স্ত্রী হত্যায় পুলিশের সাবেক এসপি বাবুল ধরা খেলেন যে প্রশ্নে

ক্রাইমবাতা ডেস্ক রিপোট:  চট্টগ্রামে মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকাণ্ড নিয়ে ৫ বছর পর চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এতদিন যিনি ছিলেন এই মামলার বাদী এখন সেই বাবুল আকতারই হয়ে গেলেন এই হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি। সব অভিযোগের তীর এখন সাবেক এই এসপির বিরুদ্ধে। মূলত তদন্ত সংস্থার একটি প্রশ্নেই ফেঁসে যান বাবুল।

মিতু হত্যাকাণ্ডের পর তার স্বামী বাবুলকে যে নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছিল। তবে বিষয়টি স্পষ্ট ছিল না। কারণ মিতু হত্যার পর বাবুলের প্রতিক্রিয়া ছিল স্বজন হারানোর মতো শোকে কাতর মানুষের মতো। মিতুর দাফনের সময় হাউমাউ করে কেঁদেছিলেন পুলিশের সাবেক এই কর্মকর্তা।

একদিন গভীর রাতে ঢাকার গোয়েন্দা কার্যালয়ে বাবুল আকতারকে নিয়ে প্রায় ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর বাবুলকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পুলিশের চাকরি থেকে ইস্তফা দেওয়ার কথাও জানানো হয়। যদিও বাবুল দাবি করেন তাকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে।

এর কিছু দিন পর থেকে মিতুর বাবা মেয়ে হত্যার জন্য বাবুলকে দায়ী করে আসছিলেন। তবে তারপর দীর্ঘদিন মামলার তদন্তে তেমন কোনো অগ্রগতির খবর আসছিল না।

হত্যাকাণ্ডের সাড়ে তিন বছর পর গত বছরের জানুয়ারিতে মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। এর ১৪ মাস পর বুধবার বাবুলকে মিতু হত্যার প্রধান আসামি করে মামলা করেন তার বাবা মোশারফ। এদিনই তাকে গ্রেফতার করা হল। এতদিন তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণ হিসেবে পিবিআই বলছে, হত্যা মামলায় বাবুলকে সম্পৃক্ত করার মতো সাক্ষ্যপ্রমাণ তাদের হাতে ছিল না।

পিবিআই বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত হল কী করে? এ বিষয়ে একজন তদন্ত কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বাবুলের আর্থিক লেনদেনের তথ্য যাচাই–বাছাই করতে গিয়েই হত্যাকাণ্ডে তার জড়িত থাকার বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। তারা মূলত ২০১৬ সালে মিতু হত্যার আগে-পরে বাবুল আক্তারের আর্থিক লেনদেনের খোঁজখবর করেন। তারা দেখতে পান, হত্যাকাণ্ডের তিন দিনের মাথায় বাবুল আক্তার তিন লাখ টাকা খরচ করেছেন। এই পর্বেই তারা গাজী আল মামুন ও সাইফুল হককে খুঁজে পান।

তারা জানতে পারেন, বাবুল আক্তারের ব্যবসায়িক অংশীদার সাইফুল হকের কাছ থেকে লাভের তিন লাখ টাকা চেয়ে নিয়েছিলেন বাবুল। ওই টাকা তিনি নড়াইলের গাজী আল মামুনের কাছে পাঠান। মামুন সেই টাকা এই মামলার অন্যতম আসামি কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা ও ওয়াসিমসহ অন্যদের মধ্যে ভাগ করে দেন। পাঁচ বছর আগের ওই লেনদেনের তথ্য পিবিআই বিকাশ থেকে সংগ্রহ করে।

এই মামলার দুই আসামি জবানবন্দিতে পরিস্কারভাবে বলেছেন যে, মিতুকে হত্যা করতে তিন লাখ টাকা ব্যয় করেছেন বাবুল।

তদন্ত কর্মকর্তারা সোমবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত টুকটাক নানা বিষয়ে বাবুল আকতারকে প্রশ্ন করেন। আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে প্রশ্নের কোনো সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি। একেকবার একেক কথা বলেন।

তবে বাবুলের আশা ছিল, জিজ্ঞাসাবাদের পর পুলিশ তাকে ছেড়ে দেবে। বিকালের পর তিনি বুঝতে পারেন, তিনি আটকা পড়েছেন। তদন্ত কর্মকর্তারা ধীরে ধীরে বাবুলের কাছ থেকে মুঠোফোনগুলো নিয়ে নিতে শুরু করেন। এ সময় তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।

জিজ্ঞাসাবাদে থাকা একজন বলেন, বাবুল আকতার নিজেও পুলিশ অফিসার ছিলেন। তার ডিভাইসগুলো নিয়ে নেওয়ার পরই তিনি ধরা পড়ে গেছেন বলে বুঝতে পারেন।

