আম নিয়ে বিপাকে সাতক্ষীরার আম চাষিরা: দাম নিয়ে শঙ্কা:আম জাত পণ্য বন্ধের দাবী

আবু সাইদ বিশ্বাস:সাতক্ষীরা: আম নিয়ে বিপাকে সাতক্ষীরার আম চাষিরা। ক্রেতার অভাবে আম অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে। ‘বাইরে থেকে যারা আম কিনতে সাতক্ষীরায় আসবেন, তাদের কমপক্ষে তিন দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে এমন অবস্থায় বাইরে থেকে আসা আম ক্রেতা জেলার বাজারে খুবই সিমীত। ফলে চাষিদের অভিযোগ, আমের যে দাম পাচ্ছেন তাতে খরচ উঠছে না। এদিকে গত দু’বছর বিদেশে আম রপ্তানি বন্ধ থাকায় চরম ক্ষতির মুখে পড়েছে এ জেলার আম শিল্প। এছাড়া কাঁচা ও পাঁকা আমের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত না করে বিদেশ থেকে আম জাত পণ্য রপ্তানি করায় কোটি কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখে দেশীয় আম শিল্প। বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন, বিশেষত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের অভিশপ্ত প্রভাবে গ্রীষ্মকালে ৪০-৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রা এবং শীতকালে ৪-৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ৩৭% উর্বর জমি মরুভূমিতে পতিত হচ্ছে। তেমনি নতুন নতুন রোগ ব্যাধি দেখা দিয়েছে আমের ফলনে। ফলে বহুমুখী উপযোগিতা হারাচ্ছে তেমনি স্বাভাবিকভাবে আমের উৎপাদনও কমে আসছে। জেলার সবুজ প্রকৃৃতির মাঝে আমের সুনাম ধরে রাখতে প্রশাসন ও কৃষি খামার বাড়ির পক্ষ থেকে আম চাষীদের নিয়মিত তদারকি ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
এক সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে যে, বিদেশ থেকে বৈধভাবে যে পরিমাণ ফল আমদানি করা হয়, রপ্তানি করা হয় তার ৬২ ভাগের ১ ভাগ। বাংলাদেশে প্রতি বছর ২৭,৪৬৬ হেক্টর জমি থেকে ৮,৮৯,১৭৬ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয় (বিবিএস, ২০১২)। বর্তমানে আমের উৎপান প্রায় দ্বিগুণ। বিশ্বের প্রধান দশটি আম উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সপ্তম এবং আগাম জাতের আম উৎপাদনে সাতক্ষীরা জেলা প্রথম। আম আমাদের দেশে মৌসুমি অর্থকরী ফল হিসেবে গুরুত্ব পেলেও একে শিল্পজাত পণ্য হিসেবে প্রক্রিয়াজাতকরণের কার্যকর গবেষণা অদ্যাবধি না নেয়ায় হুমকীর মুখে পড়তে যাচ্ছে আম চাষ।
তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অধিক জনসংখ্যার ভারে আক্রান্ত। সাধারণ জনগণের অপুষ্টি দূরীকরণে, বেকারত্ব দূরীকরণ তথা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে আম শিল্পের বিকাশ পুরোপুরি ঘটিয়ে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে আমদানি ও রপ্তানির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নার্সারি পর্যায়ে আম চারা উৎপাদন একটি ব্যবসায়, কৃষক পর্যায়ে আম চাষ লাভজনক কৃষি পণ্য, ব্যবসায়ী পর্যায়ে মৌসুমি ব্যবসায় হিসেবে বিবেচিত হলেও আমকে শিল্পের পর্যায়ে ভাবা হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে যে পরিমাণ কোমল পানীয়, বিদেশি জুস, জ্যাম, জেলি ইত্যাদি আমদানি করা হয়; আমকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে তা পণ্যে রূপান্তর করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও সম্ভব।
