। বিস্তীর্ণ এলাকার মোট আবাদি জমির ৭৬ শতাংশ মাঝারি উঁচু জমি যেখানে এলাকাভিত্তিক লাগসই কৃষি প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এ অঞ্চলের মৎস্য ঘেরে বোরো ধান উৎপাদনে বিপ্লব সৃষ্টি করেছে। কৃষি বিভাগ বলছে ২০২০-২১ অর্থবছরের এডিপিতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতায় ৬৮টি প্রকল্পের অনুকূলে মোট ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
পরিসংখ্যান সূত্র জানায়, স্বাধীনতার আগে পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিবছর খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল গড়ে ১৫ থেকে ২০ লাখ টন । এখন বাংলাদেশ বাড়তি খাদ্যশস্য উৎপাদনকারী দেশ। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৯৭০-৭১ সালে দেশে মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল এক কোটি ১০ লাখ টন। এখন তা বেডড়ে দাড়িয়েছে চার কোটি ৫৫ লাখ টন। বর্তমানে চাল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জমির সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কারণে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সাম্প্রতিককালে নতুন প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে এ খাতে। কৃষিকাজে যন্ত্রের ব্যবহার এখন অনেক সম্প্রসারিত হয়েছে। এখন ৯৫ শতাংশ জমি আবাদ হচ্ছে যন্ত্রপাতির মাধ্যমে। এছাড়া উচ্চ ফলনশীল জাতের আওতায় এসেছে ৮৫ শতাংশ ধানি জমি। এদিকে পরিবেশ বিপর্যায়ের কবলে উপকূলীয় জেলা সমূহে শতশত হেক্টর বোরো ধানের জমিতে ব্লাস্ট রোগের প্রাদুর্ভাবে ধান শুকিয়ে চিটায় পরিণত হয়েছে। এতে দিশেহারা সেখানকার কৃষকেরা। ধান পাকার ঠিক আগ মুহূর্তে এ রোগ দেখা দেয়ায় ধানের উৎপাদন কমে গেছে।
সাতক্ষীরা কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, জেলায় এ বছর ৭৬ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৩৪ হাজার মেট্রিক টন।সাতক্ষীরা সড়র উপজেলার কুকরালি গ্রামের চাষি শাহিনুর রহমান বলেন, ‘ধান গাছে যখন শীষ বের হচ্ছে,তখন এ রোগটা দেখা দিচ্ছে। বাইল (ধানের শীষ) শুকিয়ে ধান চিটায় পরিণত হচ্ছে। কিন্তু কোনোভাবে এর প্রতিকার পাচ্ছি না। এতে উৎপান অনেক কম হয়েছে। কলারোয়া উপজেলার জয়নগর এলাকার রাশেদুল ইসলাম বলেন, প্রতি বিঘা জমিতে ২৮ জাতের ধান ২০ থেকে ২২ মন উৎপাদিত হয়। যার মূল্য প্রায় ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। প্রতি বিঘা জমিতে খরচ হয় কমপক্ষে ১৬ থেকে ১৮ হাজার টাকা। সার ওষুধ ও বিদ্যুতের দাম না কমালে ধান চাষে লাভ হবে না।
সূত্র বলছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলাগুলোর প্রায় ৮০ লাখ মানুষ উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছে। ২০৫০ সাল নাগাদ তাদের সংখ্যা বেড়ে ১ কোটি ৩৫ লাখ পর্যন্ত হতে পারে।এ রকম উদ্বেগজনক পরিস্থিতি, প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে কৃষি খাতে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হচ্ছে।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ নূরুল ইসলাম বলেন, ‘এ বছর ৭৬ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে এবার ফলন ভালো হবে। কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, বোরো ধানের আবাদ লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আশা করা যায়, বড় ধরনের কোনো প্রাতৃতিক দুর্যোগ না হলে ধানের উৎপাদন অনেক ভালো হবে।
কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সব কিছুর পরও যে কৃষির প্রাণ কৃষকরাই তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের কোনো পরিসংখ্যান নেই। ১৯৭০ সালে কৃষিজমিতে বছরে একটি ফসল হতো, তারাই এ জমি তিন ফসলি করেছেন। কোথাও কোথাও একটি জমিতে বছরে চারটি ফসল ফলিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়েছেন বাংলার কৃষক। বন্যা, খরাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগেও সোনার ফসল ফলিয়েছেন তারা। এমনকি দাম না পাওয়াসহ অন্যান্য বিপর্যয়ও দমাতে পারেনি কৃষকদের।