ভারতের পাশের বাড়ি নেপালে করোনার বিধ্বংসী রূপ

ভারতে করোনা সুনামি। হাসপাতালে বেড খালি নেই। অক্সিজেনের সঙ্কট। ওষুধ চলে গেছে কালোবাজারে। শ্মশানেও ঠাঁই নেই মৃতদের। লাশ ভাসিয়ে দেয়া হচ্ছে নদীতে। বিপর্যয়কর এ অবস্থায় আতঙ্কে ১৩০ কোটি মানুষের এই বিশাল দেশ। কিন্তু এর পাশেই অতি নিকটে নেপালও কিন্তু ভাল নেই।

সেখানেও এক ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। ভারত তাদেরকে টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। এ নিয়ে অনলাইন বিবিসিতে সাংবাদিক আনবারাসান ইথিরাজন একটি প্রতিবেদন লিখেছেন। তাতে তিনি নেপালের ভয়াবহতা ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি লিখেছেন, কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে পরশুরাম মুরাইয়া তার দুর্ভোগের কথা বলছিলেন। তিনি বলছিলেন, তার পিতা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন। তাকে নিয়ে পরশুরাম এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটেছেন। তার পিতা সুন্দর মুরাইয়া (মধ্য ৫০-এ বয়স)। তাদের বসবাস দক্ষিণ-পশ্চিাঞ্চলীয় শহর নারায়ণপুরে। সেখানে কৃষিকাজ করেন তিনি। সম্প্রতি তিনি শ্বাসকষ্টের জটিলতার কথা বলেন। ৩রা মে তার করোনা পজেটিভ ধরা পড়ে। মাত্র কয়েদিনের মধ্যে তার অবস্থার মারাত্মক অবনতি হয়। এ অবস্থায় পিতাকে নিয়ে ছেলে পরশুরাম বাংকি জেলার তিনটি মেডিকেল স্থাপনায় যান। কিন্তু অক্সিজেন ও বেড সঙ্কটের কারণে কেউই তার পিতাকে ভর্তি নিতে রাজি হয়নি। হাল ছাড়েননি পরশুরাম। অবশেষে তিনি একটি বেডের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হন। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। পরশুরাম বলেন, তার পিতা মারা যান। এতে ভেঙে পড়েছেন তারা। কারণ, তিনিই ছিলেন তাদের পরিবারের একমাত্র ভরণপোষণদাতা। পরশুরামের ভাষায়, এখন আমাকে পুরো পরিবার দেখতে হয়। তিনটি ছোট ভাই আছে। তাদের দেখতে হয়। মা তো সারাক্ষণ কেঁদেই যাচ্ছেন।
এই কাহিনী একজন দু’জন পরশুরামের নয়। এমন হাজারো মানুষ তাদের প্রিয়জনকে হারিয়েছেন নেপালে। সেখানেও এখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। নেপাল সরকারের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টারের প্রধান ড. সমীর কুমার অধিকারী বলেন, যদি আমরা এই অবস্থাকে এখনই মোকাবিলা করতে না পারি, তাহলে পরিস্থিতি বিপর্যয়ের দিকে যাবে। তিনি আরো বলেন, কাঠমান্ডু উপত্যকায় সব আইসিইউ বেড এবং ভেন্টিলেটরে রোগী ভর্তি। এর একটিও খালি নেই। হাসপাতালগুলোতে বেড পর্যাপ্ত আছে। কিন্তু অক্সিজেনের অভাবে রোগী ভর্তি করাতে পারছেন না তারা। টিকাও ফুরিয়ে গেছে।

হিমালয় দুহিতা নেপালের জনসংখ্যা প্রায় তিন কোটি। একই সঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে কম উন্নত দেশের মধ্যে এটি একটি। দেশটির উত্তরে চীন আর দক্ষিণে ভারত। দুই দেশের মধ্যে ল্যান্ডলকড বা অবরুদ্ধ এবং চাপ খেয়ে স্যান্ডউইচের মতো অবস্থায় আছে এই দেশটি। তবে বেশির ভাগ সরবরাহ, বিশেষ করে চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং তরল অক্সিজেনের জন্য তাদেরকে নির্ভর করতে হয় ভারতের ওপর। ভারত ভয়াবহতার প্রেক্ষাপটে অক্সিজেন রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে অক্সিজেনের অন্য বিকল্প বের করতে সংগ্রাম করছে কাঠমান্ডু। এশিয়ার অন্য অনেক দেশের মতো বড় কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই করোনার প্রথম ঢেউ থেকে উত্তরণ ঘটায় নেপাল। কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউ এসেছে বিধ্বংসী রূপ নিয়ে। এপ্রিলের শুরুতে সেখানে প্রতিদিন সংক্রমিতের সংখ্যা প্রায় দেড়শ’তে দাঁড়ায়। কিন্তু এক মাসের মধ্যে সেই সংখ্যা ৯ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। মারা গেছেন কমপক্ষে চার হাজার মানুষ। স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে প্রতিদিন করোনা পজেটিভের শতকরা হার প্রায় ৫০ ভাগ। এর অর্থ হলো যেসব মানুষ করোনার পরীক্ষা করাচ্ছেন তার প্রতি দু’জনের মধ্যে একজন করোনায় আক্রান্ত। প্রায় ৮০ হাজার মানুষ নিজ বাড়িতেই আইসোলেশনে রয়েছেন। সামনের সপ্তাহগুলোতে মৃত্যু আরো বাড়বে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন কর্মকর্তারা। নেপালে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক সারা বেসোলো নিয়ান্তি বলেছেন, প্রতিদিন করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের দিক দিয়ে শীর্ষে থাকা প্রথম ১০টি দেশের মধ্যে ৯ম স্থানে রাখবো আমরা নেপালকে। ওইসব দেশের তুলনায় নেপালের জনসংখ্যা অনেক কম। কিন্তু করোনায় আক্রান্তের হার অনেক বেশি।

