ইংরেজি NEWS এর বাংলা প্রতিশব্দ হলো সংবাদ। জার্মান শব্দ Ônew-yo’ ও ল্যাটিন ‘neowe’ থেকে এর উৎপত্তি। দু’টিরই অর্থ ‘নতুন কিছু’। কেউ কেউ NEWS বলতে North, East, West, South -তথা বিশ্বের চর্তুদিকের খবরাখবরকে বুঝিয়েছেন। এ সংবাদ দু’ ধরণের হতে পারে সত্য সংবাদ অথবা মিথ্যা বা ভুল সংবাদ। মিডিয়া ও তথ্যপ্রযুক্তির নৈতিক দিক হলো সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করা। সংবাদ সংগ্রহ, সম্পাদনা ও জনসাধারণের নিকট তা তুলে ধরার প্রক্রিয়াই হলো সাংবাদিকতা। যিনি সংবাদ সংগ্রহ, সম্পাদনা ও প্রকাশের দায়িত্বে নিয়োজিত তিনিই সাংবাদিক। সত্য-সুন্দর ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা হিসেবে পরিগণিত। এটি একটি পবিত্র পেশা। যেখানে রয়েছে আমানতদারিতা ও সততার অপূর্ব সম্মিলন।
আজকের বিশ্ব মিডিয়া প্রকৃত সংবাদকর্মী সম্পাদক মন্ডলী ও সাংবাদিকবান্ধব মালিকদের হাত থেকে ছিঁটকে পড়েছে। দেশীয় ও আর্ন্তজাতিক মিডিয়া (প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক) আজ বেশিরভাগই রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া তত্ত্ব ও মতাদর্শগত বিভক্তিতো আছেই। বিশ্ব মিডিয়াগুলোয় একদিকে সাম্প্রদায়িক বিশেষত: মুসলিম বিদ্বেষ এবং অন্যদিকে ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে জর্জরিত। দেশীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো বেশিরভাগই রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের দখলে। যার ফলে সাংবাদিকতা এখন সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এতে বাড়ছে সংবাদকর্মীদের বিভক্তি। দেখা যায় এক একটা জেলা উপজেলায় সাংবাদিকদের একাধিক সংগঠন।
জ্ঞানের সঠিক উৎস হলো সত্য তথ্য জানা ও জানানো। গণমাধ্যম হলো তথ্যের বাহন। প্রযুক্তির মাধ্যমে তা সবার কাছে পৌঁছায়। সত্য জানতে বা সত্যে উপনীত হতে তথ্য অপরিহার্য বিষয়। তথ্যের সহজলভ্যতার জন্য প্রযুক্তি খুবই প্রয়োজন। পৃথিবীর সব মহামনীষী, নবী ও রাসুল(আ.)গণ বিশ্বমানবতার উন্নয়নে ও সভ্যতার উৎকর্ষ সাধনে যে দাওয়াতি কাজ করেছিলেন, তাতেও তাঁরা সত্য তথ্য প্রচারে সময়োপযোগী মাধ্যম ও প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন।
গণমাধ্যমের উন্নয়ন ঘটছে প্রতিনিয়ত, প্রযুক্তি উন্নত হচ্ছে অবিরত। পরিবর্তনের এই অবিরাম ধারায় যুক্ত হচ্ছে নিত্যনতুন প্রযুক্তি ও মিডিয়ার নানান নতুন সংস্করণ। কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে এই নতুনের ধারা। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের সুরা নাহলের ১৬ নং আয়াতে বলেন, ‘আর তিনি এমন কিছু সৃষ্টি করবেন, যা তোমরা (এখনো) জানো না।’ এছাড়ও সুরা আলে ইমরানের ৪৭ নং আয়াতে তিনি বলেছেন, ‘এভাবে আল্লাহ যা চান, তা সৃজন করেন।’
দুনিয়ার প্রত্যেক নব আবিষ্কৃত জিনিসেই থাকে বিভিন্ন সুবিধা ও অসুবিধা। প্রয়োজন হলো এর যথাযথ প্রয়োগ বা সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা। প্রত্যাদেশগত প্রত্যেক ধর্মই এসেছে মানুষের কল্যাণের জন্য এবং অকল্যাণ থেকে পরিত্রাণের জন্য। মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য দ্বিবিধ। যথা : ¯্রষ্টার প্রতি কর্তব্য বা আনুগত্য এবং সৃষ্টি তথা মানুষের প্রতি করণীয়। বান্দা হলো ¯্রষ্টার সৃষ্টি সবশ্রেষ্ট জীব। মানুষের প্রতি মানুষের অধিকার তিনটি। অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষের জন্য অন্য মানুষের ৩টি জিনিস সংরক্ষণ করতে হবে এবং তা এমন আমানত, যা খেয়ানত বা ক্ষতি সাধন করা সম্পূর্ণ হারাম বা নিষিদ্ধ। তা হলো সব মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্মান। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) বিদায় হজের ভাষণে বলেছিলেন, ‘এই মক্কা নগরী যেমন সম্মানিত, এই আরাফাতের প্রান্তর যেমন মর্যাদাবান, এই হজের দিবস যেমন ফজিলতপূর্ণ, এই কাবাঘর যেমন পবিত্র; প্রত্যেক মানুষের জান, মাল ও ইজ্জত অনুরূপ সম্মানীয় ও পবিত্র এবং তা অপরের জন্য হারাম ও নিষিদ্ধ।’ (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনে কাসির)। তাই মিডিয়ার ব্যবহারে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। কারণ, বান্দার হক আল্লাহ ক্ষমা করবেন না, যতক্ষণ বান্দা তাকে ক্ষমা না করেন।