বিশেজ্ঞরা বলছে যদি দেশে এ জাতীয় পণ্য রপ্তানি করতে না হয় তাহলেই তো দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা দেশেই থাকতো; তদুপরি বিদেশে রপ্তানি করতে পারলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ফলে দেশের আর্থসামাজিক পরিবর্তন ঘটতো। ফল বিশেজ্ঞরা বলছে, অর্থনৈতিক দিক থেকে আমের অবদান কোনো অংশে কম নয়, আন্তর্জাতিক মানের এই ফলটি শুধু পুষ্টি ও স্বাদের জন্যই বিখ্যাত নয়, এটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সাতক্ষীরায় প্রশাসনের বেঁধে দেয়া সময় শেষে ১লা মে শনিবার থেকে শুরু হয়েছে গোপালভোগ ও গোবিন্দভোগ আম পাড়া। চাষিরা বলছেন, উৎপাদন ভালো হলেও দামে সন্তুষ্ট নন তারা। এ ছাড়া আমচাষিদের সুবিধার্থে ২১ মে আ¤্র্রপালি ও এরপর অন্যান্য আম পাড়া যাবে।’ জেলায় এবার পাঁচ হাজারেরও বেশি বাগানে আম চাষ হয়েছে। এসব বাগানে চাষি রয়েছেন ১৩ হাজার ১০০ জন। চলতি বছরে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪০ হাজার মেট্রিক টন।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ সূত্র জানান, জেলার সাতটি উপজেলায় চলতি বছর চার হাজার হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। এরমধ্যে সদর উপজেলায় ১১৯৫ হেক্টর জমিতে, কলারোয়া উপজেলায় ৬০২ হেক্টর, তালা উপজেলায় ৭০৫ হেক্টর, দেবহাটা উপজেলায় ৩৬৮ হেক্টর কালিগঞ্জ উপজেলায় ৮০৫ হেক্টর, আশাশুনি উপজেলায় ১২৫ হেক্টর ও শ্যামনগর উপজেলায় ১৫০ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। এরমধ্যে সাতক্ষীরা সদরে আমের বাগান রয়েছে ১৫৩০টি, কলারোয়ায় ১৩১০টি, তালায় ১৪৫০টি, দেবহাটায় ৪৭৫টি, কালিগঞ্জে ১৪২টি, আশাশুনিতে ১৯০টি ও শ্যামনগর উপজেলায় ১৫০টি আমের বাগান রয়েছে। সাতক্ষীরার মাটি ও আবহাওয়া আম চাষের অনুকূল হওয়ায় অন্য অঞ্চলে উৎপাদিত আমের চেয়ে সাতক্ষীরার আম বাজারে উঠতে থাকে সবার আগে।
সোমবার ৩মে সাতক্ষীরা জেলার আমের বড় মোকাম সুলতানপুর বড়বাজার ঘুরে আমের বেঁচাকেনা দেখা গেল চোখে পড়ার মত। আলিপুরের এক আম চাষি মামুন জানালেন,অন্যবার পাইকারী ব্যবসায়ীরা বাড়ি বাড়ি যেয়ে আম কিনে নেয়। এবার কেউ আম কিনতে চাচ্ছে না। তাই বাজারে নিয়ে আসলাম। তবে এখন পর্যন্ত দাম ভাল। ১৫শ থেকে ২২শ টাকা পর্যন্ত মণ প্রতি গোপালভোগ আম বিক্রি হচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ আড়তদারদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে ব্যবসা করার কারণে বাগানের সমস্ত আম উঠার পর আড়তদারদের কাছে সেই আম বিক্রি করতে বাধ্য হতে হয়। ফলে সিন্ডিকেটের কবলে পড়তে হয় জেলার গোটা আম ব্যবসায়ীদের। একটি আম উৎপান থেকে চুড়ান্ত ভোগ পর্যন্ত কয়েকবার হাত বদল হয়। এতে আমের দামকয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। শুধু আড়তে আম উঠানোর করণে আড়তদারদের শতকরা আট থেকে দশ টাকা হারে খরচ দিতে হয়। ব্যবসায়ীরা জানান, সাতক্ষীরাতে যে আমের মণ ২ হাজার টাকা ঢাকাতে তা বেড়ে দাড়ায় ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। আবার জেলার গ্রাম পর্যায়ে আমের মণ ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকায় জেলার পাইকারী বাজারে তা ২ হাজার থেকে ২২ শত টাকা। ফলে প্রকৃত চাষীরা আমের ন্যর্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়।
বড়বাজার কাঁচা-পাকা মাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহিম বাবু বলেন, ‘সরকারি বিধি পালনের কিছুটা দায়িত্ব আমাদের রয়েছে। আমরা পরিষ্কার ঘোষণা করেছি, গোপালভোগ ও গোবিন্দভোগ আম ছাড়া অন্য কোনো আম যদি কেউ নিয়ে আসে, তবে আমরা সে আম খরিদ করবো না। এ ছাড়া কেমিক্যাল দিয়ে আম পাকানোর বিষয়েও তারা সতর্ক রয়েছে।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নূরুল ইসলাম বলেন, ‘বাইরে থেকে যারা আম কিনতে আসবেন, তাদের কমপক্ষে তিন দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। এ ছাড়া আমচাষিদের সুবিধার্থে ২১ মে আম্রপালি ও এরপর অন্যান্য আম পাড়া যাবে।’তিনি জানান, জেলায় এবার পাঁচ হাজারেরও বেশি বাগানে আম চাষ হয়েছে। চাষিদের বিভিন্ন বিষয়ে কৃষি কর্মকর্তরা পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।