প্রতিবেশী ভারতে কয়েক মাস আগে যখন দিনে আক্রান্তের সংখ্যা ১০০ এর নিচে নেমে আসে তখন স্বাভাবিক জীবন শুরু হয়। তারা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে মরিয়া ছিল। এর কারণ, করোনার কারণে অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নেয়া। ফলে মুখে মাস্ক পরা, হাত স্যানিটাইজেশন করা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার আহবানকে অবজ্ঞা করা হয়। একই সময়ে নেপালে রাজনৈতিক সঙ্কট আঁকড়ে ধরে। প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি তার নিজ দলের ভিতরে বিদ্রোহের মুখে পড়েন। গত ডিসেম্বরে তিনি পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে আগাম নির্বাচন আহবান করেন। কিন্তু এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট ভেঙে দেয়া পার্লামেন্টকে বহাল করে। সরকারের করোনা মোকাবিলা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ওলির কঠোর সমালোচনা করেছে বিরোধী দল এবং নাগরিক সমাজ। রাজধানী কাঠমান্ডু এবং দেশের অন্যান্য স্থানে ওলি পন্থি এবং বিরোধীদের বিক্ষোভ হয়েছে। গত সোমবার পার্লামেন্টে আস্থা ভোটে হেরে যান প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি। তবে পরবর্তী সরকার কে গঠন করবে তা স্পষ্ট নয়। কারণ, কোনো দলেরই পরিষ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। রাজনৈতিক এই উত্তেজনা এবং দলের ভিতরে ক্ষমতার লড়াই করোনা মহামারিকে আরো খারাপ করে তুলেছে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। নেপালগঞ্জ শহরের ভেরি হাসপাতালের প্রধান কনসালট্যান্ট ফিজিশিয়ান ড. রাজন পান্ডে বলেছেন, রাজনীতিকরা ক্ষমতা পাওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত ছিলেন। তাদের আকর্ষণ ছিল ক্ষমতা পাওয়া। জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নয়। উল্লেখ্য, ভারত সীমান্তের কাছে নেপালগঞ্জ শহর। নেপালে যে কয়েকটি এলাকায় করোনা ভয়াবহভাবে ছড়িয়েছে তার মধ্যে এটি অন্যতম। প্রতিদিনই ভারত থেকে অভিবাসী শ্রমিকরা দেশে ফিরছেন। তাদের সংখ্যা কয়েক হাজার করে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, তাদের কেউ কেউ ভারত থেকে ভয়াবহ ভ্যারিয়েন্ট বহন করে আনছেন। বৈধভাবে দেশে ফিরলেই কোয়ারেন্টিনে নেয়া হবে, এ কারণে তারা অবৈধভাবে দেশে ফিরছেন এবং সরাসরি গ্রামের বাড়ি চলে যাচ্ছেন। ভারতফেরত বেশ কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলে রিপোর্ট পাওয়া গেছে। ড. পান্ডে বলেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের জন্য শুধু এসব অভিবাসী শ্রমিকদের দোষ দেয়া চলবে না। দু’মাস আগে সরকার এবং বিরোধী দল দেশজুড়ে বিশাল বিশাল র‌্যালি করেছে। লোকজন ধর্মীয় উৎসব পালন করেছে। বিয়েসাদি হয়েছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ে এসবই ভূমিকা রেখেছে।
বর্তমানে টিকা ফুরিয়ে যাওয়ায় নেপাল টিকা দেয়া বন্ধ করেছে। এর ফলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। প্রাথমিকভাবে তাদেরকে এস্ট্রাজেনেকার প্রায় ১০ লাখ ডোজ টিকা দান করে ভারত। পাশাপাশি তারা বৈশ্বিক টিকাদান বিষয়ক কর্মসূচি কোভ্যাক্স পাওয়া এবং চীনের কাছ থেকে টিকা পাওয়া নিশ্চিত করে। সরকারি কর্মকর্তারা বলেছেন, এরই মধ্যে ২১ লাখ মানুষকে টিকা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে চার লাখ মানুষকে দুটি ডোজই দেয়া হয়েছে। কিন্তু আকস্মিকভাবে টিকা রপ্তানি বন্ধ করেছে ভারত। এতে নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কায় দুর্ভোগ বেড়েছে। তারা চাহিদা মেটাতে চীন ও রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। জাতিসংঘের কর্মকর্তা মিসেস নিয়ান্তি বলেন, যাদের টিকা প্রয়োজন এমন মানুষদের শতকরা ২০ ভাগের জন্যও টিকা নিশ্চিত করতে পারেনি নেপাল। তাই নেপালকে অগ্রাধিকারে রাখা উচিত। যেসব দেশের হাতে অতিরিক্ত টিকা আছে, তাদেরকে অবিলম্বে তা নেপালে পাঠানোর আবেদন করছি।

Check Also

ঢাকা প্রসঙ্গে বদলাতে পারে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি

পাঁচ দশকের বিরতির পর গত মাসে বাংলাদেশের বন্দর নগরী চট্টগ্রামে একটি পাকিস্তানি পণ্যবাহী জাহাজ ডক …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।