তথ্য আদান-প্রদানের অন্যতম মাধ্যম হলো দেখা ও শোনা। কোনো কিছু দেখা ও শোনার ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান হলো যা সরাসরি দেখা বা শোনা জায়েজ বা বৈধ, তা যেকোনো মাধ্যমে দেখা বা শোনা জায়েজ বা বৈধ। আর যা সরাসরি দেখা বা শোনা হারাম বা নিষিদ্ধ, তা যে কোনো মাধ্যমেই দেখা বা শোনা হারাম বা নিষিদ্ধ। সুতরাং যা জায়েজ বা বৈধ তা আপলোড বা ডাউনলোড করাও জায়েজ বা বৈধ এবং যা হারাম বা নিষিদ্ধ তা আপলোড বা ডাউনলোড করাও হারাম বা নিষিদ্ধ।
ইসলামে মিথ্যাকে সব পাপের জননী বলা হয়েছে। ‘প্রতারক ব্যক্তি’ নবীজি স.-এর উম্মত নয় বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। গিবত ও পরনিন্দাকে পবিত্র কুরআনের সুরা হুজরাতে আপন মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সমান বলা হয়েছে। ‘তুহমত’ বা ‘বুহতান’ তথা মিথ্যা অপবাদ রটনা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিষয় বা বিবরণ অসম্পূর্ণ রাখা অথবা আংশিক পরিবর্তন করা এবং সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণ ও সত্য গোপন করা ইসলামে হারাম। মহান আল্লাহ তায়ালা সুরা বাকারার ৪২ নং আয়াতে বলেন, ‘তোমরা জেনেশুনে সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশিয়ে দিও না, আর সত্যকে গোপন করো না।’ সুরা আলে ইমরানের ৭১ নং আয়াতে আরও বলা হয়েছে ‘কেন তোমরা জেনেশুনে সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশাচ্ছ, আর সত্যকে গোপন করছ?’ এর জন্য পরকালে জবাবদিহি করতে হবে।
প্রতিনিয়ত আমাদের কাছে যেসব তথ্য আসে; তার সত্যাসত্য যাচাই না করে, এর উৎস বা সূত্রের নির্ভরযোগ্যতা না জেনে, তা কখনো প্রচার বা পুনঃপ্রচার করা ঠিক হবে না। তিরমিযি হাদিস গ্রন্থের মধ্যে রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘যা শুনে তাই বলতে থাকা, মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট।’ অর্থাৎ, কোনো সংবাদ বা তথ্য শুনে যাচাই-বাছাই ছাড়া গণমাধ্যমে প্রকাশ করাই একজন সংবাদকর্মীর মিথ্যা/ভুল সংবাদ প্রচারের শামিল। যেসব তথ্য-উপাত্ত দেশ, জাতি, সমাজ ও জনগণের কল্যাণে উপকারে আসবে, সেসব প্রচার করা বিধেয়। আর যেসব বিষয় বিশৃঙ্খলা ও অশান্তির কারণ হবে, তা প্রচার করা অনুচিত।
সঠিক তথ্যের প্রয়োজনে সহায়ক হিসেবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বিবরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছবি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কখনো দেখা যায় কেউ কেউ কোনো কোনো ছবি বিকৃত করে বা পরিবর্তন করে অথবা ভিন্ন বিষয় বা বিবরণ সংযোজন করে প্রকাশ বা প্রচার করে থাকেন, যা একেবারেই অনৈতিক, মানবিক মূল্যবোধের পরিপন্থী।
পাপ বলতে সব পাপই সমান। কিন্তু কিছু পাপ সাময়িক অর্থাৎ এটি একবার সংঘটিত হওয়ার পর একবারই পাপ হয়। আবার এমন কিছু পাপ আছে যা একবার করলে তার গুনাহ চলতেই থাকে, যত দিন এর দ্বারা পাপ চলতে থাকে। সহীহ মুসলিম হাদিস গ্রন্থে রাসুল স. বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মন্দ কাজের সূচনা করল; সে তার পাপের অধিকারী হবে এবং ওই কাজের অনুগামীদের পাপের ভাগীদার হবে।’ সুতরাং গণমাধ্যমে কোনো অপরাধমূলক বা গর্হিত বিষয় প্রকাশের আগে এই বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। তা না হলে দুনিয়া ও আখিরাতে লাঞ্ছিত ও শাস্তি পেতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে সত্য প্রকাশে অবিচল রাখুন। আর মিথ্যা ও বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ প্রকাশ করা থেকে বিরত রাখুন। আমিন।
বিলাল মাহিনী, পরীক্ষক ” ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
প্রতিষ্ঠাতা-সিংগাড়ী আঞ্চলিক গণগ্রন্থাগার ও ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র।
জীবন সদস্য : নওয়াপাড়া ইনস্টিটিউট, যুগ্ম সম্পাদক : ভৈরব-চিত্রা রিপোর্টার্স ইউনিটি, অভয়নগর, যশোর।