এরপর তিনি কাকুতি-মিনতিও করেন, কেউ ধরা পড়ে গেলে যেমন করে থাকেন তেমনই। সন্তানদের কথাও বলেন তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাইফুল হকের ছাপাখানার ব্যবসায় বাবুল আক্তার বিনিয়োগ করেছিলেন। বুধবার গাজী আল মামুন ও সাইফুল হক দুজনকেই ছেড়ে দিয়েছে পিবিআই। এই মুহূর্তে এই মামলায় বাবুলসহ আট আসামির দুজন কারাগারে আছেন। বুধবার রাতেই মামলার আরেক আসামি সাইদুল ইসলাম শিকদার ওরফে সাকুকে গ্রেফতার করেছে র‍্যাব। সাকুর ভাই কামরুল ইসলাম শিকদার ওরফে মুসা এই হত্যাকাণ্ডের অন্যতম সন্দেহভাজন। পুলিশের ভাষায় তিনিসহ আরেক আসামি পলাতক আছেন। বাকি দুই আসামি আগের মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর জামিনে আছেন।

পিবিআইয়ের চট্টগ্রাম জেলা ও মেট্রো ছাড়াও এই মামলার তদন্তে একযোগে কাজ করে ঢাকার চারটি, গোপালগঞ্জ ও খুলনার দুটি ইউনিট। তারা একইসঙ্গে তিনজনকে নজরদারির আওতায় আনে। সব তথ্য যাচাইবাছাইয়ের পর গত বুধবার পিবিআই বাবুল আক্তারকে ডেকে পাঠায়। বাবুল এক দিন সময় চান। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার বলতে পারবেন কবে তিনি দেখা করতে পারবেন। সোমবার তাঁকে চট্টগ্রামের পিবিআই কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। একই সময়ে বাবুল আক্তারের পরিচিত দুই ব্যক্তিকেও জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই। তবে তাদের মুখোমুখি করা হয়নি। এর প্রয়োজনও ছিল না বলে মন্তব্য করেন তারা।

পিবিআই মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের পর বাবুল আক্তার যখন বিভিন্ন প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দিতে পারছিলেন না, তখনই তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদকে অবহিত করেন। পিবিআই জানায়, পিছিয়ে আসার কোনো সুযোগ নেই। বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। বাবুল আক্তারের পাশাপাশি তার দুই পরিচিত গাজী আল মামুন ও সাইফুল হকও আদালতে সাক্ষী হিসেবে কথা বলতে রাজি হন।

পিবিআইয়েন উপমহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, তাদের তদন্তের শুরুটা হয়েছিল একটা প্রশ্নের জবাব খোঁজার মধ্য দিয়ে। সেটা হলো ঘটনাস্থলে মুসা থাকার পরও কেন তাকে শনাক্ত করতে পারলেন না বাবুল আকতার। তিনি আরও বলেন, বাবুল আক্তার একজন চৌকস কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি মুসাকে দায়ী না করে জঙ্গিদের ওপর দায় চাপান এবং জানান মিতু হত্যাকাণ্ডের দিন কয়েক আগে জঙ্গিরা তার ওপর হামলা করেছিল। হত্যাকাণ্ডের পর তার যে আচরণ তা-ও ছিল অতি প্রিয়জন হারানোর পর মানুষ যেভাবে শোক করেন তেমনই।

এজাহারে মোশাররফ হোসেন একই প্রশ্ন তুলেছেন। পাশাপাশি লেখেন, জাতিসংঘে কর্মরত একজন নারীর সঙ্গে পরকীয়ার কারণে তার মেয়ের সঙ্গে জামাইয়ের দাম্পত্য কলহ চরমে পৌঁছেছিল। মোশাররফ লেখেন, ‘হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দানকারী ২ নং বিবাদী মো. কামরুল ইসলাম শিকদার ওরফে মুসা তার (বাবুল আক্তারের) দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত ও পারিবারিকভাবে পরিচিত সোর্স হওয়া সত্ত্বেও সুকৌশলে তাকে শনাক্ত না করে জঙ্গিদের দ্বারা হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছে মর্মে দাবি করে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা করে।

মোশাররফ আরও লেখেন, বাবুল আক্তার পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়লে পরিবারে চরম অশান্তি দেখা দেয়। এ নিয়ে প্রতিবাদ করায় মিতুকে বাবুল আক্তার বিভিন্ন সময় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন। মিতুর বাবা এজাহারে ওই নারীর সঙ্গে বাবুল আক্তারের বিনিময় কিছু খুদে বার্তার উল্লেখ করেন।

প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় সড়কে খুন হন পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু।

পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ সদরদফতরে যোগ দিতে ওই সময় ঢাকায় ছিলেন বাবুল। এর আগে তিনি চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে কর্মরত ছিলেন।

হত্যাকাণ্ডের পর নগরীর পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাত পরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেন বাবুল। তবে পুলিশ তদন্তে তার সম্পৃক্ততার গুঞ্জন ছিল আগে থেকেই।

এরপর তিনি চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। বাবুলের দাবি তার স্ত্রী জঙ্গি হামলায় নিহত হয়ে থাকতে পারেন। তবে তার শ্বশুরের দাবি, বাবুল এক এনজিওকর্মীর সঙ্গে পরকীয় করছিলেন। বিষয়টি জেনে ফেলায় মিতুকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে ফেলেন বাবুল।

Check Also

বিএনপি নেতাকর্মীদের জড়িয়ে হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে দেবহাটায় মানববন্ধন

দেবহাটা প্রতিনিধি: স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দোসর এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও ভূমিদস্যুদের গ্রেফতার এবং বিএনপির …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।